জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে মহিলাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণে মহাত্মা গান্ধীর ভূমিকা আলোচনা করো। অথবা,মহিলাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণে মহাত্মা গান্ধীর ভূমিকা অথবা,জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারীজাতির অংশগ্রহণে গান্ধিজির অনুপ্রেরণা কতটা দায়ী ছিল?
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধের জয় লাভের সাথে সাথে ভারতবর্ষ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শুরু হয় । এরপর ১৮৫৮ সালে মহারানীর ঘোষণার মাধ্যমে ভারতবর্ষের শাসনভার সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের হাতে অর্পিত হয় । বিদেশীদের এই শাসন ভারতীয়দের কোনদিনও মেনে নেয়নি । ফলে প্রতিরোধ সংগ্রাম সর্বদাই বজায় ছিল ৷ ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বলতে বোঝায় এক জাতি এক প্রাণ আর জাতীয়তাবাদীর লড়াই বা সংগ্রাম বলতে বোঝায় দেশ মাত্র রক্ষা শৃঙ্খলামোচনে ভারতীয়দের অন্তহীন সংগ্রাম, নানান প্রতিরোধ, লড়াই সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ভারত বর্ষ ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ১৫ ই আগস্ট স্বাধীনতা ফিরে পায় ৷
ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বহু নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল ৷ কিন্তু ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের পর মহাত্মা গান্ধী জাতীয় কংগ্রেসে তথা ভারতীয় জাতীয় শক্তি আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করলে তার আগমনে ভারতীয় রাজনীতির এক নতুন রূপ পরিগ্রহ করে ৷ রাজনীতিকে তিনি ইংরেজির শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বৈঠকশালা থেকে দরিদ্র কৃষক ও শ্রমিকের দিন কুটির কৃষি ক্ষেত্র ও কলকারখানায় পৌঁছেছিল ৷ এছাড়াও তিনি হলেন একমাত্র নেতৃত্ব যিনি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের গৃহস্থ রমনীদের অংশগ্রহণ ঘটিয়েছিলেন ৷ ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে আমৃত্যু তিনি ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও জাতীয় আন্দোলনের মধ্যশালী ৷
গান্ধীজী তার অদ্ভুত কারিশমার দ্বারা তথাকথিত দুর্বল ও অবলা নারী জাতিকেও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পুরো ভাগে ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত করেছিল ৷ ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে থেকে যে কয়েকটি সর্বভারতীয় আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল প্রত্যেকটি আন্দোলনে নারী জাতির অংশগ্রহণের মাধ্যমে পূর্ণতা পেয়েছিল ৷ গান্ধীজীর অনুপ্রেরণায় হাজার হাজার নারী ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে ব্যারিকেড গড়ে তুলেছিল ৷ প্রতিটি বাড়ির রান্নাঘরে পৌঁছে গিয়েছিল মহাত্মা গান্ধীজি কা স্লোগান হো যাও তেয়ার এই শব্দটি ৷
গান্ধীজীর রাজনৈতিক আন্দোলনের একটি দিক হল ছাত্র দল ৷ অসহযোগ, আইন অমান্য, হরতাল, অনসন ইত্যাদি অহিংস অস্ত্র যার সঙ্গে তিনি প্রত্যক্ষভাবে প্রতিটি মানুষকেই যুক্ত করেছিলেন ৷ অন্যদিকে খাদি , চরকা,জাতীয় শিক্ষা,পল্লী,পুনর্গঠন ইত্যাদি গঠনমূলক কাজগুলোকেও তিনি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন ৷ এই দুই প্রকার আন্দোলনে গান্ধীজীর অনুপ্রেরণায় অসংখ্য ভারতীয় মহিলা অংশগ্রহণ জানিয়েছিল ৷
১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নাগপুরে কংগ্রেসের সাধারণ অধিবেশনে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । এই আন্দোলন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল ৷ আন্দোলনে যেমন অংশ নিয়েছিলেন ছাত্র সম্প্রদায় ,বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, কৃষক এবং শ্রমিক সম্প্রদায় তেমনি নারী জাতিরও অংশগ্রহণ ছিল চোখে রাখার মত ৷ গান্ধীজীর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা ছিল উদ্ভূত উজ্জ্বল ৷ বাংলায় বাসন্তী দেবী, উর্মিলা দেবী ,শর্মিল , সরোজিনী নাইডু, সত্যেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী, হেমপ্রবাহ মজুমদার, প্রমুখো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন ৷ শুধু বাংলায় নয় দেশের অন্যান্য অংশ বহু নারী যোগ দিয়েছিলেন ৷
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ৬ এপ্রিল গুজরাটের ডান্ডি তে অভিযান করে গান্ধীজীর লবণ আইন ভঙ্গ করে গুজরাটের সমুদ্র সৈকত থেকে আইন ভঙ্গের বার্তা ছড়িয়ে পড়াই সঙ্গে সঙ্গে অহিংস অভিযান দেশব্যাপী উন্মাদনা সৃষ্টি করে ৷ দিকে দিকে শুরু হয় আইন ভঙ্গের মহড়া, পূর্বেকার অসহযোগ আন্দোলন যেমন কৃষক শ্রমিক অংশ নিয়েছিল এই আন্দোলনে কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীর পাশাপাশি নারীরাও অংশগ্রহণ নিয়েছিল ৷ গান্ধীজি তার ডান্ডি অভিযানের মূল স্বেচ্ছা বিন্দি দলে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করতে যান ৷ জানান কারণ যাত্রাপদ ছিল সুদীর্ঘ নারীদের পথে বিপদজনক ও ক্ষতিকর কিন্তু নারী সম্প্রদায়ের স্বতঃস্ফূর্তভাবে গান্ধীজিকে সমর্থন জানায় ।
আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হলে নারীরাও বিপুল সংখ্যক অংশগ্রহণ করেন ইতিপূর্বে কোন আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের এমন ব্যাপকতা দেখা যায়নি, দিল্লিতে হাজার হাজার মহিলা কারাবরণ করেন এলাহাবাদ, লাহোর, লখনউ প্রভৃতি স্থানে সত্যঙ্গিনী বিক্ষোভের প্রকাশ্যে অঞ্জিত নেয় ৷ কলকাতায় নারী সত্যাগ্রহ সমিতি প্রতিষ্ঠায় নানা অঞ্চলে নানা মিছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সামিল হয় এবং বহু নারী আন্দোলনের যুক্ত হন এছাড়াও কমলা নেহেরু স্বরূপ সরোজিনী নাইডু, লেনি সেনগুপ্ত, বাসন্তী দেবী , উর্মিলা দেবী নারী নেতৃত্বের হাত ধরে গান্ধীজীর অনুপ্রেরণায় সরোজিনী নাইডু রাষ্ট্রীয় স্ত্রী সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করেন ৷ এমনকি বাংলায় কৃষক পরিবারের নারীরা ও গান্ধীজীর আন্দোলনে সাড়া দিয়ে আন্দোলনে পুরো ভাগে আসেন ।
গান্ধীজী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সর্বশেষ এবং বৃহৎ আন্দোলন ছিল ভারতছাড়ো আন্দোলন এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশজুড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা অপুরতানের রূপ নেয় ৷ বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীর জনগণ এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল এবং এর মধ্যে কৃষক শ্রমিক শ্রেণী, নারী ও ছাত্র সমাজের ভূমিকা ও অবশ্য উল্লেখযোগ্য দাবি রাখে ৷
ভারতছাড়ো আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য ৷ ভারতবাসী কোন এক জায়গা থেকে উষা মেহতা আন্দোলনকারীদের জন্য গোপনে বেতার কেন্দ্র পরিচালনা করতেন ৷ অরুনা আশফ আলীর মত সমাজবাদ নেত্রীর পরিচালনায় কেন্দ্রীয় দল যারা ভারত ছাড়ো নাসকতামূলক কটি যুক্ত হয়েছিল ৷ সুচিতা সেন, তুই পালনী এবং অন্যান্যদের দ্বারা পরিচালনায় গান্ধীবাদী দল গঠনমূলক কাজে যুক্ত ছিল ৷ আসামেও ১৩ বছর এর কিশোরী কনকলভ বারুয়ী, পাঞ্জাবি গৃহবধূ ভোলেরশ্বরী ফুলতলা প্রমূখ আন্দোলনের অংশ নিয়েছিলেন ৷ ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ২৯ এ সেপ্টেম্বর ৭৩ বছর বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা থানা দখল করতে গিয়ে মেদিনীপুরের তমলুকে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ৷ গান্ধীজীর অনুপ্রেরণায় বাংলায় মহিলা স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে ভগিনী সেনা গঠিত করে ৷
তথ্যসূত্র:
- "The Story of My Experiments with Truth" by Mahatma Gandhi
- "India's Struggle for Independence" by Bipan Chandra
- "The Discovery of India" by Jawaharlal Nehru
- "Freedom at Midnight" by Larry Collins and Dominique Lapierre
- "Women in Indian National Movement: Unseen Faces and Unheard Voices, 1930-42" by Suruchi Thapar-Björkert