প্রাচীন ভারতের দাস ব্যবস্থা ছিল কি? বা, প্রাচীন ভারতে দাসপ্রথা সম্পর্কে লেখো।

প্রাচীন ভারতের দাস ব্যবস্থা ছিল কি?

 প্রাচীন ভারতের দাস ব্যবস্থা ছিল কি? বা, প্রাচীন ভারতে দাসপ্রথা সম্পর্কে লেখো।

প্রাচীন ভারতের দাস ব্যবস্থা ছিল কি

প্রাচীন যুগ থেকে ভারতীয় সমাজে ক্রীতদাস প্রথা সামাজিক একটি সংস্থারূপেই স্বীকৃতি লাভ করে। স্মৃতিশাস্ত্রকারগণ শুধুমাত্র বিভিন্ন শ্রেণির ক্রীতদাসদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করেই তাদের কর্তব্য সমাধা করেননি, বিভিন্ন শ্রেণির ক্রীতদাসদেন সামাজিক মর্যাদার মধ্যেও পার্থক্য নির্দেশ করেন। মনু ও নারদ কী কী কারণে ক্রীতদাসে পরিণত হয় সে সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করেন। তাঁদের মতে, প্রভুর গৃহজাত সন্তান ছাড়াও অর্থের বিনিময়ে সংগৃহীত ব্যক্তি, দান হিসেবে প্রাপ্ত ব্যক্তি, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ব্যক্তি, দুর্ভিক্ষের সময় অন্যের দ্বারা প্রতিপালিত ব্যক্তি, ঋণ পরিশোধে অক্ষম ব্যক্তি, যুদ্ধবন্দি ক্রীতদাসরূপে আত্মসমর্পণকারী ব্যক্তি, সন্ন্যাস আশ্রম থেকে পতিত ব্যক্তি এবং ক্রীতদাসীর সঙ্গে বৈধ ও অবৈধভাবে বিবাহিত ব্যক্তি ক্রীতদাসে পরিণত হত।


গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাব ও ধর্মপ্রচারের পরেও ভারতীয় সমাজ থেকে ক্রীতদাস প্রথা বন্ধ হয়নি। অথবা তাদের অবস্থানও বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি। ধনীদের গৃহে সাধারণত গৃহস্থালির অনেক কাজের দায়িত্বই ক্রীতদাস শ্রেণির ভৃত্যদের ওপর অর্পণ কর হত ৷ ক্রীতদাস প্রভু উভয়ের স্বভাবের ওপরই সাধারণত পারস্পরিক সম্পর্ক এবং প্রভুর কাজ থকে ক্রীতদাসমণ কীরপ ব্যবহার লাভ করবে তাও স্থির হত। জাতকে বর্ণিত আছে তেজ ও পার্শ্বচর হিসেবে কাজ করা ছাড়াও ক্রীতদাসদের লেখাপড়া ও হাতের কাজ দিখতে হতো। তবে জাতকে জনৈত ক্রীতদাসদের উক্তি থেকে জানা যায় যে, প্রভুর কাজে অবহেলা দেখালে প্রহার, নির্যাতন, বন্দিত্ব, অনাহার, এমনকি ক্রীতদাসরূপে পুনরায় বাজারে বিক্রি সবই হতে পারে।


কৌটিল্য 'অর্থশাস্ত্রে' বলেন যে, ভরণপোষণের জন্য অনেক ব্যক্তি দাসে পরিণত হয়। কিছু অপর কোনো ব্যক্তি যদি বলপূর্বক ও অন্যায়ভাবে কোনো ব্যক্তিকে অপরের কাছে জিা করে তা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে এবং বিক্রয়কারী শাস্তি লাভ করবে। কৌটিল্য বলেন যে, নাবালক শুদ্রকে যদি কোনো স্বজন অন্যের কাছে বিক্রয় করে বা বন্ধক রাখে ভজলে সেই স্বজনের ১২ পন দণ্ড হবে। সেই প্রকার কোনো বৈশ্যকে এইভাবে বিক্রি করলে অথবা বন্ধক রাখলে সেই স্বজনের ২৪ পন দণ্ড হবে। আবার কোনো ক্ষত্রিয়কে বন্ধক রাখলেও ৩৬ পণ দন্ড হবে। কোনো ব্রাহ্মণ্যক বিক্রয় করলে ৪৮ পন দণ্ড হবে। ক্রিয়কারী ব্যক্তিস্বজন না হয়ে পরজন হলে তার ওপর প্রথম, মধ্যম বা উত্তম সাহস দণ্ড কিংবা বর্ষ দণ্ড বিহিত হবে।


কৌটিল্যের মতে, ম্লেচ্ছ অর্থাৎ, অনার্য জাতির লোক নিজের সন্তান বিক্রয় করলে বা বখত রাখলে তার কোনো দোষ হবে না। কিন্তু আর্যজন দাসে পরিণত হতে পারে না। কিন্তু স্বকূলের বন্ধনপ্রাপ্তির সম্ভাবনায় অথবা বহুসংখ্যক আর্যের একই সঙ্গে আপদ উপস্থিত হলে আর্যগণকে বন্ধক রাখা যেতে পারে। কিন্তু বন্ধক থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করে প্রথমে নিজেকে এবং পরে অপর সকলকে দাসত্ব থেকে অব্যাহতি লাভের ব্যবস্থা করতে হবে। যে-কোনো আর্য ব্যক্তি নিজেকে বিক্রয় করলেও তার সন্তানকে আর্য বলে স্বীকৃতি দিতে হবে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ও মৌর্যযুগের দাসপ্রথা থেকে যেসব তথ্য জানা যায় তা থেকে নিঃসন্দেহে মনে করা যেতে পারে যে, দাস বা ক্রীতদাস প্রথা সেই যুগে একটি সুসংগঠিত সংস্থারূপে গড়ে উঠেছিল।


প্রচুর হাত থেকে দাসদের স্বার্থরক্ষা এবং দাসদের মুক্তিলাভের উপায় সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যবস্থা বিধিবদ্ধ করা হয়। সম্ভবত এইসব আইন ও অনুশাসনের ফলে দাসগণ প্রভুদের কাছ থেকে সৎ ব্যবহার লাভের সুযোগ পেতে সমর্থ হয়। মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকেও এই অভিমাত সমর্থিত হয়। কারণ সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের রাজসভায় গ্রিকদূত মেগাস্থিনিস বলেন যে, ভারতে দাসপ্রথার অস্তিত্ব ছিল না। সকল ভারতীয় ছিল স্বাধীন। দেশের মানুষদের কথা দূরে থাকুক, বিদেশীদেরও তারা দাসত্বে নিযুক্ত করত না।


ঐতিহাসিক রোমিলা থাপার এ সম্পর্কে বলেন যে, মেগাস্থিনিস লিখেছেন ভারতে পাব দাসপ্রথা ছিল না। ভারতীয় সুত্রে দেখা যায় যে, এই ধারণা ঠিক নয়। ধনীগৃহে ক্রীতদামে থাকাই সাধারণ রীতি ছিল। এইসব ক্রীতদাসরা নিম্নবর্ণের হলেও অস্পৃশ্য শ্রেণির ছিলনা।


খনির কাজে এবং সমবায় সংঘগুলির দ্বারাও ক্রীতদাস ব্যবহৃত হত। মনু ও নারদ এবং যাজ্ঞবন্ধা ক্রীতদাস প্রথা সম্পর্কে বিশদ বিবরণ দেন। নারদ ক্রীতদাসদের জন্য অপবিত্র কার্য সম্পাদনের নির্দেশ দেন। কিন্তু স্মৃতিশাস্ত্র অনুযায়ী ক্রীতদাস অনেক সুযোগ-সুবিধা লাভের অধিকারী। এমনকি ক্রীতদাসদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জন করার অধিকারও স্বীকৃত।


কিন্তু মন ক্রীতদাসদের সম্পর্কে খুব কঠোর মনোভাবের পরিচয় দেন। তাঁর মতে, তার ব্যক্তিগত সম্পত্তির অথবা নিতান্ত প্রয়োজন না হলে বিচারালয়ে সাক্ষ্যদানের অধিকার ভোগ করবে না। অপরদিকে ক্রীতদাসদের মুক্তি সম্পর্কে নারদ ও যাজ্ঞবন্ধ্য উভয়েই খব উদার মত পোষণ করেন। তাঁদের মতে, প্রভুর জীবনরক্ষাকারী ক্রীতদাস অতি অবিলম্বে মুক্তিলাভের অধিকার ভোগকারী এবং প্রভুর পুত্রের মতো তার সম্পত্তির অধিকারী হয়। তাছাড়া অর্থলোলুপ দস্যু বা আত্মীয়স্বজনের দ্বারা বলপূর্বক ক্রীতদাসে পরিণত ব্যক্তিরা আইনসম্মতভাবেই হৃত স্বাধীনতা পুনরায় উদ্ধার করার সুযোগ ভোগ করে।


কাত্যায়ন বলেন যে, ব্রাহ্মণ কখনো ক্রীতদাসে পরিণত হতে পারে না। ব্রাহ্মণ জাতির নারী ক্রয়-বিক্রয় কোনোমতেই আইনসিদ্ধ নয়। কাত্যায়ন ব্রাহ্মণ বর্ণের লোকেদের পূর্ব মর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। কারণ বৌদ্ধধর্মের প্রভাবের ফলে ইতিমধ্যে সমাজে ব্রাহ্মণদের মর্যাদা যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস পায়। সুতরাং, কাত্যায়ন নতুন বিধি প্রচার করে নিয়ে সমাজচ্যুত ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য সন্ন্যাসী ক্রীতদাসে পরিণত হলেও সমাজচ্যুত ব্রাহ্মণ, সন্ন্যাসী ক্রীতদাস হওয়ার পরিবর্তে দেশ থেকে নির্বাসিত হবে। স্বাধীন নারী ক্রীতদাসকে বিবাহ করলে দাসীতে পরিণত হয়। কিন্তু দাস নারী প্রভুর সন্তান গর্ভে ধারণ করলে দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন নারী হিসেবে পরিণত হয়।


মনু, নারদ ও যাজ্ঞবন্ধ্যের অভিমত থেকে বোঝা যায় যে, কালের গতির সঙ্গে সঙ্গে। দাসত্ব প্রথা সম্পর্কে প্রচলিত রীতিনীতির পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দেয় এবং আইন প্রণেতাগণ সামাজিক ভারসাম্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে প্রচলিত আইন সংশোধন করেন। এইসব সংশোধনের ফলে একমাত্র ক্রীতদাসে পরিণত সমাজ পতিত সন্ন্যাসী ব্যতীত অবশিষ্ট সকল প্রকারের ক্রীতদাসই স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করার সুযোগ পেত। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে, স্থিতিশীল ভারতীয় সমাজে প্রাচীনকালে অনেক সময় সামান্যভাবে পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিত। বিশেষত বিদেশিদের অনুপ্রবেশের ফলে এবং বর্ণপ্রথা ও সমাজের ভিত্তি অপরিবর্তিত রেখে এই সমাজে নতুন লোকেদের স্থান নির্দিষ্ট করার প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে অনুভূত হয়। 



গুপ্ত বংশের পতনের উপর ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আঞ্চলিক শক্তির উদ্ভব হওয়ার ফলে সামাজিক ক্ষেত্রে তার বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় ৷ অপরদিকে বহিরাগত বিভিন্ন জাতি স্থায়ীভাবে ভারতে বসবাস করতে শুরু করে এবং তাদের বহু রীতি নীতি ভারতীয়দের সমাজে ও অনুপ্রবেশ করে ৷ ফলে একদিকে যেমন বন্যাশ্রম প্রথার ভাঙ্গন দেখা দেয়, অপরদিকেও চিরাচরিত সামাজিক সংস্থাগুলি দ্রুত পরিবর্তন সাধিত হয় ফলে দাস প্রথার নিয়ম নীতির ক্ষেত্রে পরিবর্তন দেখা দেয়। পরিবর্তনশীল সমাজ ব্যবস্থায় দাস দের অবস্থান পূর্বের থেকে উত্তরণ ঘটে ৷ ৷

About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟