১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গ দ্বিখন্ডিতকরণে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ কীভাবে দায়ী ছিল?
১৯৪৭ সালে বহু বিতর্কের মধ্য দিয়ে বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করে ভারত স্বাধীন হল, বাংলা দ্বিখন্ডিত হয়ে হল পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ। এই বাংলাকে দ্বিখন্ডিত। করেই ভারত স্বাধীন হল দুটি ভাগে ভাগ হয়ে- ভারত এবং পাকিস্তান। বাংলা ক ভারত-বিভাজন প্রশ্নটি সামগ্রিকভাবে বিতর্কমূলক। জন্মই লাল পাকিস্তানার বা প্যাটেল ভারত-বিভাজন মেনে নেন এবং শেষ পর্যন্ত সালাদ নেইরুত মৌন সম্প নালেন। সম্ভবত এজন্যই মাউন্ট ব্যাটেন গান্ধীজীকে 'একজন মানুষের সীমানা শার্তি বলে বর্ণনা করেছেন। শ্রদ্ধেয় বিপানচন্দ্র এবং অন্য অনেকে মন্তব্য করেছেন যে, ১৯৪৭ সালে জওহরলাল নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেল, গান্ধীজী প্রমুখ যে ভারত বিভাজন মেনে নিয়েছিলেন, তা অবশ্যম্ভাবী ছিল। এর কারণ হিসাবে তাঁরা সাধারণ মুসলীম জনগণকে স্বাধীনতা সংগ্রামে টেনে আনার ব্যর্থতা, ১৯৩৭ সালের পর থেকে মুসলমানদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রভৃতির উল্লেখ করেছেন। এই ব্যর্থতা ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে রুঢ় বাস্তবরূপে দেখা দিয়েছিল। জিন্নাহর পাকিস্তানের দাবী ও এই সংক্রান্ত অভিযান কংগ্রেস একরকম মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। ফলে বাংলা তথা ভারত দ্বিখন্ডিতকরণে কংগ্রেস ও মুসলীম লীগ উভয়েই দায়ী ছিল।
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
কংগ্রেসের দারবদ্ধতাঃ
কংগ্রেস নেতারা ১৯৪৭ সালে জুন নাগাদ অনুভব করেছিলেন যে, আশু ক্ষমতা হস্তান্তর দরকার এবং অন্যথায় সাম্প্রদায়িক পৈশাচিক ঘটনাকে প্রতিহত করা যাবে না। অন্তবর্তীকালীন সরকারের ব্যর্থতাও পাকিস্তানের জন্ম প্রায় অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল। অঐইই-এর অধিবেশনে প্যাটেল বলেছিলেন যে, পাকিস্তান তো সৃষ্টি হয়েই গেছে এবং পাঞ্জাব, বাংলা ও অন্তবর্তীকালীন সরকারে পাকিস্তানের উপস্থিতি স্পষ্ট। অন্তবর্তীকালীন সরকারে পাকিস্তানের সমর্থকদের কার্যকলাপে নেহরু নিজে হতাশ হয়েছিলেন।
মুসলীমের অন্যতম সদস্য লিয়াকত আলি খান সমস্ত মন্ত্রীর দপ্তরকে একরকম অকেজো করে দিয়েছিলেন। এরূপ পরিস্থিতিতে নেহরু বুঝতে পারেন যে, অন্তবর্তীকালীন সরকার চালানো সম্ভব নয়। যত শীঘ্র সম্ভব ক্ষমতা হস্তান্তরের দ্বারা এই পৈশাচিক সাম্প্রদায়িক সমস্যা ও অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে ভারত-বিভাজন ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছিল। ১৯৪২ সালে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে তাদের স্থানীয় স্বায়ত্ত্বশাসনকে মেনে নেওয়া হয়েছিল। ১৯৪৬ সালে কংগ্রেস ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা অনুযায়ী মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে পৃথক সংবিধানসভা গঠনের প্রস্তাব মানা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের মার্চে কংগ্রেস ভারত- বিভাজনকে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সভায় মেনে নিয়েছিল। এছাড়া ওয়াভেলকে লেখা নেহরুর চিঠি থেকে জানা যায় যে, ভারতের বড়লাট লর্ড ওয়াভেলকে তিনি জানান যে, তাঁদের পক্ষে খুনের সাথে করমর্দন করা বা দেশের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো আপোষ করা সম্ভব ছিল না।
প্রকৃতপক্ষে কংগ্রেস নেতাদের অতীতের ব্যর্থতাকে কোনো কঠোর ব্যবস্থার দ্বারা বদলে দেওয়াও সম্ভব ছিল না । কারণ জনগণ প্রথমে বুঝতেই পারে নি যে ভারত বিভাগ হতে চলেছে । কোনো কংগ্রেস নেতাই বুঝতে পারে নি যে বিংশশতকের দুই বা তিনের দশকে সাম্প্রদায়িক চরিত্র ১৯৪২-এর পরে একজন মুসলীম লীগের নেতার আপোষহীন পাকিস্তানের দাবীর সাথে কোনো সঙ্গতি ছিল না । কংগ্রেস যতই আপোষ ও সুবিধা মুসলিমদের দিচ্ছিল জিন্নাহর পাকিস্তানের দাবী ততই সোচ্চার হয়ে উঠেছিল । মুসলমানরা ক্রমশ দলে দলে মুসলিমলীগের ছত্রছায়ায় জড়িয়ে পড়চ্ছিল । এর পাশাপাশি হিন্দুত্ববাদ ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তারা প্রচার করে যে, ঐক্যের আদর্শকে সামনে রেখে কংগ্রেস আসলে হিন্দু স্বার্থকে বিসর্জন দিচ্ছিল।
বেশ কিছু অবাস্তব কল্পনা গড়ে ওঠে। প্রথমতঃ অনেকেই ভেবেছিলেন যে, ভারত বিভাজন হবার পর ব্রিটিশ ভারতের মাটি থেকে চলে গেলেই হিন্দু-মুসলিম তাদের বিবাদ ভুলে গিয়ে আবার ঐক্যবদ্ধ ভারত গড়ে তুলবে। দ্বিতীয়তঃ ভারত-বিভাজন স্বল্পকালের জন্য এবং একবার ব্রিটিশ ভারত ছেড়ে চলে গেলে হিন্দু-মুসলমানের মানসিক পরিবর্তন ঘটবে এবং আবার তারা ঐক্যবদ্ধ হবে। তৃতীয়তঃ ভারত-বিভাগ শান্তিপূর্ণ হবে, জনসংখ্যার এদিক-ওদিক হবে না। কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হবে না।
ভারত বিভাজনের জন্য অনেক সময় গান্ধীজির দুর্বলতা ও অসহায় অবস্থা এবং অসন্তুষ্টির কথা উল্লেখ করা হয়। তিনি নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছিলেন। কংগ্রেসের সিদ্ধান্তগ্রহণের আবর্ত থেকে তাঁকে একঘরে করে দেওয়া হয়েছিল। তিনি নেহরু বা প্যাটেলের কার্যকলাপকেও নিন্দা করতে পারেন নি। কারণ তিনি ভাবতে পারেন নি, যে প্যাটেল ও নেহরু একসময় তাঁর সাথে থেকে বিশাল স্বার্থত্যাগ করেছিলেন, তাঁরাও ক্ষমতার লোভের কাছে আত্মসমর্পন করবেন।
গান্ধীজির অসহায়তার আসল কারণ ছিল তাঁর দেশের অর্থাৎ ভারতের জনগণের সাম্প্রদায়িক মনোভাব। তাঁর মতে জনগণ ভারত-বিভাগ মেনে নিয়েছিল এবং সেজনা কংগ্রেস তা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। হিন্দু ও শিখদের ভারত-বিভাগ সমর্থন গান্ধিজিকে নিষ্ক্রিয় করেছিল। মুসলমানরাও তাঁকে শত্রু মনে করেছিল। গান্ধিজী জনতাহীন নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। ফলে তাঁর আহ্বান কেহ শোনে নি। সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার ছায়ার মধ্যেই তিনি ভারত বিভাগের উৎপত্তি দেখতে পেয়েছিলেন।
ভারত বিভাজন বিষয়টি একটি অত্যন্ত জটিল ঐতিহাসিক বিষয়। ধর্ম ও রাজনীতি, জাতীয়তাবাদী স্বার্থ, সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব প্রভৃতির সংমিশ্রণে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৩৩ এবং ১৯৩৫ খ্রিঃ চৌধুরী রহমত আলির ছাত্র গোষ্ঠী কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় পাকিস্তান কথাটি ব্যবহার করেছিলেন। ইকবাল ১৯৩০ খ্রিঃ মুসলীম লীগের সভাপতি হিসাবে উত্তর- পশ্চিম ভারতীয় মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের কথা বলেছিলেন। তাঁকেও পাকিস্তানের জনক বলা হয়। কিন্তু তিনি ভারত বিভাজনের পক্ষে ছিলেন না। তিনি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠদের নিয়ে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। এমনকি ১৯৪০ খ্রিঃ মুসলিম ক. র লাহোর অধিবেশনে পাকিস্তান গঠনের প্রস্তাব অস্পষ্ট ছিল।
এই সমস্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মুসলীম লিগের পাকিস্তান দাবী আদায়ের জনা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম, ১৬ই আগস্ট ১৯৪৬-এ কলকাতায় ব্যাপক সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা অন্তবর্তীকালীন সরকারে যোগদানের জন্য কংগ্রেসের উপর ব্রিটেনের চাপ সৃষ্টি, লীগের ও জিন্নাহের এই সরকারে যোগদানের বিরোধীতা এবং অনিচ্ছা ও সর্বোপরি এই সময় সারা দেশে ব্যাপক হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা ভারত বিভাগকে মেনে নেবার পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল।
আধুনিক কালে ভারত বিভাজন সংক্রান্ত ব্যাপারে গবেমিকা আয়েশা জালাল অভিমত প্রকাশ করেন যে ১৯৪০-৪৬ খ্রিঃ মধ্যে জিন্নাহ অথবা মুসলিম লীগ সংহতিপূর্ণভাবে পাকিস্তান প্রস্তাব তোলেনি। পাকিস্তান প্রস্তাবের অস্পষ্টতা মুসলিম জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে এবং তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী মনোভাব জাগাতে সাহাযা করেছিল। ১৯৪৬-এর নির্বাচনে মুসলিম লীগ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে প্রায় ৭৪.৭% ভোট পেয়েছিল। এই সাফল্য পাকিস্তানের পক্ষে গণভোট হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। এই নির্বাচনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ৮০.৯% ভোট পেয়ে নিজেদের অবস্থানকে দৃঢ় করেছিল । অন্যান্য দল যেমন- কমিউনিস্ট পার্টি, হিন্দু মহাসভা ইত্যাদি গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।
আবার ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৬-এর জুনে পেথিক লরেন্সের নেতৃত্বে একটি দলকে ভারতের সংবিধান রচনার করার লক্ষ্যে বিভিন্ন দলের সাথে আলোচনার জন্য পাঠিয়েছিল। কিন্তু এই মিশন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল। ১৯৪৬-এর এপ্রিলে দিল্লীতে মুসলিম লীগের আইনসভার সদস্যদের সম্মেলন হয়েছিল। সেখানে পাকিস্তানকে সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে গঠনের দাবী গৃহীত হয়েছিল। অপরদিকে সেই সময়। কংগ্রেসের সভাপতি মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ঐক্যবদ্ধ ভারতের স্বাধীনতা দাবী করেছিলেন। ক্যাবিনেট মিশন পাকিস্তান দাবী নাকচ করেছিল।
তাদের মতে জিন্নাহর দায়িত্বকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত নয় । যদিও তিনি পাকিস্তান গঠনের ব্যাপারে গঠনমূলক ভূমিকা গ্রহন করেছিলেন । এই সাথে একথাও ঠিক যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের ভূমিকাও ভারতবিভাগের জন্য বহুলাংশে দায়ী ছিল । সাম্প্রতিককালে ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ এরূপ মত প্রকাশ করেছেন যে, হিন্দুরা কেন বুঝতে পারেনি ইসলাম এবং হিন্দু ধর্মের প্রকৃত চরিত্র একই। তাঁর মতে, এই দুটি ধর্ম প্রকৃতপক্ষে দুটি পৃথক সামাজিক শৃঙ্খলা ছিল । সুতরাং জিন্নাহর দায়িত্বের ব্যাপারে একটি নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টি গ্রহণ করা উচিত।
অবশেষে সেই বহু প্রতীক্ষিত দিন এসে পড়ে ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সাল । দীর্ঘদিনের সংগ্রাম শেষ হয় । কিন্তু তার পরেও সংগ্রাম চলেছে । ক্ষুধা, দারিদ্র, অনগ্রসরতা, অশিক্ষা, দুর্নীতি প্রভৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম স্বাধীন ভারতে আজও চলছে । এর কোনো অবসান নেই । জিন্নাহর সাধের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হয়েছিল । কিন্তু তিনিও বলেছিলেন, 'এক খন্ডিত ও ঘুণধরা পাকিস্তান' লাভ হয়েছে মাত্র । প্রকৃতপক্ষে ভারত বিভাজন একটি বিতর্কমূলক ঐতিহাসিক ঘটনা । ভারতের জাতীয় কংগ্রেস, জিন্নাহ, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ এবং ১৯৪০-এর দশকে অবিরাম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পরিস্থিতিকে জটিল করেছিল। কোনো একক গোষ্ঠীকে পৃথকভাবে বাংলা তথা ভারতবর্ষ বিভাজনের জন্য দায়ী করা যায় না। প্রকৃতপক্ষে ভারত-বিভাজন এক জটিল এবং বিভিন্ন স্বার্থের এক অবশ্যম্ভাবী পরিণাম ৷