সন্ত্রাসের রাজত্ব বলতে কী বোঝ ? জ্যাকোবিন শাসন তন্ত্রের বিবরণ দাও সন্ত্রাসের শাসনের মূল্যায়ন করো? সন্ত্রাসের শাসনের কার্যাবলী ?
বিশ্ব ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো ফ্রান্সের সন্ত্রাসের রাজত্ব ৷ জ্যাকোবিনরা এক সংকট সয় মুহূর্তে ক্ষমতা লাভ করেছিল রাজা 'ষোড়শ লুই' এর মৃত্যুর পর ফ্রান্সে ঘরে বাইরে বিপদ আছড়ে পড়ে ৷ এই বিপদকে মোকাবিলা করার জন্য জ্যাকোবিনরা যে শাসন নীতি অনুসরন করেছিল, তাকে সন্ত্রাসের শাসন বলে অভিহিত হয় । এই শাসনের কেন উদ্ভব হয় তার ব্যাখ্যা বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন ভাবে মন্তব্য করেছেন । যেমন ঐতিহাসিক 'ওলার্ড' মনে করেন,"বিদেশি শক্তিদের চাপানোর যুদ্ধের মোকাবিলার করতে সন্ত্রাস শাসন চালু করা দরকার । কেননা চারিদিকে শত্রু পরিবেশিত হওয়ায় ফ্রান্সের পক্ষে আত্মরক্ষার আর কোন পথ খোলা ছিল না ।" তাই শত্রু বেণ্ঠিত ফ্রান্সের পক্ষে আত্মরক্ষার জন্য সন্ত্রাসের শাসন শুরু হয় । অন্য দিকে অনেকে মনে করেন সাকুলৎদের দাবি প্রতিষ্ঠাতা করার জন্য সন্ত্রাসের শাসন শুরু হয় ৷ টমসনের মতে,"ফ্রান্সের অভ্যন্তরে প্রতি বিপ্লবী শক্তি ও বহিঃশত্তুর আক্রমণ মোকাবেলা করার জন্য সন্ত্রাসের শাসন প্রবর্তন করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না । "
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
এটা ঠিক রাজা ষোড়শ লুই এর মৃত্যুর পর ফ্রান্সের শাসন ব্যবস্থা এক চরম সংকটের মুখে পড়েছিল । বিপ্লবী ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ইউরোপের একাধিক শক্তিবর্গ যেমন, ইংল্যান্ড, অষ্ট্রিয়া, প্রাশিয়া, স্পেন, পর্তুগাল শক্তিজোট গঠন করেছিল এক ফ্রান্সের দিকে অগ্রসর হয়েছিল । বিভিন্ন রণক্ষেত্রে ফারাসি বাহিনী একাধিক পরাজয় দেখতে থাকে । মুক্ত বাহিনী ফ্রান্সের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত অতিক্রম করে প্যারিসের দিকে অগ্রসর হলে ফরাসি সরকারের নিরাপত্তা বিপন্ন হয়ে ওঠে ৷ এমনকি ফ্রান্সের অভ্যন্তরেও সংকট দেখা দেয়। ফ্রান্সের মধ্যে খাদ্যের অভাব, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি, মজুরীর হার কমে যাওয়া এই নানা কারণে ফ্রান্সে অচল অবস্থার সৃষ্টি করে । দেশের অভ্যন্তরে লাভেন্ডি, লাসনস, তুঁর্লো, মার্সাই প্রভৃতিস্থানের প্রতি বিপ্লবী প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় ৷ ক্ষুব্ধ জনগন প্রকাশ্যে প্রজাতান্ত্রিক বিরোধীতা করতে শুরু করে,কর দিতে তারা অস্বীকার করে । বিদেশী গুপ্তচরে সারা ফ্রান্স যা ভরে যায় । মজুত দার কালো বাজারীদের রাজ্য হয় ফ্রান্স । সারা দেশে প্রতি বিপ্লব শুরু হয় । ফ্রান্সের এই ঘরে বাইরের বিপদকে মোকাবিলা করার জন্য জ্যাকোবিনরা এই সন্ত্রাসের শাসনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ।
1792 সালে আগস্ট মাসে সন্ত্রাসের শাসনের সূত্রপাত হয় ৷ এই শাসনকে কার্যকর করার জন্য এ (১).জন নিরাপত্তা (২). সাধারণ নিরাপত্তা সমিতি' দুটি সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় । জন নিরাপত্তা সমিতি ছিল সন্ত্রাসের শাসনের কেন্দ্রীয় সংস্থা, এর সদস্য সংখ্যা ছিল ১২ জন । জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে যে কোনো রকম ক্ষমতা প্রয়োগে ক্ষমতা ছিল এই সমিতি। এই কমিটির উপর সন্ত্রাসের নেতা রোবসপিয়ারের ক্ষমতা ছিল নিরঙ্কুশ ৷ আবার, সাধারণ নিরাপত্তা সমিতির হাতে দেশের শান্তি শৃঙ্গলা পুলিশ বিভাগ ইত্যাদির দায়িত্ব ছিল । এমনকি প্রজাতন্ত্র বিরোধী সন্দেহে অভিযুক্তদের বিচারালয়ে বিচার করা হত সন্দেহের আইন অনুসারে মেকোনো ব্যক্তিকে হত্যা করা হত অধিকাংশ ক্ষেত্রে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের গিলোটিনে হত্যা করা হত। আর অই সন্ত্রাসের মাসন পরিচালনার জন্য জ্যাকোবিনরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সন্ত্রাসের শাসনে রোরেস্পিয়ার ছাড়াও দাঁতো, হিবার্ট প্রমুখ বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
কার্যাবলী
সন্ত্রাসের রাজত্বের শাসনের কার্যকাল ছিল মাত্র 1 বছর তা সত্ত্বেও ফরাসি বিপ্লবরে ইতিহাসে তা এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসাবে চিহ্নিত । অত্যন্ত কঠোরতা সঙ্গে এই শাসনকে প্ররিচালিত করতে গিয়ে এই সময়কার শাসনকর্তারা মানুষের রক্ত নিয়ে হোলি খেলে ছিলেন ৷সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের গিলোটিনে হত্যা করা হতো ৷ অনুমান করা হয় এই শাসনে বলি হয়েছিল প্রায় ৫০ হাজার মানুষ ৷ সন্ত্রাসের শাসনে যারা প্রান দেন তাদের মধ্যে স্বরনীয় হলেন মাঁদাম রোলা, বিসো,বৈজ্ঞানী ব্রেইলি,বারনেভ প্রমূখ চিরন্ডিন নেতারা সন্ত্রাসের বলি হন বহু নেতা অমনকি সন্ত্রাসের নায়ক দাঁতো ও ইউ বাট কেউ হত্যা করে রোবসপিয়র সন্ত্রাসের শাসনের কর্ণধারে পরিণত হন ।
সন্ত্রাসের শাসনের সময় ফ্রান্স অন্তত্য সফল ভাবে বিদেশী শক্তি গুলির মোকাবিলা করেছিল । ফ্রান্সে এক শক্তিশালী সৈন্য বাহিনী গঠনের দিকে মননিবেশ করা হয় । এর জন্য প্রত্যেক সুষ্ঠ যুবককে সৈন্য বাহিনীতে যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল । শক্তিশালী ফরাসি সৈন্যরা ফ্রান্সকে বিদেশী আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করেছিল, সন্ত্রাসের শাসনের নেতিবাচক দিক থকলেও এই ইতিবাচক দিককে অস্বীকার করা যাবে না । এই সময় কারখানা গুলিতে বিপুল পরিমানে অস্ত্র তৈরী হয়েছিল । গৃহ যুদ্ধের হাত থেকে সন্ত্রাসের শাসন মুক্ত করতে পেরেছিল ফ্রান্সকে ।
এমনকি অর্থনৈতিক দিক দিয়েও এই শাসন সুফল এনেছিল । সরকার অল্পদামে খাদ্য শস্য ও অনান্য দ্রব্য সামগ্রীর জোগান অব্যাহত রেখেছিল এবং কৃষকদের স্বার্থকে বজায় রেখেছিল । আইন পাশ করিয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম তারা বেঁধে দিয়েছিল । দেশ ত্যাগী অভিজাতদের জমি সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তারা কৃষকদের দিয়েছিল, ভূ-স্বামীদের সমস্ত কর তারা বাতিল করেছিল । এই সমস্ত কারণে সন্ত্রাসের শাসনকে কৃষকরা সমর্থন করেছিল ।
সন্ত্রাসের শাসকরা এক দক্ষ শাসনের জন্ম দিয়েছিল ৷ তারা অবক নতুন জাতীয় শিক্ষণ নীতি গ্রহন করেছিল এবং ফরাসি ভাষাকে শিক্ষ্যার মাধ্যম রূপে গ্রহণ করেছিল । সমস্ত দেশের জন্য এক অভিন্ন আইন বিধি রচনার চেষ্টা তারা করেছিল । ফরাসি উপনিবেশ গুলিতে কৃতদাস প্রথা বন্ধ করেছিল । জ্যাকোবিনরা একটি প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান রচনা করেছিল । এই সংবিধান ১৭৯৩ সালের সংবিধান নামে পরিচিত ছিল । এই সংবিধানে রুশোর সার্বভৌমত্ব তত্ত্বকে বাস্তবায়িত করা হয় ৷ প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তিদের ভোটাধিকার করা হয়, তবে মহিলাদের ভোটদানের অধিকার দেওয়া হয়নি । এই সংবিধানে নাগরিবাদের অধিকার যেমন ঘোষিত হয়, তেমনি রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদের কর্তব্য কে স্বরণ করিয়ে দেওয়া হয় ৷ কিন্তু, এই সংবিধানটি কার্যকর হয়নি, কারণ জ্যাকোবিনরা ১ বছর মধ্যে অর্থ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল তবুও তাদের এই প্রচেষ্টা অবশ্যই স্বরনীয় ।
মূল্যায়ন
সন্ত্রাসের শাসনের মূল্যায়ন নিয়ে ঐতিহাসিবা বিতর্কের শেষ নেই । এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সন্ত্রাসের শাসনের শুরু হয়েছিল, ফ্রান্স তখন বিদেশী আক্রমনে ভূত এবং আভ্যন্তরীন ক্ষেত্রে সংকটাপন্ন ছিল, তাই সন্ত্রাসের শাসনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। । প্রচুর রক্তপাত হয়েছিল ঠিকই । তবে এই শাসনে অনেক ইতিবাচক দিক ছিল । যথা ① এই শাসনের মূল কৃতিত্ব হল গৃহযুদ্ধ, অরাজকর্তা ও বিদেশী আক্রমণের হাত থেকে ফ্রান্সকো রক্ষা করা । (২). মজুরদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয় ৷ ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ ঠিকা থাকে (৩). দেশ ত্যাগী অভিজাতদের জমি সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে সেগুলিকে খুব কম দামে কৃষকাদের দেওয়া হয়। এমনকি সামন্ত প্রভুদের অত্যাচার থেকে কৃষকদের তারা মুক্ত করেছিল। (৪). ফ্রান্সে প্রচুর কলকারখানার প্রতিষ্ঠা হয় ফলে বেকারত্বের অবসান হয় । ব্যবসা বানিজ্য ও কৃষির উন্নতির দিকে নজর দেওয়া হয়েছিল ৷ এই শাসন ব্যবস্থায়, সার্বজনীন প্রার্থমিক শিক্ষ্যা প্রবর্তিত হয় এই শাসনে ।
অর্থাৎ, বিপ্লবের আদর্শ গুলি রাপায়নে সন্ত্রাসের শাসন গুলি ভূমিকা নেয় তা সত্যই প্রসংশনীয় ছিল ৷ অন্যদিকে আর একদল ঐতিহাসিকদের বক্তব্য সন্ত্রাসের শাসন সমর্থন যোগ্য নয় । ঐতিহাসিক টেইন মনে করেন সন্ত্রাসের রাজত্ব ছিল ক্ষমতা লোভী, দুর্নীতি, সুবিধাভোগী এক শ্রেনী মানুষের শাসন , ব্যক্তি স্বাধীনতা জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বলে কিছু ছিল না । সন্দেহের বশে হাজার হাজার মানুষকে আটক ও হত্যা করা হয়েছিল । রোবোস্ফিয়ার তার অনুগামীদের ও হত্যা করে প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এই শাসন বজায় ছিল ৷ প্রকৃতপক্ষে বহু মানুষ অন্যায় ভাবে সন্ত্রাসে বলি হন । 1793 সালে সেপ্টেম্বর মাসের পর আর সন্ত্রাসের শাসন প্রয়োজন ছিল না ।
সন্ত্রাসের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি গুলির মধ্যে কিছু সত্য আছে । নিরপেক্ষ ভাবে বলা যায়, আভ্যন্তরীন সংকট ও জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে সন্ত্রাসের প্রয়োজন ছিল, সন্ত্রাসের শাসন তার উদ্দেশ্য সাধনে সফল হয়েছিল । লেফেফর মনে করেন সমাজে বিপ্লব-এর আদর্শ প্রতিষ্ঠা ও অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য সন্ত্রাসের প্রয়োজন ছিল ৷ সন্ত্রাস ছাড়া ফ্রান্সের কালোবাজারিদের হাত থেকে রক্ষণ করা যেত না ।" সন্ত্রাসে বলি হয়েছে অনেক মানুষ ঠিকই তবে ফ্রান্সে জন জীবন স্তব্ধ হয়েছিল তা বলা যাবে না, সাধারণ মানুষ যারা সন্দেহের উদ্বো (বাইরে) তারা জীবন উপোৎ উপভোগ থেকে বঞ্চিত হয়নি, সন্ত্রাসের সময় সাধারন মানুষ আমোদ- প্রমোদে দিন কাটাতো । সবচেয়ে বড়ো কথা ফরাসি মেয়েরা তাদের গলার হারে লকেট হিসাবে গিলোটিন যন্ত্রের প্রতিক ধারণ করেছিল । তাই ঐতিহাসিক ডেভিড টমসন এর মতে ," সন্ত্রাসের শাসনে নিষ্ঠুরতা থাকলেও আজকের যুগের একনায়ক তন্ত্রের তুলনায় তা ছিল অনেক কম ।"