যুগান্তর দল সম্পর্কে আলোচনা কর

যুগান্তর দল
অনুশীলন সমিতির আন্দোলনের পদ্ধতিগত দিক থেকে দুটি ধারা ছিল (১). নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ (২). স্বতন্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে সন্ত্রাস ছড়ানো ৷ বিপ্লবী রবীন্দ্র কুমার ঘোষ ছিলেন স্বতন্ত্র আন্দোলন ও গুপ্ত হত্যার পক্ষপতি ৷ ক্রমে অনুশীলন সমিতির মূলধারার সঙ্গে রবীন্দ্র কুমার ঘোষের মতবিরোধ দেখা দেয় ৷ ফলস্বরূপ ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় বিপ্লবী নেতারা রবীন্দ্র কুমার ঘোষের নেতৃত্বে যুগান্তর নামে একটি গোপন সমিতি গঠন করেন ৷ বিপ্লবী অবিনাশ ভট্টাচার্য , দেবব্রত বসু প্রমুখ ও যুগান্তর দলে যোগ দেন ৷ এই দলের সাপ্তাহিক মুখপত্র যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ৷ এই যুগান্তর দল ও পত্রিকার প্রথম ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিপ্লবের আদর্শ প্রচার করতে থাকে ৷ এই দলের সদস্যরাই প্রথম বিদেশি শাসকদের বিরুদ্ধে বোমা ও পিস্তলের রাজনীতি অনুসরণ করেন ৷ রবিন ঘোষ ও তার সহযোগী বিপ্লবীরা বিরোধী ভাবধারা সমূহ জনসাধারণের মধ্যে প্রচারের ব্যবস্থা করেন ৷ এই উদ্দেশ্যে তারা বাংলার বাইরে বিহার, উড়িষ্যা, মাদ্রাজ , মহারাষ্ট্র প্রভৃতি রাজ্যে প্রতিনিধি প্রেরণ করেছিলেন ৷
বাংলায় সর্বোচ্চ বিভিন্ন পুস্তক ও পত্রিকার মাধ্যমে বিপ্লবী ভাবধারা প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। এইসব বিপ্লবী পত্রপত্রিকাগুলির মধ্যে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ভবানী মন্দির এবং ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে অবিনাশ ভট্টাচার্য প্রণীত বর্তমান রাজনীতি দুটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ৷ পত্রিকা গুলির মধ্যে অরবিন ঘোষ সম্পাদিত 'বন্দেমাতারাম', দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত 'সোমপ্রকাশ পত্রিকা' বিশেষ উল্লেখযোগ্য ৷
বিপ্লবী কার্যকলাপ পরিচালনা এবং তাদের রাজনৈতিক ক্রিয়াকল চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বিপ্লবীরা তাদের বন্ধু-বান্ধব ও বৃত্তশালী ব্যক্তিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করত ৷ পরে বিপ্লবী কার্যকলাপ বিস্তার হলে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়, তা মেটানোর জন্য তারা জোর করে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করেন ৷ বিপ্লবীরা প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রবীন্দ্র কুমার ঘোষ ও তার সহযোগী বিপ্লবীগণ কাজে নেমে পড়ে ৷ ১৯০৮ সালের জানুয়ারি মাসে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি কলকাতার উপকণ্ঠে মানিকতলার একটি বাগান বাড়িতে ধর্মীয় স্কুলের পাশাপাশি বোমা প্রস্ত্ততকারী একটি কারখানাও গড়ে তোলেন । কিন্তু ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল ক্ষুদিরাম বসু কর্তৃক মিস ও মিসেস কেনেডী হত্যার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সমগ্র দলটি গ্রেফতার হয়।
হেমচন্দ্র কানুনগো ও উল্লাস কর দত্ত এই বাগান বাড়িতে বোমা তৈরির দায়িত্ব নেন ৷ বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে দমনমূলক কার্যকলাপের নিযুক্ত সরকারি কর্মচারীদের হত্যার উদ্দেশ্যে তারা বোমা তৈরিতে লিপ্ত হয়েছিলেন ৷
১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে নবগঠিত পূর্ববঙ্গ ও আসামের অত্যাচারী লেফটেন্যান্ট গভর্নর ফুলার কে নোহাটি স্টেশনেও হত্যার জন্য প্রথম বোমাটি তৈরি হয়েছিল এবং ১৭ বছর বয়স্ক প্রফুল্ল চাকির উপর এই হত্যার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, প্রফুল্ল চাকি কাজে ব্যর্থ হন ৷ ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ৬ ডিসেম্বর পুনরায় মেদিনীপুরের কাছে ফুলারের ট্রেনকে লাইনচ্যুত করলেও এবারেও বিপ্লবীরা তাকে হত্যা করতে ব্যর্থ হন ৷
১৯৩০ সালের মে মাসে কলকাতা যুগান্তর দলের নেতৃবৃন্দ ত্রাস সৃষ্টির এক ব্যাপক পরিকল্পনা করে এবং বোমা তৈরির যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন । এই পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য ছিল:
- হোটেল, ক্লাব ও সিনেমা হলগুলিতে ইউরোপীয়দের হত্যা,
- দমদমের (কলকাতা) বিমানঘাটিতে অগ্নিসংযোগ,
- গ্যাস ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র ধ্বংস করে কলকাতায় গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করা,
- বজবজ-এর পেট্রোল ডিপোগুলি ধ্বংস করে কলকাতায় পেট্রোল সরবরাহ বন্ধ করা,
- ট্রাম সার্ভিসের যোগাযোগ রক্ষাকারী তারগুলি বিচ্ছিন্ন করে কলকাতায় ট্রাম ব্যবস্থা বিঘ্নিত করা,
- কলকাতার সাথে বাংলার অন্যান্য জেলাগুলির টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্নকরণ এবং
- ডিনামাইট ও হ্যান্ড গ্রেনেড দিয়ে সেতু ও রেলপথ উড়িয়ে দেয়া।
এর ফলে বাংলায় পুনরায় বিপ্লবী আন্দোলন শুরু হয়, বিশেষ করে চট্টগ্রামে । সমগ্র বাংলার বিপ্লববাদী সন্ত্রাসীদের ওপর চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন এর (১৯৩০) ঘটনার ব্যাপক প্রভাব পড়ে । ১৯৩৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি যুগান্তর দলের নেতা ও চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র লুটে নেয়ার পরিকল্পনার মূল সংগঠক মাস্টারদা সূর্যসেন পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এবং বিচারে তাঁর ফাঁসির রায় হয় ।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ যুগান্তর দল সম্পর্কে আলোচনা কর এই নোটটি পড়ার জন্য