তুমি কি মনে করো ভারতে সামন্ততন্ত্র আদি মধ্যযুগেই উত্থিত হয়েছিল?
খ্রিস্টিয় চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতকের মধ্যে ভারতের অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক নতুন প্রবণতা দেখা দেয়। কোনো কোনো ঐতিহাসিক এই প্রবণতার মধ্যে সামন্ততন্ত্রের উৎসের সন্ধান পেয়েছেন। ভারতীয় লেখকদের মধ্যে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত প্রথম প্রাচীন ভারতে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ও বিকাশের কথা বলেছেন। 'অগ্রহার' ভূমিদান ব্যবস্থার ব্যাপকতার সঙ্গে ভারতবর্ষে আদি মধ্যযুগের সূচনা তথা সামন্তব্যবস্থার উদ্ভবের প্রসঙ্গটি গভীরভাবে সম্পর্কিত।
ঐতিহাসিক কোশাদি তাঁর 'অ্যান ইনট্রোডাকশান টু ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি' গ্রন্থে বলেছেন যে দুইভাবে ভারতে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ঘটেছিল। তিনি এই ব্যবস্থাকে ওপর থেকে সামন্ততন্ত্র এবং নীচু থেকে সামন্ততন্ত্র বলে উল্লেখ করেছে। ইরফান হাবিবের মতে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে এইরূপ ওপর থেকে সামন্ততন্ত্র ও নীচু থেকে সামন্ততন্ত্র শব্দ প্রয়োগ গ্রহণযোগ্য নয়। অধ্যাপক শর্মাও এই দ্বিস্তর ভূমি সম্পর্ক ব্যবস্থার অস্তিত্ব মানতে অস্বীকার করেছেন।।
কার্সমার্কস সামন্তব্যবস্থাকে এক বিশেষ ধরনে উৎপাদন ব্যবস্থা হিসেবে দেখেছিলেন। অবশ্য এশিয় ইউরোপের উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে ভারতে সামন্ততন্ত্রের উৎপাদনের বিকাশের সম্পর্ক বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে দ্বিমত আছে। অষ্টম থেকে চতুর্দশ শতক পর্যন্ত ইউরোপ ছিল সামন্ততন্ত্রের যুগ। কালর্মীফল সামন্ততন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে জমিতে মালিকানার, জমির ওপর উপজাতীয় গোষ্ঠী মালিকানা, স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামের অস্তিত্ব ও কথ অর্থনীতি নগরের অবক্ষয় ইত্যাদি উল্লেখ করেছেন। দাসব্যবস্থাকে সরিয়ে দিয়ে এই ব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল। অর্থনীতির সর্বনিম্ন স্তরে ছিল সার্ফ বা ভূমিদাসরা। ভূ-স্বামী ও ভূমিদাসদের মধ্যে আধিপতা ও অধীনতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
অধ্যাপক কোশাস্ত্রী, শর্মা প্রমুখ ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্র এবং ভারতের তথাকথিত সামন্ততন্ত্রের মৌলিক পার্থক্য উল্লেখ করেছেন। তাঁদের মতে এশীয় উৎপাদন পদ্ধতি ধারণা ভারতীয় সমাজে খাপ খায় না। রামশরণ শর্মা, বি. এন. এস যাদব ও ডি. এন. কী ভারতের সামন্ততন্ত্রের তত্ত্বগত কাঠামোর উল্লেখ করেছেন।
রামশরণ শর্মা, বি. এন. এস. যাদব ও ডি. এন. কাঁ প্রমুখেরা মনে করেন যে অগ্রহায় ব্যবস্থার মধ্য নিয়েই সপ্তম শতকে ভারতে সামন্ততন্ত্রের বীজ বপন হয়। ভারতের রাজারা ব্রায়ণ নিষ্কর ভূমিদান করতেন। এই অগ্রহার ব্যবস্থা প্রবর্তনের সূত্রে প্রাপ্ত ভূখণ্ড বা গ্রামের ওপর দানগ্রহীতার এক ধরনের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। অধ্যাপক শর্মা জানিয়েছেন সামন্তব্যবস্থার উদ্ভব একধরনের বিকেন্দ্রীভূত অর্থনৈতিক অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। ড. রণবীর চক্রবর্তী লিখেছেন একাদশ দ্বাদশ শতকে দক্ষিণ ভারতের ভূসম্পদশালী মন্দিরগুলি অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপকেও নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। অগ্রহার ব্যবস্থায় গানগ্রহীতারা ভূ-স্বামী হয়ে যান। রাজস্ব আদায় ও অগ্রহার অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব তাঁদের ছিল। গুপ্ত ও বকাটক রাজারা অগ্রহার ব্যবস্থা শুরু করেছিলেন।
অগ্রহার ব্যবস্থার ফলে ভূমিব্যবস্থায় ব্যক্তিগত মালিকানার প্রসার ঘটেছিল। অধ্যাপক শর্মা আসরাফপুর তাপ্রশাসনের ভিত্তিতে দেখিয়েছেন যে মালিকানার বাইরে স্বতন্ত্র ভোগাধিকারের ধারণা ছিল। ভূ-স্বামী তার সব জমি নিজে চষে করতে পারতেন না। ফলে ভূ-স্বামীর অধীনে নানা স্তরে বিভক্ত ভূ-স্বামীর আবির্ভাব ঘটে। অধ্যাপক রণবীর গক্রবতীর মতে এই ব্যবস্থা কৃষি অর্থনীতিতে ভরীকরণের গতি বৃদ্ধি করে যা সামস্বাতন্ত্রের চরিত্রের সলো সামৎস্যপূর্ণ। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতকে দক্ষিণ ভারতে জমিতে বাড়িগত ঢালিকামার প্রসার ঘটেছিল।
রামশরণ শর্মা ও যাদব দেখিয়েছেন ভারতীয় কৃষকের অবস্থার অবনমন ঘটেছিল । কৃষকের স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে পড়ে । আদি মধ্যযুগের নথিপত্রে গৃহপতি কুটুম্বি প্রভৃতির শব্দের পরিবর্তে কৃষকদের হালকর, বন্দ, হল, আশ্রিত, হাপিক প্রভৃতি শব্দে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে কৃষকরা ভূমিদাসে পরিণত হয়েছিল কিনা সে বিষয়ে ড. শর্মা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তবে কোশাখি দেখিয়েছেন যে ভূস্বামীর করের বোঝা বেড়ে গেলে কৃষক চাষ ছেড়ে আত্মরক্ষা করত। বাংলার কৈবর্ত বিদ্রোহকে এইরূপ কৃষক বিদ্রোহ বলে উল্লেখ করা যেতে পারে।