১৯২৯ থেকে ৩০ সালের মহামান্দা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর ৷ অথবা, ১৯২৯-৩৩ সালের মহামন্দার প্রকৃতি তুমি কীভাবে ব্যাখ্যা করবে
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মহামন্দা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে (১৯১৮ খ্রিঃ) প্রায় এক দশকের মধ্যে এক 'বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা সোভিয়েত ইউনিয়ন ছড়া প্রায় সকল দেশে দেখা দেয়। এই মন্দা সর্বপ্রথম আমেরিকায় দেখা দেয়। 'আমেরিকার শেয়ার বাজারে ধাম' মহামন্দার সূচনা হিসাবে গণ্য করা হয়ে থাকে।
১৯২৯ -এর ২৪ শে অক্টোবর, 'কালো বৃহস্পতিবার' নামে পরিচিত। শেয়ার মালিকরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে শেয়ার বিক্রি করতে থাকে। সেমিন ৩০ মিলিয়ন শেয়ার কেনাবেচা হয়। ২৯ শে অক্টোবর মঙ্গলবার আরো ১৩ ই মিলিয়ন শেয়ার হাত বদলায়। ওয়াল স্ট্রীটের শেয়ার মার্কেটে হাহাকার দেখা দেয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা তেজীভাব দেখে শেয়ার বাজারে অর্থ বিনিয়োগ করেছিল, তারা সর্বস্বায়ত্ত হয়ে পড়ে। মার্কিন ব্যাঙ্কগুলি শেয়ার বাজারে বহু টাকা লরী করেছিল। তারা বিশাল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। মানুষের ধারণা হয় ব্যাঙ্ক অপেক্ষা নিজের বাড়ীতে টাকা রাখা অনেক বেশি নিরাপদ। এই ধারণায় লক্ষ লক্ষ মানুষ ব্যাঙ্ক থেকে তাদের টাকা তুলে নেবার জন্য ছুটতে থাকে । ব্যাঙ্কগুলিতে অত টাকা ছিল না। ফলে ব্যাঙ্কগুলিও দরজা বন্ধ করে। এইভাবে ১৯২৯ খ্রিঃ থেকে ১৯৩২ খ্রিঃ -এর মধ্যে ৫৭০০ টি ব্যাঙ্ক ফেল করে এবং আরও ৩৫০০ টি ব্যাঙ্ক তাদের কাজকর্ম বন্ধ রাখে । দুমাসের মধ্যে মার্কিন বিনিয়োগকারীরা ৪০ মিলিয়ন ডলার হারায় এবং ব্যাঙ্ক ব্যাবস্থা ভেঙে পড়ায় আমানতকারী অনগণ সর্বদ্বান্ত হয়। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি ব্যাঙ্কের ঋণ থেকে বঞ্চিত হয়। তাদের উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রি না হওয়ার ফলে কারখানাগুলি একে একে বন্ধ হয়ে যায় এবং কারখানার শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়ে। কৃষিপণ্যের মূল্যও ভয়াবহভাবে হ্রাস পায় এবং লক্ষ লক্ষ কৃষক জমি হারিয়ে ভিখারির পর্যায়ে নেমে যায়। আমেরিকা থেকে এই মন্দা অর্থনৈতিক ভূমিকম্পের মত ইওরোপে ও এশিয়ায় ছাড়ায়।
এই মহামন্দার সঠিক কারণ জানা যায় নি। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও অর্থনীতিবিদ মহামন্দার বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করেন। ঐতিহাসিক ডেভিড টমসন এর তিনটি কারণ উল্লেখ করেছেন। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সংকোচন, অস্বাভাবিক ফাটকাবাজী এবং ক্ষতিপূরণ সমস্যা। আর এর সঙ্গে ছিল বিশ্বব্যাপী অর্থের সংকট।
গ্যাথোর্ন হার্ডির মতে, যুদ্ধের সময় মার্কিন দেশ প্রচুর যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করে তা রপ্তানি করত । যুদ্ধ শেষে এই অস্ত্র রপ্তানি বন্ধ হলে মার্কিন ভারী শিল্পে দারুণ আঘাত পড়ে। লোহা ও কয়লা শিল্পের ওপর তার প্রভাব পড়ে। এছাড়া যুদ্ধের সময় থেকে বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য, খাদ্যশস্য এবং শিল্পদ্রব্য মার্কিন দেশ ইওরোপকে রপ্তানি করত। সেই চাহিদার ফলে মার্কিন শিল্পদ্রব্যের ও খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ান হয়েছিল। এখন যুদ্ধ শেষে ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ তাদের নিজ নিজ শিল্প ও খাদ্য উৎপাদনের ওপর জোর দিলে আমেরিকার রপ্তানি বাণিজ্যে ঘাটতি দেখা দেয়।
দ্বিতীয়, একটি কারণ হিসাবে বলা হয় যুদ্ধ ঋণ পরিশোধ ও পণ্য ক্রয় বাবদ ইওরোপ থেকে প্রচুর সোনা মার্কিন দেশে পাঠাতে হয়। এজন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সোনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাণ্ডারে জমা হয়। এজন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। যারা মার্কিন দেশের মাল কিনত অথবা যারা মার্কিন দেশকে ঋণ পরিশোধ করত তাদের স্বর্ণভাণ্ডার শূন্য হয়ে গেলে তারা আর মার্কিন মাল খরিদ অথবা মার্কিন দেশের প্রাপ্য ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারে নি। এজন্য মার্কিন উদ্বৃত্ত শিল্প ও খাদ্যদ্রব্য গুদামে পচতে থাকে।
তৃতীয়ত, যুদ্ধের সময় আমেরিকা ও কানাডার গম ইওরোপের মিত্রশক্তি ব্যাপক আমদানী করত। এখন যুদ্ধের পর ইওরোপের কৃষিতে জোয়ার দেখা দিলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা প্রভৃতি দেশের খাদ্যশস্য ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের রপ্তানি অকস্মাৎ হ্রাস পায়। অপরদিকে লোকের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেলে কৃষিপণ্য ও শিল্পদ্রব্যের চাহিদা দারুণ ক্ষয় পায়। এতে কৃষিপণ্যের রপ্তানিকারক দেশগুলির অর্থনীতিতে ধ্বস নামে। ক্রমে এই সঙ্কট এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। অনেকের মতে শুধু সোনার রপ্তানি নয়, রুপার অতিরিক্ত আমদানী বৃদ্ধি মুদ্রামূল্য হ্রাসের প্রধান কারণ ছিল। এর ফলে যে সকল দেশে রৌপ্যমান প্রচলিত ছিল সেখানে রুপার অতিরিক্ত আমদানীর ফলে টাকার দাম পড়তে থাকে । টাকার দাম পড়ে গেলে লোকে কৃষি ও শিল্পজাত পণ্য ক্রয় করতে অক্ষম হয়। মালের চাহিদা দ্রুত ক্ষয় পেলে, কল-কারখানা বন্ধ হয়, হাজার হাজার মানুষ কর্মচ্যুত হয়ে পড়ে। এসবের সামগ্রিক ফল হল বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দা।
১৯৩০ -এর মহামন্দার প্রতিক্রিয়া ছিল তাৎক্ষণিক এবং সুদূরপ্রসারী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ধনতন্ত্রী মুক্ত দুনিয়ার ওপর এত বড় আঘাত আর কখনও ঘটেনি। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ধনতন্ত্রী বিশ্বের অর্থনৈতিক লেনদেন ছিল না। এজন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন এই মহামন্দার হাত থেকে বেঁচে যায়। গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে মহামন্দার সর্বনাশা প্রভাব বেশি তীব্র ছিল। এজন্য গণতান্ত্রিক ও উদারতান্ত্রিক সরকারগুলি এই মহামন্দার ধাক্কা সামলাতে পারেনি। উদারতন্ত্র ও গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাহীনতা দেখা দিলে তার বিকর হিসাবে কোন কোন দেশ ফ্যাসিবাদ বা নাৎসীবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়, কোন কোন দেশ বলশেভিক সাম্যবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণি যারা ছিল গণতন্ত্রের প্রধান স্তম্ভ তারাই জার্মানি প্রভৃতি দেশে আশাহত হয় । এজন্য একনায়কতান্ত্রিক, একদলীয় শাসনের দিকে ঝোঁক বাড়ে। অপর দিকে, বহু মধ্যবিত্ত ও শ্রমিক সাম্যবাদের মধ্যে মুক্তির পথ খোঁজে।
জার্মানির ক্ষেত্রে এই মহামন্দার ফল ছিল ভয়াবহ। একেই বিশ্বযুদ্ধে অর্থনৈতিক ধ্বস ও ক্ষতিপূরণের বোঝায় জার্মানি ছিল ডুবন্ত অবস্থায়। ডাওয়েজ ও ইয়ং পরিকল্পনার দ্বারা জার্মানিতে মার্কিন ঋণের প্রবাহ বইলে জার্মানি তাতে কিছুটা স্বস্তি পায় । জার্মানির ভাইমার প্রজাতন্ত্রের প্রতি জার্মান জনসাধারণের আস্থা বিনষ্ট হয়। এই মন্দার ধাক্কা থেকে বাঁচতে জার্মানি ও অস্ট্রিয়া উভয় দেশ 'শুল্ক জোট' গঠন করে। কিন্তু ফ্রান্স তার নিরাপত্তার আশঙ্কায় এই জোট গড়ার বিরোধিতা করে। অস্ট্রো- জার্মান অর্থনৈতিক জোট ভেঙে গেলে জার্মানির অর্থনৈতিক দুর্দশা, মুদ্রাস্ফীতি চরমে ওঠে। ভাইমার প্রজাতন্ত্রের পতনের শেষ ঘণ্টা বেজে যায়। নাৎসী নেতা হিটলার ১৯৩৩ খ্রিঃ ক্ষমতা দখল করেন। এই মহামন্দার ফলে ইওরোপে 'অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ' বা Economic nationalism প্রবল হয়ে ওঠে। প্রতি রাষ্ট্র উচ্চ শুল্ক প্রাচীর তুলে অন্য দেশ থেকে মাল আমদানী বন্ধ করতে চেষ্টা করে। এজন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বড় রকমের ধাক্কা খায়। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংকটের ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। ঐতিহাসিক ই.এইচ. কার স্বাভাবিকভাবেই মন্তব্য করেছেন যে ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে যখন অর্থনৈতিক দুর্যোগের মেঘ কেটে যেতে শুরু করে, ঠিক সেই মুহুর্তে রাজনৈতিক পরিবেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়। তাই যখন মহামন্দার ধাক্কায় বিভিন্ন দেশ বিপর্যস্ত, তখনই সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে জাপান মাজুরিয়া আক্রমণ করে এবং জাতিসঙ্ঘ থেকে বেরিয়ে আসে, লীগ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয়। জার্মানি একই ভাবে 'নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন' থেকে প্রতিনিধি প্রত্যাহার করে নেয় এবং সমর সজ্জার দিকে মন দেয়। স্বাভাবিকভাবেই যৌথ নিরাপত্তার ভিত্তি শিখিল হয়ে পড়ে।
FAQ (প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী) এবং তাদের উত্তর
১৯২৯ সালের মহামন্দার কারণ ও ফলাফল কী ছিল?
১৯২৯ সালের মহামন্দার প্রধান কারণ ছিল স্টক মার্কেটের পতন, ব্যাংকিং ব্যবস্থার দুর্বলতা, অতিরিক্ত ঋণ, এবং শিল্প উৎপাদনের হ্রাস। ফলাফল হিসেবে ব্যাপক বেকারত্ব, ব্যবসা বন্ধ হওয়া, এবং অর্থনৈতিক কার্যকলাপের স্থবিরতা দেখা দেয়।
১৯২৯ সালের মহামন্দার ফলাফল কী ছিল?
ফলাফল হিসেবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, ব্যাপক বেকারত্ব, দারিদ্র্য, এবং সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেয়। অনেক দেশ তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুনর্গঠনে বাধ্য হয়।
১৯২৯ সালের মহামন্দার প্রভাব কী ছিল?
মহামন্দার প্রভাব ছিল মারাত্মক; শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বন্ধ হওয়া, ব্যাংকগুলির পতন, এবং লাখ লাখ মানুষের কাজ হারানো। এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বহু বছর লেগে যায়।
অর্থনৈতিক মহামন্দা PDF পাওয়া যাবে কোথায়?
যদি আপনি pdf চান তাহলে অবশ্যই আমাদের মেসেজ করতে পারেন
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণ কী?
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণগুলির মধ্যে রয়েছে স্টক মার্কেটের পতন, ব্যাংকিং ব্যবস্থার দুর্বলতা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হ্রাস, এবং আর্থিক নীতি সংক্রান্ত ভুল সিদ্ধান্ত।
অর্থনৈতিক মহামন্দা বলতে কী বোঝ?
অর্থনৈতিক মহামন্দা বলতে বোঝায় একটি দীর্ঘমেয়াদী ও গুরুতর অর্থনৈতিক সংকট, যেখানে শিল্প উৎপাদন, কর্মসংস্থান, এবং অর্থনৈতিক কার্যকলাপ মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়।
ইউরোপের মহামন্দার কারণ কী ছিল?
ইউরোপের মহামন্দার কারণগুলির মধ্যে ছিল:
- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টক মার্কেট পতনের প্রভাব
- ব্যাংকিং ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং ব্যর্থতা
- আন্তর্জাতিক ঋণ ও বাণিজ্য সংকট
- বিশ্বযুদ্ধের পর অর্থনৈতিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার অসম্পূর্ণতা
গ্রেট ডিপ্রেশন বলতে কি বোঝায়?
গ্রেট ডিপ্রেশন বলতে বোঝায় ১৯২৯ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে ঘটে যাওয়া একটি বিশাল অর্থনৈতিক সংকট, যা মূলত যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু হয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এবং এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।