মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য অশোক কী দায়ী ছিল?
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (খ্রিঃপূঃ ৩২৪-৩০০ খ্রিঃপূঃ) প্রথম সমগ্র উত্তর ও দক্ষিণ ভারত জুড়ে যে বিশাল মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল তাঁর পৌত্র অশোকের (খ্রিঃপূঃ ২৭৩-২৩২/মতান্তরে ২৩৬ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত) মৃত্যুর মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে এই বংশের বংশবর্তিকা যেভাবে কাঁপতে কাঁপতে নিভে গেল তা প্রায় একটি নাটকীয় চরিত্রের। বেশিরভাগ সাম্রাজ্যের পতনের ক্ষেত্রে প্রধান কারণ মূলত রাজনৈতিক অচলাবস্থার জন্য সাম্রাজ্যের গতি নিমাভিমুখী হতে শুরু করে। কিন্তু মৌর্যদের ক্ষেত্রে এই নিয়মের ব্যতিক্রম দেখা যায়। এই সাহাজ্যের পতন নিয়ে ঐতিহাসিক মহলে তীব্র বিতর্ক রয়েছে। কোন কোন দরির এই সামালোর পতনের জন্য অশোককে দায়ী করে থাকেন।
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
অশোক কর্তৃক গৃহীত শান্তিবাদী নীতিই মৌর্ঘ সাম্রাজ্যের পতনের জন্য প্রত্যক্ষভাবে হাট, এই নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। পণ্ডিত হ্যাপ্লসান শাস্ত্রীর মতে, সম্রাট অশোক বৌদ্য এমকি বেশি প্রাধান্য দিয়ে তাকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দিয়েছিলেন। ফলে ব্রাহ্মন সম্প্রদায় বৃতমিত্র পুষ্পোর নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করল। অধ্যাপক হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীও বলেছেন, অশোকের শাস্তিনীতি মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল। আমরা এখানে দুই পন্ডিত ব্যক্তির মতামত সংক্ষেপে রেখে আলোচনা করব।
অধ্যাপক শাস্ত্রী তাঁর অভিযোগের স্বপক্ষে যে বৃক্তিগুলির কথা বলেছেন সেগুলি হল-
অশোক পশুবলি নিবিশ করেছিলেন। ফলে যজ্ঞানুষ্ঠানে বাধার সৃষ্টি হয়েছিল। এই ফজই ছিল ব্রাহ্মণদের আয়ের মূল উৎস। ব্রাহ্মণদের মর্যাদা ও ক্ষমতা এখানেই নিহিত ছিল। ভাই তারা অশোকের এই নির্দেশকে সুনজরে দেখেননি। অধ্যাপক রায়চৌধুরী মতে, অশোক পশুবলি নিষিদ্ধ করেছিলেন বলে ব্রাহ্মণরা ক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন একথা জোর দিয়ে বলা যায়। কারণ অশোকেরও পূর্বে বেদ, উপনিষদে ও ব্রাহ্মণ ঋষিরা পশুবলির নিন্দা করেছেন।
অধ্যাপক শাস্ত্রীর দ্বিতীয় যুক্তিটি হল নির্দেশদাতা শূদ্র হওয়ায় ব্রাহ্মণরা এই কাজে বিশেষভাবে ক্ষুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু অধ্যাপক রায়চৌধুরীর মতে, মৌর্যরা যে শূদ্র ছিল একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। অন্যান্য আকর উপাদানে মৌর্যদের বলা হয়েছে ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভূত। শাস্ত্রীর মতে, অশোক ধর্মমহামাত্র নামক কর্মচারী নিয়োগ করে ব্রাহ্মণদের মর্যাদা ধ্বংস করেছিলেন। অধ্যাপক রায়চৌধুরী বলেন, এটি হতেই পারে না, কারণ ধর্মমহামাত্রদের কাজই ছিল ব্রাহ্মণদের অধিকার ও কল্যাণ সুনিশ্চিত করা। তবে অশোকের রাজত্বের শেষদিকে ধর্মমহামাত্রদের ক্ষমতা ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছিল, ফলে তারা জনসাধারণের ভয়ের পাত্র হয়ে উঠেছিল
অধ্যাপক শাস্ত্রীর মতে, বাঁধাধরা কর্তব্য পালন করতে গিয়েই ধর্মমহামাত্ররা বোধহয় বেশিই ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে উঠেছিল। অধ্যাপক শাস্ত্রী আরো বলেছেন, অশোক বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে দন্ডসমতা ও ব্যবহারসমতা নীতি প্রয়োগ করে ব্রাহ্মণদের বিশেষ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেন। অধ্যাপক রায়চৌধুরী এই যুক্তিকে খণ্ডন করেছেন। কারণ একথা জোরের সঙ্গে বলা যায় না, আগে ব্রাহ্মণদের প্রাণদণ্ড দেওয়া হতো না। অশোকের অনুশাসনে প্রায়ই ব্রাহ্মণ ও শ্রমণদের প্রতি শ্রদ্ন্ধা জানানোর কথা বলা হয়েছে।
অধ্যাপক শাস্ত্রীর মতে, অশোকের ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার মতো ক্ষমতা থাকলেও তাঁর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে তা ছিল না। ফলে তাঁর মৃত্যুর পর ব্রাহ্মণদের সঙ্গে তাঁর উত্তরাধিকারীদের বিবাদ ঘটে যার পরিসমাপ্তি ঘটেছিল পুষ্যমিত্র শুঙ্গ কর্তৃক ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে। মনে করা হয় যে, মৌর্যযুগে বৌদ্ধধর্মের প্রসার ব্রাহ্মণ্যবাদী সামাজিক ও ধর্মীয় ইতিনীতিকে ধাক্কা দিয়েছিল। অশোকের ধন্মের কিছু কিছু নীতি যেমন সম্বল ও অন্যান্য উৎসবকে নিষিদ্ধ করা, এই ধরনের ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু এই নীতিতে এমন জোং ছিল না যা মৌর্য রাষ্ট্রকে দূর্বল করতে পারে।
অধ্যাপক রায়চৌধুরী বলেছেন, কলিঙ্গা যুদ্ধের পর শোকাহত অশোক শাস্তিবাদী নীদি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বৃদ্ধনীতির পরিবর্তে ধর্মনীতি গ্রহণ করে। ফলে দীর্ঘদিন ধরে মুখ বে না করায় তাঁর সৈন্যবাহিনী নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। ফলে গ্রিক আক্রমণ প্রতিহত করবার মতো। ক্ষমতা তাদের ছিল না। অন্যান্য পণ্ডিতগণের মতে, অশোক ধর্মবিজয়ের আদর্শ গ্রহণ করলেও প্রশাসন ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রতি সজাগ ছিলেন। তাঁর সীমান্তে অবস্থিত আর্থভিক্ষুকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, প্রয়োজন হলে তিনি তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণও করতে পারেন। তাঁর ধর্মনীতি মৌর্য সাম্রাজ্য ধ্বংসের পথ প্রশস্ত করেছিল কিনা সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে।
অধ্যাপক রাধাগোবিন্দ বসাকের মতে, অশোকের ধম্মনীতি যে সার্বজনীন ছিল তার অনুরণন পাওয়া যাবে তার ধম্মপদের উপাদেশবলীতে। অধ্যাপক রায়চৌধুরী আরে বলেছেন যে, এই অহিংসা নীতির ফলে রাজতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণও শিথিল হয়ে পড়েছিল। ফলে আধিকারিকরা প্রদেশে প্রদেশে নিপীড়ক হয়ে উঠেছিল। এই নীতি অশোকের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকেও ধ্বংস করেছিল। যদিও অনুশাসনগুলিতে এইরকম কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি। কিন্তু অশোকের শাস্তিবাদী নীতিই যে মৌর্য সাম্রাজ্যকে দ্রুত ভাঙনের দিকে নিয়ে গিয়েছিল একথা বলা যায় না। এর জন্য দায়ী ছিল আরো অন্যান্য কারণসমূহ।