ঋকবেদের যুগে অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর
![]() |
ঋগবৈদিক যুগের অর্থনৈতিক জীবন সম্পর্কে লেখো।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য পর্যায় হল ঋবৈদিক যুগ। যা ভারতীয় সভ্যতার অনেকাংশকে সমৃদ্ধ করেছে। এই যুগের বিভিন্ন দিকগুলির মধ্যে এক প্রানতম দিক হল ঋবৈদিক যুগের অর্থনৈতিক জীবন। যার দ্বারা সেই সময়কার সমাজ, চাঁদয়াত্রার মান ও জীবনের মানদণ্ড নির্ধারণের বিষয় জানার ক্ষেত্রে অন্যতম সহায়ক এরিপন্ন হয়। এই অর্থনৈতিক জীবনই আমাদের প্রশ্নের প্রধান আলোচ্য বিষয়।
ঋক্বৈদিক যুগে পশুচারণ ছিল আর্যদের প্রধান জীবিকা । গো-সম্পদ ছিল প্রধান পোদ । ধনী ব্যক্তিকে 'গোমৎ' বলা হত। এই সংহিতায় যুদ্ধের প্রতিশব্দরূপে গবিষ্টি পদের নেহার আছে, পদটির শব্দগত অর্থ গোরুর অনুসন্ধান। গোরুকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন হাগোষ্ঠীগুলির মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ চলত। মূল্যের একক ও বিনিময়ের মাধ্যম ছিল গোরু। গারদে উল্লেখ রয়েছে যে, যমুনা উপত্যকা গোচারণের পক্ষে প্রশস্ত ছিল।
আনকে মনে করেন ঋগ্বেদের যুগে গোধন ব্যক্তি বিশেষের নয়, সমগ্র গোষ্ঠীর মলিকানা ছিল। কিন্তু মনে রাখা দরকার ঋবৈদিক গোমৎ পদটি ব্যক্তি বিশেষের ক্ষেত্রে বযত হয়েছে, গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে নয়। দ্বিতীয়ত, একটি গোরু যাতে অন্যটির সঙ্গে মিশে বয়া সেইজন্য তার কানে বিশেষ চিহ্ন এঁকে দেওয়া হত। যা প্রমাণ করে গোরু বতিমালিকানাধীন ছিল।
চরবৈদিক আর্যরাই ভারতে ঘোড়ার ব্যবহার জনপ্রিয় করে তোলে। পশমের যোগান বলে ভেড়া সে যুগের অর্থনীতির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করত। অন্যান্য পলিত পশুদের মধ্যে ঋব্বেদে ছাগল, গর্দভ ও কুকুরের উল্লেখ আছে। শিকার ও গতরাং যাছে কুকুরকে ব্যবহার করা হত। বিডাল ও মহিষকে পোষ মানানো হয়নি।
ঋব্বেদের যুগে অর্ধ যাযাবর আর্যরা মূলত পশুচারক হলেও তারা যে কিছু কিছু চাষাবাদের কাজ করতেন তার লক্ষণ সুস্পষ্ট। আবাদি জমিকে ঋগবেদে ক্ষেত্র ও উৎৎ বলা হয়েছে। লাঙলকে সীব বলা হয়েছে। জমিতে লাঙলের যে রেখা পড়ে তাকে দীত বলা হয়েছে। ঋবেদে জমিতে হলকর্ষণ, বীজবপন, ফসলকাটা, শস্যমাড়াই এর উল্লেখ আছে। বলদ দিয়ে লাঙল টানা হত। কৃত্রিম জলপ্রণালীকে ঋগবেদে কুল্যা বলা হয়েছে ফসল বাড়ানোর জন্য সার দেওয়া হত। দাত্র বা দা দিয়ে পাকা ফসল কাটা হত।
অনেকে মনে করেন তখনকার সময়ে লাঙলের মুখে লোহার ফলা লাগানো হত। কিন্তু লোহার ব্যবহার সেই যুগে ছিল কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে। ঋগবেদে অয়সব লোহিতায়স নামে এক ধাতুর উল্লেখ আছে। পরবর্তীকালে 'অয়স' বলতে লোহাবের বোঝাত। তবে ঋগবেদে অয়স শব্দটি লোহার প্রতিশব্দ কিনা তা নির্ধারণ করা কঠিন। এমনও হতে পারে যে শব্দটি লাতিন 'nes' বা ব্রোঞ্জের অনুরূপ। সেক্ষেত্রে অয়স বলতে ঋগ্বেদে তামা বা ব্রোঞ্জকে বোঝায়।
ঋগবেদে শস্যের মধ্যে যবের উল্লেখ আছে। এই যুগে যব কোনো এক বিশেষ ফসলের নয়, ফসলমাত্রেই সাধারণ নাম ছিল। তবে ঋগ্বেদে ৫টি স্থানে কৃষিজ ফসল হিসেবে ধানের উল্লেখ আছে। পরবর্তী সবেহিতাদি গ্রন্থে ধান অর্থে ব্রীহি শব্দ ব্যবহার হয়েছে। তবে ঋগ্বেদে ব্রীহির কোনো উল্লেখ নেই।
ঋগবেদের যুগে জমি এজমালি সম্পত্তি ছিল না। ব্যক্তি মালিকানাধীন ছিল তা নিয়েও বিতর্ক আছে। H.C. Roychoudhuri e U. N. Ghosal মনে করেন সে যুগে বাস্তু ও আবাদি জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন ছিল, তবে চারণভূমি ছিল গোষ্ঠীর মালিকানাধীন। তবে D. D. Kosambi-র মতে, জমি ছিল গোষ্ঠীসম্পত্তি, ব্যক্তি মালিকানাধীন নয়।
ঋবৈদিকযুগে শিল্পী কারিগরদের বিকাশের সুযোগ কতটা ছিল তা বলা শক্ত। তবে কিছু কিছু শিল্প যে সে সময় গড়ে উঠেছিল ঋগ্বেদের সাক্ষ্যই তা প্রমাণ করে। এই যুগে দারুশিল্পের বিশেষ চাহিদা ছিল। কাঠুরে, তক্ষক, বসকার-এই তিন শ্রেণির লোক এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
এছাড়া বয়ন শিল্পেরও কদর সে যুগে ছিল। তবে ঋগ্বেদে কার্পাস তৈরি বা সুতিবস্ত্রের স্পষ্ট উল্লেখ নেই। কিন্তু সেখানে তত্ত্ব ও ওতু নামে দুপ্রকার সুতোর উল্লেখ আছে। এছাড়া ধাতুশিল্পের কিছু পরিচয়ও বৈদিক যুগে পাওয়া যায়। ঋগ্বেদে চামড়ার কাজকে চর্মমনা বলা হয়েছে। কুম্ভকারের কাজে কিছু লোকের নিযুক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। শিকার ছিল ঝবৈদিক যুগের একাধারে বিনোদন ও জীবিকার মাধ্যম। কিছু লোক কসাই-এর কাজেও নিযুক্ত ছিলেন। যারা যজ্ঞ অনুষ্ঠানে পশুবলি দিতেন।
অধ্যাপক ম্যাক্সমুলার, ল্যাসেন ও জিমার মনে করেন ঋকবৈদিক আর্যরা সামুদ্রিক ফিকশগ্রহণ করতেন। অল্প হলেও ঋগবেদে বাণিজ্যসংক্রান্ত কিছু তথ্য পাওয়া যায়। কথাটি ঋগবেদে বারংবার ব্যবহৃত হয়েছে। (মাত অরিত্র) (সাত দাঁড়যুক্ত) থানের (নৌ) উল্লেখ ঋগ্বেদে আছে। অধ্যাপক আর্থার ব্যারিডেল কীথ মনে করেন বাবেদ সমুদ্র বলতে সাগর বোঝায় না, বোঝায় সিন্ধু নদের সবিস্তীর্ণ মোহনাকে। কিন্ত পারযানে সিন্ধুকে সমুদ্রগামী বলা হয়েছে।
কররেদের যুগে ধাতবমুদ্রা প্রচলনের কথাও অনেক বলেছেন, তবে তা নিয়ে বিতর্ক জাবেদে যে নিষ্ক-এর উল্লেখ আছে তা স্বর্ণমুদ্রা অর্থে ব্যবহৃত হলেও এর প্রকৃত দিয়ে বিতর্ক লক্ষিত হয়। ঋগ্বেদে ঋণদান ও গ্রহণের উল্লেখ আছে। কিন্তু এই এই দেওয়া চলত দ্রব্যের মাধ্যমে সেখানে টাকাপয়সার ভমিকা ছিল না।
ঋগবেদে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল প্রাথমিক পর্যায়ের। দূর অঞ্চলের সঙ্গে স্থলপথের প্রথমে যোগাযোগ রক্ষা হত। ঋকবেদে অগ্নিকে পথিকৃৎ বলা হয়েছে। যানবাহন বলতে রায় ও গাড়ি। রথ টানত ঘোড়ায় ও গাড়ি টানত বলদ।
এরবৈদিক যুগে দস্যুবর্ণের লোকেদের দাসরূপে ব্যবহার করা হয়েছে। তারা মালিককে রূপশুপালন ও শিল্পের কাজে সাহায্য করতেন। দাসদের মালিকানা নিয়েও অনেক বিতর্ক গোয় হয়। ঋবৈদিক আর্যরা বিভিন্ন পরিবারে বিভক্ত ছিল। দাসেরা সম্ভবত গৃহপতি শরিরের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে গণ্য হতেন।
পরিশেষে বলা যায় যে, উপরিউক্ত আলোচনার ভিত্তিতে ঋবৈদিক যুগের অর্থনীতি নোংশেই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিককে নির্দেশ করেছিল। তবে সঠিক তথ্য প্রমাণ পাওয়া এগেলেও প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ঋবৈদিক যুগের অর্থনীতি বিষয়ে অনেকাংশে ধারণ্য ও করা যায়, যা প্রাচীন ভারতের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করে।
সম্ভাব্য প্রশ্নঃ
- ঋগ্বেদ যুগের আর্যদের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর
- ঋবৈদিক যুগের অর্থনীতিতে পশু সম্পদের ভূমিকা কি ছিল
- ঋবৈদিক যুগে ক্ষুদ্র শিল্পের বিকাশের সম্পর্কে আলোচনা কর
- ঋগবৈদিক যুগের অর্থনীতিতে কৃষিব্যবস্থার ভূমিকা কেমন ছিল