ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ শতকগুলিতে জাপানের অর্থনৈতিক অগ্ৰগতিতে সরকারি বা রাষ্ট্রের উদ্দোগ আলোচনা কর ।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ শতকগুলিতে জাপানের অর্থনৈতিক অগ্ৰগতিতে সরকারি বা রাষ্ট্রের উদ্দোগ
মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরবর্তী যুগে জাপান সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ যে সংস্কারের মনোযোগী হয় তা হল অর্থনৈতিক সংস্কার। পুঁজিবাদী অর্থনীতি গড়ে ভুলতে হলে যে প্রেক্ষাপটের প্রযোজন হয় এই সংস্কারগুলি তারই ব্যবস্থা করেছিল। মেইজি জাপানে যে শিল্পায়ন বা অর্থনৈতিক অগ্রগতি দেখা দিয়েদিন তাতে স্পষ্ট দুটি ধারায় প্রয়াম লক্ষিত হয়। একটি সরকারি উদ্যোগ ও অন্যটি বেসরকারি উদ্যোগ।
জাপানের শিল্পের প্রগতি ঘটাতে মেজী সরকার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিল। রাজনৈতিক স্বায়িত্ব প্রদান করে এবং সুস্থ আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ গড়ে উপযুক্ত পরিকাঠামো পরিবেশ তৈরি করা হয়। শিল্প ক্ষেত্রে সরকার স্বয়ং এগিয়ে এসে পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে অন্যান্য ব্যক্তিগত উদ্যোগের শিল্পগুলির বিকাশের পথ প্রশস্ত করে। মেজী সরকারি নেতৃবৃন্দ রণকৌশলগত শিল্পের (Strategic industries) বিকাশের উদ্যোগ নেয় যার উপর আধুনিক শির দাঁড়িযেছিল। প্রাক মেজী যুগের শোগুন প্রশাসনে, এবং কিছু শক্তিশালী সামস্তক্ষেত্রে বিষয়ে কিছুটা উন্নতি হযেছিল। যেমন হিডেন (Hizen) নিয়ন্ত্রিত ক্ষেত্রে নাগাসাকির প্রতিরক্ষার জন্য ডাচ সাহায্যে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে লোহা গলানোর চুন্নী নির্মাণ হযেছিল। এই লোহা নিয়েই যুদ্ধোপযোগী দাঁচে ঢালা ভারি গাদা কামাল হয়েছিল।
মেত্রী সরকার প্রথম থেকেই বিদেশী নির্ভরতা কাটাতে সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণশিল্পের জোর দেয়। হাইয়োগো (Hyogo) তে একটি জাহাজ নির্মাণ শিল্প গড়ে তোলা হয়। এর শোগুন যুগের নাগাসাকি ও ইয়োকোসুকো নিয়ে মোট তিনটি আহাজ কারখানার মালিকানা সরকারের দখলেআসে। ইয়োকোসুকো কারখানা থেকে ১০০০ টনের দুটি জাহাজ তৈরি করা হয় ১৮৭০ এর দশকে এবং১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নাগাসাকি জাহাজ নির্মাণ কারখানা ১০ টি এবং হাইওগো ২৩ টিমার তৈরি করে। এদাড়া সরকার টোকিও ওসাকাতে কামান, রাইফেল গোলাবারুদ তৈরির কারখানা পরিচালনা করে। ওসাকা-র কারখানায় ১১০০ কর্মী নিযুক্ত দিল। বিদেশী প্রযুক্তিতে বিদেশী মডেলে সমরাস্ত্র প্রস্তুত হলেও নিরাপত্তাজনিত কারণে বিদেশীদের এইসব কারখানায় নিয়োগ করা হত না।
আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থাও সরকারি নেতৃত্বে গড়ে কারণ এই কাজে জনগণের স্বার্থ জড়িত তেমনি এর জন্য প্রচুর পুঁজিরও প্রযোজন। পাশ্চাত্য দেশগুলির তুলনায় জাপানের অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার একটি কড়িমা হল অতি ব্যয়সাপেক্ষ অভ্যন্তরীণ পরিবহন ব্যবস্থা। জাপানে নাব্য নদীর সংখ্যা দিল গীমিত এবং বেশির ভাগ। পণ্য যোড়ার পিঠে বা মানুষকে বয়ে নিয়ে যেতে হত। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের পাশ্চাতোর উপযোগিতা ভিত্তিক। যোগাযোগ ব্যবস্থা জাপানে গড়ে তোলা হয়। তাই রেল পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে ভোলার গর তা খুবই লাভজনক প্রমাণিত হয়। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে টোকিও ও ইয়োকোহামার মধ্যে ১৯ মাইল দীর্ঘ রেল লাইন বসানোর কার সম্পূর্ণ হয়। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে ৪০ হাজার মাল পরিবহন পূর্বের সপ্তমাংশ খরচে সম্ভব হয়েছিল। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ১০লয় যাত্রী রেলে যাতায়াত করতে সক্ষম হয় ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোবে ও ওসাকার মধ্যে দ্বিতীয় রেল লাইন গড়ে তোলা হয় এবং ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে তা কিয়োটো পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। তবে জাপানের মতো পর্বত সংকুল দেশে রেল লাইন নির্মাণের কাজ দিল খুবই ব্যয় সাপেক্ষ। তাই কাজ ধীর গতিতে এগোয়। ১৮৮১ পর্যন্ত ৭৬ মাইল রেললাইন পাতা সম্ভব হয়। ১৮৮৮ সালে ৩২০ মাইল রেল লাইন সম্প্রসারিত হয় এবং একদশক পরে দশগুণ বৃদ্ধি পায়। মার তিন-চতুর্থাংশ খরচ ব্যাক্তিগত পুঁজি (Private Capital) (থকে এসেছিল। দেশ জুড়ে রাজনৈতিক প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য জাপানে অভিদ্রুত টেলিগ্রাফ লাইন পাতা হয়। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আপানের প্রধান শহরগুনির মধ্যে সরকারি টেলি সংযোগ স্থাপিত হয়।
শুধু রনীতিগত বা প্রতিরক্ষা (Strategic Industries) মধ্যে জাপানের শিল্পায়ন আটকে থাকেনি। জাপানের নেতৃবৃন্দ বুঝেছিলেন পাশ্চাত্যের সাথে পারাদিতে হলে এবং প্রতিকূল বাণিজ্যিক ভারসাম্য দূর করতে চলে যন্ত্র শিল্পের মত ভোগ্যপণ্যের যান্ত্রিক উৎপাদন শুরু করতে হবে। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে বাণিজ্য শুরুর পর থেকে রুপোর বিনিময়ে প্রচুর সোনা আপানের বাইরে চলে যায় তবুও বিদেশী পণ্যের প্রতি জাপানী জনগণের কম চাহিদা এবং জাপানী রেশম এবং রেশম গুটির চাহিদা ইউরোপে বৃদ্ধি পেলে প্রথম দশকে জাপানে সামান্য অনুকূল বাণিজ্যিক ভারসাম্য নিয়ে আসে। ইউরোপের রেশম শির পুনরায় চাঙ্গা হলে এবং জাপানী জনগণের মধ্যে পাশ্চাত্য সামগ্রীর প্রতি চাহিদা বৃদ্ধি পেলে, ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে অতি কম হারে শির আমদানি শুপ্তধাম হলে জাপানে ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দেয়।
এই বাণিজ্যিক প্রতিকূলতা চরমে ওঠে যখন মান ওঠানামা, পরিবহন ও বীমার খরচ যুক্ত হয়। ইতিমধ্যে কম দামের বিদেশী পণ্য জাপানে আমদানি করা হলে আপানের হস্তশিল্প বিশেষ করে বস্তুশির সংকটের মুখে পড়ে। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে মেজী সরকার শিল্পমন্ত্রক গড়ে তোলে। পরের বছর ইটো এর উপমন্ত্রী (Vice- minister) নিযুক্ত হন এবং ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত থাকেন। ইটো ও তাঁর উত্তরসূরিদের তত্বাবধানে সরাসরি সরকারি উদ্যোগে ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে সাধারণ শিল্পের বিকাশ ঘটে। সরকার প্রযুক্তিগত সাহায্য, সহজ শর্তে ঋণএবং ভরতুকি দানের মাধ্যমে ব্যক্তিগত উদ্যোগকে উৎসাহিত করে। কিন্তু পুঁজির অভাব, উচ্চ সুদের হার, জাপানীদের প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব, বিদেশী বিশেষজ্ঞদের উচ্চ বেতন জাপানী ব্যক্তিগত উদ্যোগের প্রধান অন্তরায় দিল। সরকার তা দূরীকরণে যত্নশীন হয়।
মেইজি সরকার বিভিন্ন পাশ্চাত্য দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করে। ফলে বৈদেশিক রাষ্ট্রসমূহের সামনে জাপানের বাণিজ্য করার সুযোগ উন্মুক্ত হয়। তাই জাপান তার পশ্চাদপদ কৃষি অর্থনীতি নিয়ে শিল্পোন্নত পশ্চিমের সঙ্গে এক অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়। কিচ জাপান মুদ্রাস্ফীতির কবলে পড়ে। ১৮৭০ এর দশকে তা চরম আকার নেয়। এ সময় জাপানের অর্থমন্ত্রী দিলেন মাৎসুকাটা যাকে অর্থনীতির জাদুকর বলা হয়েছে। তিনি জাপানের অর্থনৈতিক সংকটের কারণ হিসাবে ধাতুর মুদ্রা হ্রাস পাওয়া এবং বৈদেশিক প্রতিযোগিতার কথা বলেন। তিনি বলেন যে বিদেশীদের কাছ থেকে শুধু পণ্য আমদানি করলে জাপানের প্রগতি হবে না। ভাই তিনি আমদানির পরিমাণ হ্রাস করার কথা বলেন এবং সরকারি উদ্যোগে আধুনিক শিল্প গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা হয়। মার পূর্ব শর্ত দিল মুদ্রা ব্যবস্থার সংস্কার।
পুরনো এবং জটিল মুদ্রা ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। মার্কিন মুদ্রানীতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভের জন্য একটি কমিশন আমেরিকা যায় এবং তাদেরই সুপারিশ অনুযায়ী মুদ্রাব্যবস্থার দশমিক গদ্ধতি চালু করা হয়। পাশাপাশি দিল কাগজি নোট। এভাবে জাগানে জাতীয় মুদ্রা ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
সরকারি তরফ থেকে ব্যাংক ব্যবস্থার সংস্কার করা হয়। ১৮৭২ সালে জাতীয় ব্যাংক আইন প্রণীত হয় এবং ১৮৭৬ সালে এই আইনে কিছু কিছু পরিবর্তন আনা হয়। এতে বলা হয় আমেরিকার মডেল অনুসারে জাপানে ব্যাংক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। মাৎসুকাটা ১৮৮২ সালে ব্যাঙ্ক অফ জাপান নামে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গড়ে তোলেন। তারাই একমাত্র কাগজী মুদ্রা প্রকাশ করার অধিকার লাভ করে। আর বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলি সাধারণ ব্যাংকিং কার্যাবলী সম্পাদন এর দায়িত্ব লাভ করে।
মাৎসুকাটা এটা উপলব্ধি করেছিলেন যে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পুঁজি সংগ্রহ না হলে শিল্পায়ন সম্ভব নয়। তিনি কর ব্যবস্থার পরিবর্তন করেন এবং 'ঋণ সৃষ্টি' করেন (ক্রেডিট ক্রিয়েশন)। তখনো পর্যন্ত সরকারি রাজস্বের ৭৮ ভাগ আসতো ভূমিকর থেকে এবং তা মুদ্রার মাধ্যমে দিতে হতো। ১৮৮০ দশকে মাৎসুকাটার মুদ্রার হ্রাস নীতির ফলে জিনিসের দাম কমতে থাকে। এর ফলে কৃষকরা মুদ্রার মাধ্যমে কর দিতে অসুবিধায় পড়ে। কিন্তু বড় ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের মুনাফার পরিমাণ প্রচুর বৃদ্ধি পায়। তবে রাষ্ট্রের আয় বৃদ্ধি পায়।
পুঁজি সংগ্রহের জন্য মেইজি রাষ্ট্র অন্যান্য পদক্ষেপও গ্রহণ করেছিল। পুঁজি সংগ্রহের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ দিল স্বর মজুর দানের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণীকে নির্যাতন এবং শোষণ। রাষ্ট্রের এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শ্রমিকরা প্রতিরোধ আন্দোলনও করেছিল। তবে জাপানের পুঁজি সংগ্রহে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। রাষ্ট্রীয় উদ্যেগে পুঁজি সংগ্রহের পর শিল্পোদ্যোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু দেখা যায় তামা ও কয়লা ছাড়া অন্য কোন কাঁচামাল সেখানে নেই। কিন্তু সেখানে প্রচুর তুলো এবং কাঁচা রেশম তৈরি হতো। ভাই জাপানের বস্তু শিল্প গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে জাপান হালকা শিল্পায়নের পদ্ধতি গ্রহণ করে। তবে এক্ষেত্রে প্রধানত ব্যক্তিগত উদ্যোগেই গড়ে উঠেদ্দিন, সরকার কেবল ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ প্রদান করত।।
সরকারি উদ্দ্যোগে সামরিক সরজান শিল্প উন্নত হয়। তার পাশাপাশি দিন জাহাজ শিল্প। ১৮৮০ এর মধ্যে বেশ কতকগুলি সরকারি উদ্যোগে শিল্প গড়ে উঠেছিল। যেমন রেশম কারখানা, সিমেন্ট কারখানা, স্পিনিং মিল। তবে এসবই বেসরকারি মালিকানায় হস্তাবরিত করা হয় ১৮৮০-র দশকে। খনি ও ধাতুশিয় এসময় অগ্রগতি লাভ করে, পরিবহন শিল্পেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েদিল। তবে রেলপথের ক্ষেত্রে প্রধান উদ্যোগই ছিল বেসরকারি। মিৎসুবিশি কোম্পানি এ ব্যাপারে অভ্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় এবং যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করে। সুতরাং দেখা বান্দে যে মেইজি আমলে যে অর্থনৈতিক সংস্কার যা শিল্পায়ন দেখা গিযেছিল তাতে সরকারি উদ্যোগে শিল্পের পথে বাধা গুলিকে প্রাথমিকভাবে দূর করার চেষ্টা হয়েছিল এবং শিল্পের অন্তঃকাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিন মেইতি সরকার এবং সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বেসরকারি উদ্যোগ জাপানের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে অন্য মাদ্রা প্রদান করেছিল।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ শতকগুলিতে জাপানের অর্থনৈতিক অগ্ৰগতিতে সরকারি বা রাষ্ট্রের উদ্দোগ আলোচনা কর এই নোটটি পড়ার জন্য