স্কন্ধ্র গুপ্তের কৃতিত্ব ও শাসনের তাৎপর্য আলোচনা কর
স্কন্দগুপ্ত সাধারণত ৪৫৫-৪৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। তবে তাঁর সিংহাসন আরোহণের কাহিনি কিছুটা রহস্যময়। এই প্রসঙ্গে তিনটি মত প্রচলিত। প্রথম যত অনুযায়ী পিতা কুমারগুপ্তের মৃত্যুর পর স্কন্দগুপ্ত সিংহাসনে বসেছিলেন। দ্বিতীয় মত সূযায়ী কুমারগুপ্তের পর মহিষী অনন্ত দেবীর পুত্র সিংহাসনের বৈধ উত্তরাধিকারী প্রযুপ্তকে পরাজিত করে স্কন্দগুপ্ত সিংহাসনে আরোহণ করেন। তৃতীয় মত অনুযায়ী কুমার পুপ্তের মৃত্যুর পর অল্পদিনের জন্য হলেও কচ সর্বোৎ সিংহাসনে বসেছিলেন ৷
![]() |
সিংহাসন আরোহন Source:wikipedia |
তাঁর রাজত্বকালে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল হুন আক্রমণ প্রতিহত করা। এইসময় মধ্য এশিয়া থেকে আগত নিষ্ঠুর দুর্ধর্ষ হুনদের একটি অংশ হিন্দুকুশ পর্বতমালা অতিক্রম করে যত গান্ধারে প্রবেশ করে । তারা ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে গপ্ত সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা চরমভাবে বিঘ্নিত হয়। স্কন্দগুপ্ত তাদের বিরদ্ধে অগ্রসর হন এবং শেষে তাদের এমন চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন যে, পরবর্তী ৫০ বছরের মধ্যে হনরা আর গুপ্তসাম্রাজ্য অক্রমণে সাহসী হয়নি। দর্ধর্ষ হনদের বিরদ্ধে তাঁর সাফল্যের জন্য ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার তাকে 'ভারতের রক্ষাকারী' বলে অভিহিত করেন।
হুন আক্রমনের প্রমান :- ( image sources : Wikipedia )
স্কন্দগুপ্তের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব ছিল পুষ্যমিত্র জাতির আক্রমণে বিষংস্ত খুপ্ত সাম্রাজ্যের পুনগঠিন এবং যে সকল স্থান সাম্রাজ্যচ্যুত হয়েছিল সেগুলির পুনরুত্থান। স্কন্দগুপ্তের হাতে হুনদের পরাজয় তাদেরকে পূর্ব ইউরোপের দিকে অগ্রসর হতে বাধা করেছিল। শুধু তাই নয় স্কন্দগুপ্ত কর্তৃক খুন আক্রমণ প্রতিহত করার ফল হিসেবে তার পূর্ব ইউরোপের দিকে চাপ সৃষ্টি করে কিন্তু পুনরায় তারা ভারতের দিকে অগ্রসর হয় এবং পাঞ্জাবে প্রবেশ করতে সমর্থ হয়। তখন হুনশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
'ভিটারি লেখ' থেকে জানা যায় যে, স্কন্দগুপ্তের রাজত্বকালে হুনগণ গুপ্তসাম্রাজ্য আক্রমণ করেছিল। লেখটি তারিখবিহীন হওয়ায় এই চুন আক্রমণ কোন্ সময় হয়েছিল তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যায় না। জুনাগড় লেখতে বলা হয়েছে যে, ম্লেচ্ছ দেশীয় শত্রুগণ তার কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছে। এই মেচ্ছগণই ভিটারি লেখর উল্লেখিত হুনগণ। এই মতকে সঠিকভাবে ধরে নিলে বলা হয় যে, স্কন্দগুপ্তের রাজত্বকালের প্রথমদিকেই হুন আক্রমণের ঘটনাটি ঘটেছিল। কারণ জুনাগড় লেখতে তারিখ ছিল ৪৫৬-৪৫৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে, কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে বিশাল ও শক্তিশালী অংশই ইউরোপে ও পারস্যে তাদের অন্তর্লীলা চালাতে ব্যস্ত ছিল।
সুবীর চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ভারতে যে চুনগণ প্রবেশ করেছিল, তারা ছিল সমুদ্রস্বরূণ তুন শক্তির একটি তরঙ্গমাত্র। তাছাড়া গুপ্তসন্ডাটগণ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের সঠিক সুরক্ষার ব্যবস্থাপনা করলেও পর্বতমালার পরিস্থিতি প্রাকৃতিক রক্ষাকবজের কাজ করেছিল। প্রাকৃতিক বাধা অতিক্রম করে হুনবাহিনী যখন ভারতে এসে পৌঁছেছিল, তখন তারা অনেকটাই হীনবল হয়ে পড়েছিল।
বালরাফাট লিপিতে উল্লেখ করা আছে যে, বাকটিক রাজা নরেন্দ্রসেন স্থানীয় সামন্তদের সমর্থন লাভ করে কোশল, মেকল, মালব প্রভৃতি অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল। এই অঞ্চল স্কন্দগুপ্তের সাম্রাজ্যভুক্ত থাকলেও বাকাটক রাজ্যের প্রভাব বিস্তার আর একটি কঠিন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেটা জুনাগড় শিলালিপি থেকে জানা যায়। স্কন্দগুপ্তের রাজত্বকালের পর সৌরাষ্ট্র, মালব, গুজরাট প্রভৃতি অঞ্চল গুপ্তসাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। স্কন্দগুপ্তের রাজত্বকালের শেষদিকে কোনো যুদ্ধবিগ্রহের প্রয়োজন হয়নি। তাঁর আমলে গুপ্ত শাসনব্যবস্থার দক্ষতা অক্ষুণ্ণ ছিল। 'আর্যমঞ্জুশ্রী মূলকল্পে' উল্লেখ আছে যে, স্কন্দগুপ্ত একটি শ্রেষ্ঠন্যায় নীতিসম্পন্ন নিরপেক্ষ বিচারক ছিলেন।
স্কন্দগুপ্ত নিজে বৈস্তুব ধর্মাবলম্বী ছিলেন কিন্তু তিনিও তাঁর পূর্বপুরুষদের মতো ধর্ম সহিহ্বতার নীতি অনুসরণ করে চলতেন। বিহার স্তম্ভলিপি থেকে জানা যায় যে, স্কন্দগুপ্ত কতকগুলি মন্দির বৃত্তের আকারে পর পর সাজিয়ে নির্মাণ করেছিলেন। এগুলি ছিল চন্ডী বৈল্পবী, চামুণ্ডা, মহেশ্বরী প্রভৃতি দেবদেবীর মন্দির। তাঁর রাজত্বকালে দুজন বণিক সূর্যদেবতার দুটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।
সুশাসক হিসেবেই স্কন্দগুপ্ত ছিলেন যথেষ্ট কৃতিত্বের অধিকারী। কৃষির উন্নতির জন সংস্কারসাধন করেন। জুনাগড় লেখতে বলা হয়েছে তাঁর রাজত্বকালে একটি প্রজাও ধর্মতই হয়নি ৷ আয়াপীড়িত এমনকি দন্ডিত ব্যক্তিও যাতে তাঁর রাজত্বকালে অত্যন্ত পীড়িত না হয় লেখা হত। হিউয়েন সাঙ লিখেছেন, স্কন্দগুপ্ত নালন্দায় একটি বিয়ার নির্মাণ করেছিলেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, তিনি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গো যুক্ত ছিলেন। তাঁর পাপোষকতায় বৌদ্ধধর্ম ও বিদ্যার যথেষ্ট প্রসারলাভ করেছিল। চিন সম্রাটদের কাছে দুত এমে তিনি চিনদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করেন।