প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।
ভারতে সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশের ফলশ্রুতিতে জন্ম নেয় সশস্ত্র বৈপ্লবিক আন্দোলন। ভারতে বৈপ্লবিক আন্দোলন মহারাষ্ট্রে শুরু হলেও বাংলাতেই এর ব্যাপকতা ছিল সর্বাধিক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকাল পর্যন্ত সময়ে বাংলার বিপ্লবীদের কর্মধারাকে দুটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্যায় বিংশ শতকের শুরু থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় পর্যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়কাল পর্যন্ত।
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
প্রথম পর্যায়ের বিপ্লবী কার্যকলাপঃ
বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে বিভিন্ন গুপ্ত সমিতি গড়ে উঠেছিল। ১৯০২ খ্রিঃ মেদিনীপুরে জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু একটি গুপ্ত বিপ্লবী সমিতি গঠন করেন। একই সময়ে কলকাতায় সতীশচন্দ্র বসু 'অনুশীলন সমিতি' গঠন করেন। এর সভাপতি ছিলেন ব্যারিস্টার প্রমথ মিত্র। এই সমিতির সদস্যরা ব্যায়াম, কুস্তি, লাঠি চালনা, মুষ্টিযুদ্ধ, অশ্বারোহন প্রভৃতির প্রশিক্ষণ গ্রহণ করত। বাংলার বিপ্লবীদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে বরোদা থেকে অরবিন্দ ঘোষ যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাঠান।
পরবর্তীকালে শ্রী অরবিন্দের ভাই বারীন্দ্রকুমার ঘোষ বাংলায় এসে বিপ্লবীদের সংগঠিত করেন। ১৯০৬ সালে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, ভূপেন্দ্রদত্ত 'যুগান্তর' গোষ্ঠী গঠন করে এবং 'যুগান্তর' পত্রিকার মাধ্যমে বিপ্লবী মতবাদ প্রচার করেন। এছাড়া এই সময়ে বাংলার বিভিন্ন স্থানে এই সমিতিগুলির শাখা ও এদের অনুকরণে বিভিন্ন গুপ্ত সমিতি গড়ে ওঠে। ১৯০৬ খ্রিঃ পূর্ববঙ্গে স্থাপিত হয় ঢাকার অনুশীলন সমিতি, যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন পুলিন বিহারী দাস। এই সমিতির প্রায় ৫০০টি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
১৯০৭ সালে ডিসেম্বরে সর্বপ্রথম বাংলায় বিপ্লবীরা গুপ্ত হত্যার চেষ্টা চালায়। তাঁরা পূর্ব বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলারকে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এদিকে হেমচন্দ্র কানুনগো প্যারিস থেকে বোমা তৈরীর কৌশল শিখে এলে তাঁকে ঘিরে বারীরন্দ্রকুমার ঘোছ, উল্লাসকর দত্ত প্রমুখ মানিকতলার নিকট মুরারীপুকুরে বোমা তৈরীর কারখানা স্থাপন করেন। এরপর তাঁরা অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট হত্যার দায়িত্ব দিয়ে ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী নামে যুগান্তর গোষ্ঠীর দুই তরুনকে মজঃফরপুর পাঠান। ১৯০৮ সালে ৩০ এপ্রিল তারা ভুল করে অনা গাড়িতে বোমা নিক্ষেপ করলে দুইজন ইংরেজ নিরপরাধ মহিলা মিসেস কেনেডি ও মিস কেনেডি মারা যান। প্রফুল্ল চাকী নিজের গুলির দ্বারা আত্মহত্যা করেন। ক্ষুদিরাম ধরা পরেন এবং বিচারে তাঁর ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ফাঁসি হয়। তাঁদের আত্মদান বিপ্লবীদের মধ্যে অনুপ্রেরণার সঞ্চার করে।
এই কিংসফোর্ডকে হত্যার চেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিৎ ব্যাপক তল্লাশী চালায়। শীঘ্রই পুলিশ মুরারীপুকুরে বোমার কারখানা আবিষ্কার করে বছ তাজা বোমা ও অন্যান্য বিস্ফোরক দ্রব্য আটক করে। এরপর বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, অরবিন্দ সহ মোট ৩৬ জন বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯০৮ সালে শুরু হয় আলিপুর বোমা মামলা। নরেন গোঁসাই নামে এক দুর্বলচিত্ত বিপ্লবী রাজসাক্ষী হওয়ায় জেলের মধ্যেই সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও কানাইলাল দত্ত নামে দুই বিপ্লবী তাঁকে হত্যা করেন। বিচারে কানাইলাল ও সত্যেন্দ্রনাথের ফাঁসি হয়। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের প্রচেষ্টায় অরবিন্দ মুক্তি পান। তবে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ও উল্লাসকর দত্তের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়।
এরপর বৈপ্লবিক আন্দোলনে কিছুটা ভাটা পড়ে। ১৯০৯ খ্রিঃ 'যুগান্তর' ও 'অনুশীলন সমিতি' নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯০৮ খ্রিঃ পর বাংলায় বৈপ্লবিক আন্দোলনে প্রকৃতিগত কিছু পরিবর্তন দেখা দেয়। এককভাবে সন্ত্রাসের চেষ্টা ছেড়ে দলবদ্ধ সশস্ত্র প্রতিরোধ গঠনের প্রবণতা দেখা যায়। তাঁরা যুবক, কৃষক, শ্রমিক ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সম্মিলিত শক্তির ওপর গুরুত্ব আরোপ করে।
দ্বিতীয় পর্যায়ের বৈপ্লবিক কার্যকলাপঃ
বাংলার বৈপ্লবিক আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ওরফে বাঘাযতীন, নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ওরফে মানবেন্দ্রনাথ রায় প্রমুখ। ১৯১৪ সালের ৬ আগস্ট যতীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে কলকাতার অস্ত্র ব্যবসায়ী রম আঅ্যান্ড কোম্পানীর দোকান থেকে বিপ্লবীরা ৫০টি পিস্তল ও ৪৬০০০ কার্তুজ ফুট করেন। এরপর জার্মানী থেকে বিপ্লবীরা অস্ত্র আনার ব্যবস্থা করেন। সেই ছয়ে মাভেরিক, অ্যানি লার্সেন ও হেনরি এস নামে তিনটি জাহাজে করে অস্ত্র পাঠানো হলে তা সুন্দরবনের রায়মঙ্গল, ওড়িশার বালেশ্বর ও হাতিয়ায় নামানোর ব্যবস্থা করা হয়।
বাঘা যতীন ও তার চার সঙ্গী জ্যোতিষ পাল, চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, মনোরঞ্জন দেনগত ও নীরেন দাশগুপ্ত বালেশ্বরে পৌঁছোন মাভেরিক জাহাজ থেকে অস্ত্র সংগ্রহের জন চিপা ইংরেজরা বিপ্লবীদের পরিকল্পনা জেনে ফেললে ইংএজ পুলিশ কমিশনার জেনি টেগার্ট বালেশ্বরে বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে পৌঁছলে বিপ্লবীদের সাথে তাদের কুট্টীরালাল উইনে ১৯১৫ সালে ১ সেপ্টেম্বর প্রবল যুদ্ধ হয়। চিত্তপ্রিয় ঘটনাস্থলে এবং বাঘাযতীন পরদিন হাসপাতালে মারা যান। জ্যোতিষ পালের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয় এল অন্যান্যাদের ফাঁসি দেওয়া হয়। বুড়িবালামের যুদ্ধ নামে পরিচিত এই সংগ্রাম বাংলা তথ্যা ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনের একটি স্মরণীয় অধ্যায়।
বুড়িবালামের যুদ্ধের পর বাংলার বৈপ্লবিক তৎপরতা সাময়িকভাবে স্তিমিত হয়ে পড়ে। ইংরেজ সরকার ও প্রভৃতি আইন পাশ করে বিপ্লবী কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করলে এবং সন্দেহের বশে বহু যুবককে গ্রেপ্তার করলে বিপ্লবী আন্দোলনের তৎপরতা কিছুকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। দেশমাতৃকার মুক্তির লক্ষ্যে বাংলার বিপ্লবীদের আত্মহুতি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা যোগ করে।