দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী কালে কৃষক আন্দোলনের বিবরণ দাও

দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী কালে কৃষক আন্দোলনের বিবরণ দাও
ভারত কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের বেশিরভাগ মানুষ কৃষির সঙ্গে যুক্ত । সেহেতু এ দেশের কৃষক আন্দোলন সংঘটিত হওয়া কোন অস্বাভাবিক ঘটনা নয় ৷ সপ্তদশ শতকে ভারতের নিম্নবিত্ত কৃষিজীবী মানুষ যে আন্দোলনের সূচনা করেন অষ্টাদশ উনবিংশ শতকে তা আরো জোরালো হয় এবং বিংশ শতকে তা যথার্থ সুসংগঠিত আন্দোলনের রূপ নেয় ৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জনিত মুদ্রাস্ফীতি অন্যান্য জীবিকার মানুষের তুলনা কৃষকদের বেশি করে আঘাত করেছিল ৷ সরকারের যুদ্ধ ব্যয় মেটানোর জন্য এক দিকে কৃষকদের ওপর রাজস্ব বোঝা ক্রমশ বাড়তে থাকে অন্যদিকে, সেনাবাহিনীর প্রয়োজনে অল্প মূল্যে জোরপূর্বক কৃষি উৎপাদন বাজেয়াপ্ত করতে থাকে ৷ এর ওপর অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিক হয়ে বাড়তে থাকে ৷ কাপড়, তেল, ঔষধ প্রভৃতি সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায় ৷ এইভাবে বহুমুখী চাপে কৃষকদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উড়তে থাকে ৷ তাই এই একই সঙ্গে বৃদ্ধি পেতে থাকে তাদের অসন্তোষ তাই অসহযোগ এবং আইন অমান্য আন্দোলনের সময় বহু কৃষক এই আন্দোলনে নিজেদের যুক্ত করে ৷
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী পর্যন্ত বিহার, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ ও দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে কৃষক আন্দোলন লক্ষ্য করা যায় ৷ স্বামী বিদ্যানন্দের নেতৃত্বে বিহারের মহারাজের বিরুদ্ধে কৃষক শ্রেণীর আন্দোলনে লিপ্ত হয় ৷ এই আন্দোলনের মধ্যবিত্ত কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণি যোগ দেয় ৷ সরকারি আমলের অত্যাচার বন্ধ, ফসলের পরিবর্তে নগৎঅর্থে খাজনা প্রদান বন্ধ প্রভৃতি ছিল এই আন্দোলনের মূল দাবি ৷ রাজস্থানের কৃষক নেতা ভূত সিংহ কৃষকদের সংঘটিত করে উদয়পুরের মহারানীর বিরুদ্ধে খাজনা বন্ধের আন্দোলন শুরু করেন ৷ একইভাবে খাজনার রাজ্যে নারায়ন ব্যাস বিজয় সিংহ প্রমুক ও কৃষক আন্দোলন সংঘটিত করলে কৃষক সমাজ এই আন্দোলনে স্থানীয় কংগ্রেস দলের রাজনৈতিক সমর্থন কাজের চেষ্টা করেন ৷ কিন্তু জমিদার ও মধ্য সত্য ভোগী শ্রেণীর বিরাটভাজন হওয়ায় স্থানীয় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ কৃষক আন্দোলনের প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিতে দ্বিধাবোধ করেন ৷ অবশ্য পরোক্ষভাবে কৃষকদের উপর থেকে রাজস্বের চাপ কমানোর জন্য তারা জমিদারদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন ৷
উত্তর প্রদেশের রায়বেরেলি ও প্রতাপগড় অঞ্চলে ঝিংকুড়ি সিংহের নেতৃত্বে কৃষক গন সংঘবদ্ধ হন ৷ তবে সন্ন্যাসী বাবা রামচন্দ্রের নেতৃত্বে জাতীয় নেতা মদনমোহন মালব্য কৃষাণ সভা গঠন করেন ৷ কৃষকদের সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করেন ৷ কিন্তু এই সংগঠন কৃষকদের সমস্যার সমাধান করতে পারেনি ৷ তবে বাবা রামচন্দ্র তার সহজ সরল জীবনযাত্রা সন্ন্যাসী সুলভ আচরণের মধ্য দিয়ে কৃষক আন্দোলনকে এক সংহত ও শক্তিশালী রূপ দেন ৷ বাবা রামচন্দ্র নিজেকে গান্ধীর শিষ্য বলে অভিহিত করেন এবং ধর্মভিত্তিক আন্দোলনের ডাক দেন । তার আহবানে প্রজারা খাজনা বন্ধ, আন্দোলন শুরু করেন ৷ পুলিশ ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে আগস্টে কয়েকজন অনুগামী সহ বা রামচন্দ্রকে গ্রেফতার করে কিন্তু কৃষকদের বিশাল ঐক্যবদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ মিছিলে ভীত হয়ে সরকার বাবা রামচন্দ্র কে মুক্তি দিতে বাধ্য হন ৷
পরবর্তীকালে জহরলাল নেহেরুর পরামর্শ কমে বাবা রামচন্দ্র উত্তর প্রদেশে কিষান সভা স্থাপন করে ৷ কিষান সভার নানা খাজনা প্রদান বেগার শ্রমের অবসান, জমিদারকে বিনামূল্যে ঘুটে,খড় ইত্যাদি প্রদান বন্ধ প্রভৃতি দাবির ভিত্তিতে কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলেন ৷ তবে কিষান সভায় অশান্তির আগুন জ্বলে ওঠে ফলে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ এই আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ায় ৷ এমন অবস্থায় পুলিশ নির্মম অত্যাচার চালিয়ে এই আন্দোলনকে ধ্বংস করে দেয় ৷ তবে সরকার কিছু কৃষকদের কিছু সুবিধা প্রদান করেন ৷ আবার ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে উত্তরপ্রদেশের কৃষকদের একা আন্দোলন বেশ ব্যাপকতা লাভ করেছিল ৷ মাদারি পার্শী ছিলেন একা আন্দোলনের প্রধান নেতা । এই আন্দোলন ও ক্রমে হিংসাত্মক আকার ধারণ করলে জাতীয় কংগ্রেসের সমর্থন থেকে বঞ্চিত হয় এবং সরকারের দমন নীতির ফলে এই আন্দোলন সীমিত হয়ে পড়ে ৷
অসহযোগ আন্দোলনের সময় দক্ষিণ ভারতে মালাবারের মোপলা সম্প্রদায় এবং গোদাবরী উপত্যকার অরণ্য ও মোহরা অঞ্চলের বসবাসকারী রম্পা উপজাতির বিদ্রোহ করে কৃষক বিদ্রোহকে ব্যাপকতা দান করেন ৷ ঊনবিংশ শতকের কৃষক আন্দোলনেও এই দুটি উপজাতির ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল ৷ আবার ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের সরকার রায়বেরেলির তমলুকে প্রায় ৩০ শতাংশ রাজস্ব বৃদ্ধি করে এক নির্দেশ জারি করলে এই অঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে দারুন পথিক্রিয়া দেখা দেয় ৷ কৃষকরা সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেলের নেতৃত্বে অতিরিক্ত খাজনা বন্ধের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন ৷ বহু নারী এই আন্দোলনে অংশ নেন , গান্ধীজি ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে বারদৌলিতে উপস্থিত হয়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন ৷ আন্দোলনের তীব্রতা সরকারকে চিন্তিত করে তোলে এবং শেষ পর্যন্ত সরকার খাজনার পরিমাণ কমিয়ে দিতে বাধ্য হন ৷
১৯১৯ থেকে ১৯৩৯ সংঘঠিত দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়কালে ভারতের কৃষক আন্দোলন গুলি পর্বের তুলনায় স্বতঃস্ফূর্ত এবং গতিশীল হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু এই আন্দোলন গুলি একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় বা লক্ষে পৌঁছাতে পারেনি। যদিও এর পিছনে একাধিক কারণ নিহিত ছিল। মূলত এ সময় সমগ্র ভারতজুড়ে যে সমস্ত কৃষক আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল সেগুলি সুসংগঠিত ছিল না, তাদের মধ্যে কোন ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচিও ছিল না। দেশের বিভিন্ন অংশে কৃষকেরা আন্দোলনে লিপ্ত হয়েছে স্থানীয় সমস্যার ভিত্তিতে এবং বিচ্ছিন্নভাবে। কৃষক আন্দোলনগুলির কোনো আদর্শগত কর্মসূচি ছিল না। কখনো সমাজতন্ত্রবাদ কখনো গান্ধীবাদ কখনো বা সাম্যবাদী আদর্শের লক্ষ্যে
আন্দোলনগুলি সংগঠিত করা হয়েছে। ফলে কোনো বিশেষ আদর্শের বন্ধনে কৃষকসমাজ ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। আবার জাতীয় কংগ্রেস জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বাইরে কমক-আন্দোলনকে উন্নীত করতে চায়নি। কৃষকদের জন্য স্বতন্ত্র কোনো অর্থনৈতিক লক্ষ্যে কোনোরূপ জঙ্গী আন্দোলনের চিন্তা কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের ছিল না। এমনকি জওহরলাল নেহরু কিংবা সুভাষচন্দ্র বসু জঙ্গী কৃষক আন্দোলন চাননি। স্বভাবতই কৃষক-জাগরণ ছিল অনেকটাই দুর্বল।
দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়কালে ভারতের
বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকবর্গ তাদের দাবি দাওয়া
এবং শোষণের ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সরব হলেও
শ্রেণীগতভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি বা এমন কোন নেতৃত্ব তাদেরকে এক সূত্রে বাঁধতে পারেনি। আর সে কারণেই কোন নেতৃত্ব তাদেরকে এক সূত বিচ্ছিন্নতাবাদী কায়েমি গোষ্ঠী খুব সহজেই তাদের আন্দোলন বা সংঘবদ্ধতাকে ভাঙতে সক্ষম হয়েছিল। তবে এ কথা অবশ্যই মানতে হবে যে সমসাময়িক পর্বে বিভিন্ন জাতীয় আন্দোলনে এই কৃষক বর্গের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং কার্যকরী ভূমিকা সত্যি চোখে পড়ার মতো ছিল।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী কালে কৃষক আন্দোলনের বিবরণ দাও এই নোটটি পড়ার জন্য