আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাঙ্ক-এর পারস্পরিক নির্ভরতার তত্ত্বটি আলোচনা করো। Andre Gunder Frank's theory of interdependence

Andre Gunder Frank's theory of interdependence

 আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাঙ্ক-এর পারস্পরিক নির্ভরতার তত্ত্বটি আলোচনা করো।


উত্তর:- নির্ভরতার তত্ত্ব উদারনীতিবাদ ও নয়া উদারনীতিবাদী তত্ত্বকে সমালোচন করে গড়ে উঠেছিল। উদারনৈতিক আধুনিকীকরণ তত্ত্ব পৃথিবীকে উন্নত এবং অনুন্নত দুটি ভাগে ভাগ করেছে। এরা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির অনুন্নতির জন্য কতকগুলি আভ্যন্তরীন কারণের কথা বলেছেন- (১) বিশাল জনসংখ্যা (২) স্থিতিশীল সামাজিক কাঠামো (৩) কৃষি সংস্কারের অভাব (৪) অযোগ্য নেতৃত্ব (৫) দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্র (৬) শিক্ষা এবং ঊর্ধ্বমুখী সংস্কৃতির অভাব (৭) ভাগ্যের কাছে আত্মসমর্পণ প্রভৃতি। কিন্তু নির্ভরতার তত্ত্ব উদারনীতিবাদীদের এই ধারণাকে সমালোচনা করে বিপরীত ধারণা দিয়েছে। নির্ভরতার তত্ত্ব অনুন্নয়ন এবং উন্নয়নকে দেখেছেন অনুন্নতদের পরিপ্রেক্ষিত থেকে। তাই নির্ভরতা তত্ত্বের অপর নাম 'voice from the periphery'।


নির্ভরতার তত্ত্বের উদ্ভবের অন্যতম কারণ ছিল রাষ্ট্রসংঘের প্রতিষ্ঠিত ECLA প্রস্তাবিত কর্মসূচির ব্যর্থতা। আর্জেন্টিনার অর্থনীতিবিদ রাউল প্রেবিশের নেতৃত্বাধীন এই কমিশন আন্তর্জাতিক অর্থনীতির বিদ্যমান শ্রম বিভাজনকে লাতিন আমেরিকার অনুন্নয়নে মূল কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে এই দেশগুলি ছিল মূলত কাঁচামালের জোগানদার এবং উন্নত বিশ্ব থেকে শিল্পজাত দ্রব্যের আমদানিকারক। যা শিল্পদ্রব্য রপ্তানিকারকের পক্ষে সুবিধাজনক এবং কাঁচামাল রপ্তানিকারকের পক্ষে ক্ষতিকারক।


সুতরাং লাতিন আমেরিকার প্রয়োজন তৈরি দ্রব্যের আমদানি কমিয়ে শিল্পায়ন। এই ধরনের চিন্তাভাবনা প্রথমদিকে জনপ্রিয় হলেও পরবর্তীকালে ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়। এই প্রেক্ষাপটে নতুন কিছু তাত্ত্বিকগণ যারা মার্ক্সবাদ ও সমাজতন্ত্রের আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত তারা ধনতান্ত্রিক বা পুজিবাদী অর্থনীতিকে অনুন্নয়নের কারণ হিসাবে চিহ্নিত করে নির্ভরতা তত্ত্বের উদ্ভব ঘটালেন। এই প্রসঙ্গে মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক আঁদ্রে গুন্ডার ফ্রাঙ্কের অবদান স্মরণীয়।


আঁন্ডে গুন্ডার ফ্রাঙ্ক ১৯৬০ এর দশকে তার 'Capitalism and under Development in Latin America' শীর্ষক গ্রন্থে দচ্ছিল আমেরিকার কয়েকটি দেশের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে যে নির্ভরতার তত্ত্ব অবতারণা করেছিলেন, তা আন্তর্জাতিক আর্থ-রাজনৈতিক আলোচনায় যথেষ্ট সারা ফেলেছিল। ফ্রাঙ্কের মতে কোনো একটি সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত গরীব দেশের অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতার কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে সমকালীন বিশ্ব পুজিবাদী কাঠামোর বিশ্লেষণ একান্তভাবে প্রয়োজন।


আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাঙ্ক মনে করেন যে বিশ্ব পুজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আসলে দুটি ভাগে বিভক্ত-কেন্দ্র ও প্রান্ত। আন্তর্জাতিক পুজিবাদী কাঠামোয় কেন্দ্র সাধারণত শিল্পোন্নত পুজিবাদী স্বল্প সংখ্যক দেশকে লক্ষ্য করা যায়। অন্যদিকে এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির অবস্থান প্রান্তে। কেন্দ্রীয় অর্থনীতিগুলি প্রান্তিক অর্থনীতিগুলিতে যথেষ্ট পরিমাণে পুজি বিনিয়োগ করতে সক্ষম এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তি তাদের আয়ত্তে রেখেছে। এই পুজি ও প্রযুক্তির সাহায্যে এই দেশগুলি প্রান্তিক অর্থনীতিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এমনকি কেন্দ্র অর্থনীতির দেশগুলি প্রান্তিক অর্থনীতির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলেও এই কেন্দ্রীয় অর্থনীতিগুলি নিজেদের সমৃদ্ধিকে আরো বৃদ্ধির চেষ্টা করে। অপরপক্ষে প্রান্তিক অর্থনীতিগুলি দারিদ্রের কারণে পুজির অভাবে ভোগে বলে অনেক সময় শিল্পোন্নত পুজিবাদী দেশগুলি থেকে তারা সরাসরি বিদেশি পুজির বিনিয়োগকে স্বাগত জানায় যা জানাতে বাধ্য হয়।



সমালোচনা: নির্ভরতার তত্ত্ব বিভিন্ন দিক থেকে সমালোচিত হয়েছে।

  •  প্রথমত, নির্ভরতার তত্ত্ব কেন্দ্র ও প্রান্তের মধ্যে সম্পর্ক গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেছে। কিন্তু প্রান্তের দেশগুলির মধ্যেকার সম্পর্ক আলোচনা করেনি।
  •  দ্বিতীয়ত, নির্ভরতার তত্ত্ব কেন্দ্রীয় অঞ্চলের দেশগুলির অভ্যন্তরীন কাঠামো ব্যাখ্যা করেনি।
  •  তৃতীয়ত, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার অনেকগুলি দেশ অভাবনীয় অর্থনৈতিক সাফল্য লাভ করেছে। কিন্তু নির্ভরতার তত্ত্বে এর কোনো ব্যাখ্যা দেখতে পাওয়া যায় না।
  •  চতুর্থত, নির্ভরতার তত্ত্ব সোভিয়েত ও চীনের প্রভুত্বমূলক আচরণ বিশ্লেষণে সাহায্য করে না।


সমালোচিত হলেও নির্ভরতার তত্ত্বের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যাবে না। বর্তমান শতকে বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে নতুন ধারা দেখা দিয়েছে যেটি মূলত 'বিশ্ববাদ' ধারা নামে পরিচিতি এই মত অনুযায়ী সম্প্রতিক বিশ্ব রাজনীতির ধারা পর্যালোচনা করতে গেলে বিশ্ব পূজিবাদী ব্যবস্থার প্রকৃতি ও গতিময়তা থেকে শুরু করতে হবে। আর সেই সূচনার ক্ষেত্রে নির্ভরতার তত্ত্ব একার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কেন্দ্র ও প্রান্তের মধ্যে যে প্রভুত্ব ও বশ্যতা সম্পর্ক তা কিভাবে দূর করা সম্ভব সে বিষয়েও নির্ভরতার তত্ত্ব আলোকপাত করেছে।

About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟