দ্বি-মেরুকরণ বিশ্ব কী? কোরিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দ্বি-মেরু বিশ্ব ব্যাখ্যা করো । অখবা, দ্বিমেরুকরণ কী? কোরিয়া যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিমেরুকরণ ব্যাখ্যা কর ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমগ্র বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে ছিল । একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমী শক্তিবর্গের জোট সৃষ্টি হয়েছিল । অপরদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে আরো একটি শক্তি জোট সৃষ্টি হয়েছিল । এই সময়কার বিশ-রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্টা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ক্ষমতা বিস্তারের প্রতিদন্দ্বীতা । আবার একথাও বলা যায় যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বরাজনীতির প্রধান বৈশিষ্টা ছিল দুটি পরস্পর বিরোধী সামাজিক ব্যবস্থার সংঘাত । দুই বৃহৎ রাষ্ট্রের মধ্যে এই ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে ঐতিহাসিক টয়েনবি দ্বি-মেরুকরণ রাজনীতি বলে আখ্যায়িত করেছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কোরিয়া জাপানের দখলে ছিল । কিন্তু ১৯৪৫ খ্রিঃ হিরোসিমা ও নাগাসাকির উপর পারমাণবিক বোমা বর্ষণের পর কোরীয়ায় জাপানের অস্তিত্বের বিলোপ হয় । ফলে জাপান অধিকৃত করিয়া উত্তরাংশ রাশিয়ার কাজে এবং দক্ষিণাংশন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। । সোভিয়েত ইউনিয়ন উত্তর কোরীয়ায় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরীয়ায় নিজেদের প্রাধান্য স্থাপন করেছিল।
এরূপ অবস্থায় সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ সমগ্র কোরীয়ার জন্য স্বাধীন ও অবাধ নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুমান ছিল তারা প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কোরীয় অঞ্চলের অধিকারী । এজনা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভোটে উত্তর কোরীয়ায় সোভিয়েত প্রাধান্যের অবসান ঘটবে । কিন্তু দুঃখের বিষয় ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রভাব কোরিয়াতেও পড়েছিল। সোভিয়েন ও মার্কিনের মধ্যে কোনো বোঝাপড়া হয়নি । জাতিপুঞ্জের তত্ত্বাবধানে দক্ষিণ কোরীয়ায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় । এর ফলে দক্ষিণ কোরীয়ায় এক স্বাধীন প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ।
উত্তর কোরীয়া কর্তৃক দক্ষিণ কোরীয়ার আক্রমণ ছিল সোভিয়েত সমর্থিত প্রার্থী কিম দ্বিতীয় সুংয়ের নিজস্ব ধারণা ও নীতিসম্বলিত। আবার একথা অনেকে মনে করেন যে দক্ষিণ কোরিয়াকে কমিউনিস্ট চীন এব্যাপারে প্ররোচিত করেছিল । আবার একথাও মনে করা যায় যে, ট্রুম্যান পরিকল্পনা বার্থ করার জন্য সোভিয়েতন ইউনিয়ন নিজেই দক্ষিণ কোরীয়া আক্রমণ করেছিল । কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘোষণা করেছিল যে দক্ষিণ কোরীয়ার 'দস্যু বিশ্বাসঘাতকরা' জন্য এই আক্রমণ করেছিল ।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান ধরে নিয়েছিলেন যে, উত্তর কোরীয়ার এই আক্রমণের প্রধান শক্তি কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন । এজন্য শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য ছাড়াও দক্ষিণ কোরীয়াতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপ আরও প্রয়োজন । জাপানের অভ্যন্তরে আমেরিকার যে সেনা বাহিনী ছিল তাদের দ্রুত দক্ষিণ কোরীয়ার সাহায্যে আসার জন্য নির্দেশ দেওয়া হল।
এদিকে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত ছিল যে উত্তর-কোরীয়া দক্ষিণ কোরিয়া থেকে সব সেনা প্রত্যাহার করে নেবে । এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের অধিবেশন বর্জন করেই চলেছিল । কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন চিনের গণ-প্রজাতন্ত্রী সরকারকে স্বীকৃতি জানায় নি । ফলে কোরিয়াকে কেন্দ্র করে ঠান্ডা লড়াই ভালোই জমে উঠেছিল । নিরাপত্তা পরিষদ উত্তর কোরিয়াকে আক্রমণকারী বলে চিহ্নিত করেন এবং কোরিয়ার রাষ্ট্রসঙ্ঘের বাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন ৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং আরও চৌদ্দটি দেশ (অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, গ্রীস প্রভৃতি) সকলেই মিলিত ভাবে সেনা প্রেরণ করেছিল । এদের দায়িত্বে ছিলেন জেনারেল ম্যাক আর্থার ।
কোরীয় যুদ্ধে যা ঠান্ডা লড়াইয়ের অন্যতম কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছিল তাকে কমিউনিস্টদের অধিকারে চলে যাওয়া থেকে রক্ষা করেছিলেন এই সেনাবাহিনী । না হলে দক্ষিণ কোরিয়াকে কমিউনিস্টরা দখল করে নিত । চিনের প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই ঘোষণা করেছিলেন যে, জাতিপুঞ্জের সেনাবাহিনী উত্তর কোরিয়াতে প্রবেশ করলে চীন তার প্রতিরোধ করবে ।
এদিকে জাতিপুঞ্জের সেনাবাহিনীর সাফল্য বেড়ে চলায় চিন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল । ১৯৫১ সালে চীন ব্যাপক আক্রমণ শুরু করে । চিনের প্রায় তিন লক্ষ সেনাবাহিনী সিওলে পৌঁছায় । চীনের এই সাফল্যে জেনারেল ম্যাক আর্থার পিছু হটেন । মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যানও বুঝতে পারেন যে আর অগ্রসর হলে ব্যাপক যুদ্ধ শুরু হতে পারে । ফলে কমিউনিজমের গতি রোধ করেই তিনি ক্ষান্ত হন । ম্যাক আর্থারকে সরিয়ে দিতে বাধ্য হন । শান্তিস্থাপনের আলোচনা প্রায় দু-বছর ধরে চলে । অবশেষে জুলাই, ১৯৫৩ খ্রিঃ ঠিক হয় যে উত্তর ও দক্ষিণ কোরীয়ার মধ্যে সীমারেখা ৩৮° দ্রাঘিমা রেখাই মেনে নেওয়া হবে ।
কোরীয়া যুদ্ধের ফলাফলঃ
- প্রথমতঃ স্নায়ুযুদ্ধের অন্যতম কেন্দ্র ছিল কোরীয়া। এজনা কোরীয়াকে অনেক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছিল । যুদ্ধে ২ কোরিয়ায় প্রচন্ড ক্ষতি হয় মার্কিন, কোরীয়, চীনা সবমিলিয়ে ২৫ লক্ষের মানুষ নিহত হয়, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে । রাষ্ট্রপতি টুম্যান নিজের সাফলা দাবী করলেও দেশের অভ্যন্তরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল ।
- দ্বিতীয়তঃ স্নায়ুযুদ্ধের ফলে আমেরিকার সাথে চীনের এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক চিরতরে বৈরীমূলক হয়েছিল । এজন্য দেখা যায় যে ইন্দো-চিনকে চীন ফ্রান্সের করল থেকে মুক্ত করার জন্য সাহায্য করেছিল । আবার তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির উন্নতির জন্য টান সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল । ১৯৫৪ খ্রিঃ ভারতের সাথে ব্রহ্মদেশের 'শান্তিপুর্ন সহাবস্থানেরা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । এটি কোরীয় যুদ্ধের প্রভাবের ফলে সম্ভব হয়েছিল ।
- তৃতীয়তঃ বল প্রয়োগের মাধ্যমে দুই কোরিয়ার সংযুতি তো দূরের কথা উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিভাজনকেই মেনে নিতে হয়।
- চতুর্থতঃ যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধের পর তা সামরিক বাহিনীকে আরো শক্তিশালী করে গড়ে তোলার প্রস্তুতি নেয়
- পঞ্চমতঃ এই যুদ্ধের ফলে ঠান্ডা লড়াই সমগ্র প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে
চীনের সাথে আমেরিকার সম্পর্কের আরও অবনতি হয়। কারণ চীন তাইওয়ানকে চীনের অংশ বলে মনে করত। অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানে চিয়াং কাইশেকের সুরকারকে সমর্থন করে যাচ্ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে সমর্থন করেছিল। কারণ তাইওয়ানকে সামরিক ঘাঁটি হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করতে চেয়েছিল। সুতরাং কোরীয় যুদ্ধের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।