মেইজি জাপানের অর্থনৈতিক বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করো।
সোগুনদের শাসনকালে জাপানে বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েকটি শিল্পসংস্থা গড়ে উঠলেও মূলত জাপানের অর্থনীতি ছিল কৃষিভিত্তিক। কৃষক সম্প্রদায় এবং চালের উৎপাদন ছিল এই অর্থনীতির প্রধান দুটি স্তম্ভ। সম্রাটের ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের সাথে জাপানের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে যে পরিবর্তন সাধিত হয় দেশের অর্থনীতির উপরেও তার গভীর প্রভাব পড়ে। পাশ্চাত্য দেশগুলির অনুকরণে দ্রুতি অর্থনৈতিক উন্নতিসাধণের উদ্দেশ্যে জাপান শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
সুতরাং বলা যায় যে, মেইজি পুনর্বাসন জাপানে অর্থনৈতিক বিপ্লব আমন্ত্রণ করে এবং বিত্তশালী বণিক শ্রেণীর আর্থিক সাহায্যে মেইজি সরকার আধুনিক শিল্প বিস্তারে উদ্যোগী হয়। তবে অর্থনৈতিক এই পরিবর্তনের গোড়াপত্তন করেন পাশ্চাত্য চিন্তা ও আদর্শের দ্বারা উদ্বুদ্ধ জাপানের একটি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়।
মেইজি সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার পরেই জাপানের অর্থনীতিতে কৃষি অপেক্ষা শিল্প অধিকতর গুরুত্ব লাভ করতে থাকে। এরূপ অবস্থায় অল্পদিনের মধ্যে দেশের অর্থনীতি শিল্প ও বাণিজ্যভিত্তিক হয়ে পড়ে। কিন্তু এই সময় জাপানীদের আধুনিক অর্থনীতি সম্পর্কে তত্ত্বগত কোনো ধারণা ছিল না। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের তত্ত্বগত রীতিনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের ভারসাম্য, আমদানি অপেক্ষা রপ্তানীর আধিক্য এবং রপ্তানী অপেক্ষা আমদানীর আধিক্য দেশের অর্থনীতির উপর কীরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে সে বিষয়ে জাপানের জনসাধারণের কোনরূপ সঠিক ধারণা ছিল না।
তাছাড়া প্রায় দু-শত বছড় বহির্বিশ্বের সাথে বিচ্ছিন্ন থাকার জন্য জাপানের আধুনিক বাবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। অবাধ বাণিজ্য নীতি বা বাণিজ্যিক ব্যাপারে সরকারের হস্তক্ষেপ না করার নীতি সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যবসা-বানিজ্য, শিল্পে কেবলমাত্র বেসরকারী অর্থ লগ্নী করার নীতি অথবা সরকারী ও বেসরকারী অর্থলগ্নী করার নীতি প্রকৃতি সম্বন্ধে জাপানীদের কোনো তত্ত্বগত জ্ঞান ছিল না। কিন্তু মেইজি সরকারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সাফল্যের জন্য দেশবাসী শিল্প এবং ব্যবসা- বাণিজ্য ভিত্তিক অর্থনীতি সম্পর্কে জ্ঞান আহরণের প্রয়োজন বিশেষভাবে অনুভূত হতে থাকে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জাপানীদের নতুন অর্থনৈতিক বিধি ব্যবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করে তোলার দায়িত্ব গ্রহণ করতে এগিয়ে আসেন জাপানের একদল বুদ্ধিজীবী। এই বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর মধ্যে ফুকুজাওয়া ইউকিচির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগা। আধুনিক অর্থনীতি সম্পর্কে বহু বিদেশী গ্রন্থ পাঠ করে তিনি বহু তথ্য সংগ্রহ করে একটি নির্দিষ্ট মত পোষণ করেতে শুরু করেন এবং জনসাধারণের মধ্যে সেই মত প্রচার করার চেষ্টা করেন।
■ ফুকুজাওযার মতে, অর্থবিজ্ঞানের লক্ষ্য হল জনসাধারণের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করা, প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সরবরাহের পরিমাণ বৃদ্ধি করা, জনসাধারণের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য বিধান করে তাদের জীবনকে আরামদায়ক করে তোলা। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, অর্থনৈতিক তাদিগ মানুষকে কর্মতৎপর করে তুলতে বাধ্য করে। তবে তিনি মনে করতেন যে, জনগণের অর্থনৈতিক কার্যাদির উপর সরকারের হস্তক্ষেপ বাঞ্ছিত নয়, আবার জনগণের কর্মসংস্থানের উপায় করে দেওয়া সরকারের দায়িত্ব বলেও তিনি স্বীকার করতেন না। সরকার কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য প্রভৃতির উপর কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করবে না বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন।
■ অবাধ বাণিজ্য ও সংরক্ষণ নীতি সম্পর্কে মেইজি যুগে বেশ কিছু সমালোচনা মূলক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। মাসামিচি সুদা ছিলেন অবাধ বাণিজ্যের পক্ষপাতী এবং প্রোটেকসন নীতির বিরোধী। এই সময়ের অর্থনীতির উপর অপর দুই লেখক নাকামুয়া ও মাসাকি হায়সিও ছিলেন অবাধ বানিজ্যের সমর্থক। নাকামুয়া তাঁর মতবাদের সমর্থনে যুক্তি হিসাবে উল্লেখ করেন যে, অবাধ বাণিজ্যের ফলে দেশ থেকে বিদেশে স্বর্ণধাতু রপ্তানি হয় না, দেশ থেকে বিদেশে স্বর্ণ রপ্তানী হয় অন্য কারণে।
সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশে ছাত্র প্রেরণ, সরকারী কাজে বিদেশীদের নিয়োগ, বিদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র-শস্ত্র ক্রয় প্রভৃতি কারণে সরকার স্বর্ণের মাধ্যমে সমস্ত ঋণ পরিশোধ করতে বাধ্য হয়। নাকামুরার মতে, এই সব কারণেই বিদেশে স্বর্ণ প্রেরণ করার প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু অবাধ বাণিজ্যের ফলে সাধারণত এরূপ পরিস্থিতর উদ্ভব হয় না। নাকামুরার এই যুক্তি অনেক ক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্য না হলেও এইসব গ্রন্থ পাঠ করে জাপানের অধিবাসীরা আধুনিক অর্থনীতির অনেক তত্ত্ব সম্পর্কেই নানা বিষয়ে জানার সুযোগ পায়।
তবে এই সময় জাপানের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অবাধ বাণিজ্যের যেমন সমর্থক ছিল, প্রোটেকসন বা সংরক্ষণ নীতির সমর্থকেরও অভাব ছিল না। সংরক্ষণ নীতির সমর্থক ছিলেন মোরিকাজু, ওয়াকিযামা, জ্যোজি সুজি। তাকুজো উশিবা প্রমুখ ব্যক্তিগণ। মেইজি যুগের নতুন অর্থনৈতিক বিধিব্যবস্থা শুরু হওয়ার সময় প্রোটেকসন নীতিকে সর্বপ্রথম সমর্থন করেন মোরিকাজু ওয়াকাযামা। তিনি মনে করতেন যে, আপাত দৃষ্টিতে অবাধ বাণিজ্যের নীতি দেশের পক্ষে মঙ্গলজনক হলেও শেষ পর্যন্ত এই নীতি দেশের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়ে ওঠে। এপ্রসঙ্গে তিনি বলেন, জাপানের মতো আর্থিক সম্পদে দুর্বল, বাণিজ্য ও শিল্পে অনভিজ্ঞ দেশের পক্ষে অবাধ বাণিজ্য মঙ্গল অপেক্ষা অমঙ্গলকেই বেশী ডেকে আনবে।
মেইজি যুগের আবির্ভাবের প্রাক্কালে আধুনিক অর্থনীতি সম্পর্কে বিভিন্ন বুদ্ধিজীবীর আলোচনা জনসাধারণ ছাড়াও দেশের বুদ্ধিজীবীদের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে। এই সময় জাপানের শাসকগোষ্ঠী আধুনিক রাষ্ট্রোপযোগী অর্থনৈতিক আধুনিক পদ্ধতিতে জাপানের অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং সেই পরিকল্পনাকে বাস্তবে পরিণত করার চেষ্টা করে।
সোগুনদের আমলে জাপানের অর্থনীতি ছিল মূলত কৃষিভিত্তিক, কুটির শিল্প য্যাতীত বৃহৎ কলকারখানার কোনো অস্তিত্ব সে দেশে ছিল না। বাইরের কোনো দেশের উচ্ছ তাদের কোনো ধারণা ছিল না। কিন্তু মেইজি পুনর্বাসন জাপানের শিল্প ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এক ব্যাপক বিল্পব আনয়ন করে। জাপানের নতুন সরকার উপলব্ধি করতে সমর্থ হয় যে কৃষি ভিত্তিক জাপানের পক্ষে শিল্পাশ্রয়ী পাশ্চাত্য দেশগুলির সাথে মই হাস করে শিল্পের উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করতে শুরু করে। এর ফলে কিমুন জাপানে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়।