দিল্লি সুলতানির পতনে ফিরুোজ শাহ তুঘলকের দায়িত্ব কতখানি ছিল
সুলতান ফিরুজ তুঘলকের দীর্ঘ শাসনকালে (১৩৫১-৮৮) দিল্লি সুলতানি রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সুলতানের মৃত্যুর আগে থেকে (১৩৮৮) সুলতানি রাজ্য ভাঙতে শুরু করেছিল। সুলতানের জ্যেষ্ঠ পুত্র মুহম্মদ ও তাঁর উজির দ্বিতীয় খান জাহানের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ শুরু হয়েছিল। মুহম্মদ তাঁর পিতাকে স্বপক্ষে টানতে সক্ষম হন, যান জাহান ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য হন। ফিরুজ যুবরাজকে তাঁর এ শাসনের সঙ্গে যুক্ত করেন এবং কার্যত তিনি যুগ্ম শাসক হিসেবে কাজ করতে ভাব থাকেন। ফিরুজের লক্ষাধিক ক্রীতদাস যুবরাজ মনোনয়ন মেনে নেয়নি, মুহম্মদ তাদের পছন্দের রাজপুত্র ছিল না। রাজপুত্র মুহম্মদের সঙ্গে ফিরুজের ক্রীতদাসদের ক্ষমতার স্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল। এই অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ফিরুজ অবিবেচকের মতো ক্রীতদাসদের পক্ষ নেন, রাজপুত্র মুহম্মদ ক্ষমতাচ্যুত হন। ১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দে ফিরুজের মৃত্যু হলে প্রভাবশালী ক্রীতদাসর। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে মেতেছিল, সিংহাসন নিয়ে ফিরুজের পুত্র ও. পৌত্ররা সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল। ক্রীতদাসরা ক্ষমতার নিয়ামক হতে চেয়েছিল (king maker)। একের পর এক রাজপুত্র সিংহাসনে বসলেন ও ক্ষমতাচ্যুত হলেন। ১৩৯৪ খ্রিস্টাব্দে নাসিরুদ্দিন মাহমুদ ক্ষমতা দখল করেন, তুঘলক বংশের শেষ অবধি তিনি ক্ষমতায় ছিলেন (১৪১২)।
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
কেন্দ্রে উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব চলাকালীন (১৩৮৮-৯৪) প্রাদেশিক শাসকরা স্বাধীন হয়ে যান। গুজরাটের শাসক প্রথম বিদ্রোহ করে স্বাধীন হন, পাঞ্জাবের খোক্কররা এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেন, মালব ও খান্দেশ স্বাধীন হয়েছিল। বাংলা, বিজয়নগর ও বাহমনি রাজ্য আগেই স্বাধীন হয়েছিল। নাসিরুদ্দিন মাহমুদের উজির খাজা জাহান কনৌজ থেকে বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল শাসনের অধিকার লাভ করেন। জৌনপুর সুলতানির প্রতিষ্ঠা হয়। শুধু তাই নয়, দিল্লি সুলতানির অধীনস্থ হিন্দু সর্দাররা রাজস্ব দেওয়া বন্ধ করেন। সমকালীন মানুষ কৌতুক করে বলতে থাকে জাঁহাপনার সাম্রাজ্য হলো দিল্লি থেকে পালাম। দিল্লি সুলতানি রাজধানী দিল্লি ও তার আশপাশের অঞ্চলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল।
দিল্লি সুলতানি শাসনের ওপর চরম আঘাত হেনেছিলেন তৈমুর লঙ্। ১৩৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দে সমরকন্দের শাসক তৈমূর দিল্লি ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বীভৎস তাণ্ডব চালিয়েছিলেন। তৈমুরের পৌত্র উছ ও দিপালপুর জয় করেন ১৩৯৬-৯৭ খ্রিস্টাব্দে, মূলতান অবরোধ করেছিলেন। দিল্লির তুঘলক বংশীয় শাসকরা এর বিরুদ্ধে কোনো সামরিক ব্যবস্থা নেননি, তৈমুরকে বাধাদানের কোনো সামরিক প্রস্তুতি ছিল না। তৈমুর শুধু হত্যা ও ধ্বংস চালাননি, বহু সম্পদ ও এদেশের কারিগর ও শিল্পীদের নিজের দেশে নিয়ে যান। লাহোর, দিপালপুর ও মুলতান তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত করে নেন। দিল্লি সুলতানির অন্তঃসারশূন্যতা সকলের কাছে প্রকট হয়ে পড়ে। তৈমুরের অনায়াসে ভারত জয় বাবরকে ভারত জয়ে উৎসাহ জুগিয়েছিল, বাবর তৈমুরের উত্তরাধিকারী হিসেবে ভারতবর্ষ দাবি করেন।
অধ্যাপক সতীশচন্দ্র মনে করেন যে, কোনো সুলতানকে ব্যাক্তিগতভাবে সুলতানি শাসনের পতনের জন্য দায়ী করা ঠিক নয়। আর্থ-সামাজিক ও প্রশাসনিক কারণে সুলতানি রাষ্ট্রের পতন ঘটেছিল। মধ্যযুগের ভারতে আঞ্চলিক ও বিচ্ছিন্নতাকামী শক্তিগুলি সক্রিয় ছিল, ভারতের সর্বত্র বহু স্থানীয় প্রধান ছিলেন। কোনো বিশেষ অঞ্চলে এদের ক্ষমতার কেন্দ্র ছিল বা এরা কোনো জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। কেন্দ্রীয় শাসন দুর্বল হলে এরা বিদ্রোহের পতাকা তুলতেন, স্বাধীন হবার চেষ্টা করতেন। তুর্কি সুলতানরা দুভাবে এই বিচ্ছিন্নতাকামী প্রবণতা রোধ করার চেষ্টা করেন। নিজেদের ব্যক্তিগত ক্রীতদাস বাহিনী গঠন করে এবং অনুগত, নির্ভরশীল অভিজাততন্ত্র স্থাপন করে। ইক্কা ব্যবস্থার মাধ্যমে এই অভিজাততন্ত্র গঠন করা হয়। কিন্তু তুর্কি অভিজাতরা সংখ্যায় নগণ্য হলেও ছিল প্রভাবশালী এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী। এরা সুযোগ পেলেই স্বাধীন ক্ষমতাকেন্দ্র গড়ে তোলার চেষ্টা করত। কেন্দ্রের সুলতানি শাসন দূরবর্তী প্রদেশ বাংলা, সিন্ধু, গুজরাট ও দৌলতাবাদের ওপর যথাযথ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারেনি। বলবন জাতিগোষ্ঠী নির্ভর (তুর্কি) অভিজাততন্ত্র গঠন করে ক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করতে চেয়েছিলেন। আলাউদ্দিন সব গোষ্ঠীকে নিয়ে অভিজাততন্ত্রের মধ্যে ভারসাম্য গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। গুপ্তচর ব্যবস্থা ছিল তাঁর সহায়ক। মহম্মদ বিন তুঘলক আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে দেশী- বিদেশী সর্বস্তরের লোক নিয়ে অভিজাততন্ত্র গঠন করেন। ফিরুজ তুঘলক বংশানুক্রমিক ক্ষুদ্র অভিজাততন্ত্র গঠন করে এদের নিয়ন্ত্রণের প্রয়াস চালিয়েছিলেন। কিন্তু কেউই সম্পূর্ণ সাফল্য লাভ করেননি, সুলতানরা অভিজাতদের কাছ থেকে নিঃশর্ত আনুগত্য ও সেবা পাননি।
অভিজাতনির্ভর শাসনব্যবস্থায় ধর্ম বিশেষ সহায়ক ছিল না। সুলতানি রাজ্য দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবার পর হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে মৌল বিরোধ ছিল না। ক্ষমতার ব্য ছিল মুসলমানদের মধ্যে। হিন্দু রাজাদের বিরুদ্ধে ধর্মের জিগির তোলা হতো তাদের সম্পদ লুঠ করার জন্য, কৃষকরাও অব্যাহতি পেত না। সুলতানি শাসকদের একটি বড় সমস্যা ছিল সৈন্যবাহিনীর গঠন। মোঙ্গল আক্রমণের ফলে মধ্য এশিয়া থেকে অভিবাসন বন্ধ হলে তুর্কিদের প্রাধান্য কমে যায়। সুলতানরা আফগান, তুর্তি বংশধর, মোঙ্গল, ভারতীয় ধর্মান্তরিত মুসলমান এবং হিন্দুদের সৈন্যবাহিনীতে গ্রহণ করেন। এইসব জাতিগোষ্ঠীর সৈন্যদের নিজস্ব সমস্যা ছিল। ফিরুজ তাঁর সৈন্যবাহিনীতে বংশানুক্রমিক নীতি প্রবর্তন করেন, তুর্কি ও মোঙ্গলদের প্রাধান্য দেন। তাঁর ক্রীতদাসদের মধ্যে ভারতীয় ধর্মান্তরিত মুসলমানদের স্থান দেন। তাঁর এইসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা সফল হয়নি। তাঁর বংশানুক্রমিক সৈন্যরা দক্ষ ছিল না, তাঁর দাসবাহিনী ছিল স্বার্থপর ওঅবাধ্য। অভিজাত, সৈন্যবাহিনী ও ক্রীতদাসরা পরস্পরের প্রতি শত্রুতার মনোভার পোষণ করত, এদের মধ্যে সম্ভাব ছিল না।
সুলতানের আরও একটি বড় সমস্যা ছিল। দিল্লি সুলতানির কোনো নির্দিষ্ট উত্তরাধিকার নীতি ছিল না, জ্যেষ্ঠ পুত্রের উত্তরাধিকার সকলে মানতো না। সুলতানের মনোনীত ব্যক্তিকে অভিজাতরা মেনে নিতে রাজী হলেও রাজপরিবারের মধ্যে বিরোধিতা দেখা দিত। রাজিয়ার সময় এরকম পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। রাজপুত্রদের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে লড়াই শুরু হলে অভিজাতরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাতে জড়িয়ে পড়তেন। ক্রীতদাস বাহিনী ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছিল, ক্ষমতা দখলের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছিল। ফিরুজ তুঘলকের জীবনের শেষপর্বে এরকম পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। ক্রীতদাসরা কিছুকাল রাজপুত্রদের ক্রীড়নক করে রেখেছিল।