ইউরোপে সংহতি সাধনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূমিকা।
হল্যান্ডের ম্যাস্ট্রিক্ট শহরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনের উদ্দেশ্যে ১৯৯১ সালে ডিসেম্বর মাসে একটি চুক্তি সম্পাদন করে। ১৯৯৩ সালের ১লা নভেম্বর থেকে এই চুক্তি কার্যকর হয়। এঐ ম্যাস্ট্রিট চুক্তি অনুযায়ী ইউরোপিয়ান গোষ্ঠী, একটি অভিন্ন বৈদেশিক ও নিরাপত্তা নীতি এবং বিচারের ক্ষেত্রেও সদস্য রাষ্ট্রদের সহযোগিতার উপর ভিত্তি করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই চুক্তিতে ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য একটি সাধারণ পুলিশ বাহিনী, বিদেশ ও প্রতিরক্ষা নীতি গ্রহণের জন্য অঙ্গীকার করা হয়। চুক্তিতে আরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলি যাতে একই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে হাজির হতে পারে সে বিষয়ে ইউরোপীয় মন্ত্রী পরিষদ সুপারিশ করবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাংগঠনিক কাঠামো: ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাংগঠনিক কাঠামো নিম্ন আলোচনা করা হল-
>(ক) ইউরোপীয় সংসদ: ইউরোপীয় গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে একমাত্র নিবাচিত প্রতিষ্ঠান হল ইউরোপীয় সংসদ। ইউরোপীয় সংসদে সদস্য সংখ্যা বর্তমানে ৭৩২জন। সদস্যগণ পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। সংসদের ভূমিকা মূলত পরামর্শদান এবং তত্ত্বাবধানমূলক।
>(খ) ইউরোপীয় আদালত: ইউরোপীয় আদালত ইউরোপীয় গোষ্ঠীর আইনগুলি সম্পর্কে চূড়ান্ত মতামত প্রদানের অধিকারী। বস্তুত আদালতে হল ইউরোপীয় গোষ্ঠীর একটি শক্তিশালী সংস্থা যার প্রধান কাজ হল প্রতিদ্বন্দ্বী স্বার্থগুলির মধ্যে বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা করা। বিচার অনুষ্ঠিত হয় গোপনে, তবে রায় দেওয়া হয় প্রকাশ্য অধিবেশনে। বিচারপতিদের সংখ্যাগরিষ্ঠায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়
>(গ) অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমিতি: অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমিতি চার বছরের জন্য মন্ত্রী পরিষদ কর্তৃক নিযুক্ত হয়। এটি মূলত একটি পরামর্শদাতা কমিটি নীতি সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রস্তাব প্রণয়নের সময়ে কমিশনকে এর পরামর্শ নিতে হয়।
(ঘ) হিসাব পরীক্ষকদের সভা: হিসাব পরীক্ষকদের সভা হল গোষ্ঠীর আর্থিক বিষয়ের নজরদার। প্রতিটি দেশ থেকে একজন করে প্রতিনিধি নিয়ে এই সংস্থা গঠিত হয়। সদস্যদের কার্যকালের মেয়াদ ছয় সম্বর।
(ঙ) কমিশন: কমিশন ২৫জন সদসা নয়ে গঠিত। সদস্যদের বলা হয় কমিশনার। সদস্য রাষ্ট্রগুলি এদের নিযুক্ত করে। প্রত্যেক রাষ্ট্র একজন করে প্রতিনিধি এই সংস্থা প্রেরণ করে। এই কমিশনারগণ রয়েছেন শুধু নিজ দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য নয়, সাধারণ গোষ্ঠী স্বর্ণের অনুকূল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য এরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ এবং পারদর্শী।
(চ) মন্ত্রী পরিষদ: ইউরোপীয় গোষ্ঠীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত হল মন্ত্রী পরিসদ। এই সংস্থার মধ্যে দিয়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলির জাতীয় স্বার্থের প্রতিফলন ঘটে এবং এগুলিকে একটি সাধারণ গোষ্ঠীগত স্বার্থে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করা হয়।
মূল চ্যালেঞ্জসমূহ: ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউরোপের সংহতিকরণে ইতিবাচক ভূমিকা নিলেও এই সংহতিকরণ প্রয়াসের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে নানা চ্যালেঞ্জ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনের পর নতুন করে জাতিসত্তার ভাবাবেগ সংহতিকরণের প্রক্রিয়াকে আলেঞ্জ ছুড়েছে। সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সংহতির ব্যাপ্তি ও গভীরতাকে কেন্দ্রে করে মতপার্থক্য রয়েছে। অভিন্ন মুদ্রা ও পাংথ ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর সদস্য রাষ্ট্রগুলির সাধারণ মানুসের মধ্যে নতুন করে জাতিসত্তার ভাবাবেগ সৃষ্টি হয়েছে। এই জাতিসত্তার ভাবাবেগকে কাটিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংহতিকরণের গতি বজায় রাখা অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
ঠান্ডাযুদ্ধের পর ইউরোপীয় নিরাপত্তার স্বনির্ভরশীলতার ধারণা বিকাশ লাভ করলেও বাস্তবে কিন্তু দেখা যায় ইউরোপীয় কমিউনিটি নিজস্ব মহাদেশীয় সমস্যা সমাধানে বার্থ। ইউরোপীয় কমিউনিটি যখন যুগোস্লাভিয়া সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্র সংঘের কাছে আবেদন জানায় তখনই ইউরোপীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যর্থতা প্রমাণিত হয়ে যায়।