কনস্টান্টিনোপলের পতন (1453) এবং তার তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনা কর
কনস্টানটিনোলের পতন এবং তার তাৎপর্য
১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে অটোমান তুর্কি সুলতান দ্বিতীয় মহম্মদ পূর্ব রোমান (বা বাইজানটাইন) সাম্রাজ্যের সম্রাট একাদশ কনস্টানটাইনকে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করে রাজধানী কনস্টানটিনোপ্ল অধিকার করেন। কনস্টানটিনোপ্লের পতনের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের প্রায় সহস্র বৎসরব্যাপী অস্তিত্বের অবসান ঘটে। ইতিপূর্বে অটোমানরা আনাতোলিয়ায় (এশিয়া মাইনরে) আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছিল। বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের ক্রমবর্ধমান দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করেই তারা ওই অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিল। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের ঘটনা ছিল একটি ক্ষয়িষ্ণু সাম্রাজ্যের অন্তিম এবং অবশ্যম্ভাবী পরিণতি।
ইতিপূর্বে ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে বর্বর নায়ক ওডোআকার শেষ রোমান সম্রাট রোমুলাসকে পরাস্ত ও সিংহাসনচ্যুত করলে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের আনুষ্ঠানিক পতন ঘটেছিল। পঞ্চম শতাব্দী অবসানের পূর্বে একাধিক বর্বর জাতি ওই সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের ওপর প্রাধান্য বিস্তার এবং রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। অতঃপর অস্ট্রোগথরা ইতালিতে; ভিসিগথ, বার্গান্ডিয়ান এবং ফ্রাঙ্করা গলদেশে; ভিসিগথদের একটি প্রশাখা আইবেরীয় উপদ্বীপে (স্পেন ও পোর্তুগাল) এবং জুট ও অ্যাঙ্গোলরা ব্রিটেনে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের অবসান ঘটলেও পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য আরও প্রায় হাজার বছর যাবৎ অস্তিত্ব রক্ষায় সক্ষম হয়েছিল। শুধু রাজনৈতিক অস্তিত্ব নয়, বাইজানটিয়াম অচিরেই গ্রিকো-রোমান সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়। একটি সমন্বয়কামী সংস্কৃতির প্রভাব অনুভূত হয়েছিল সাহিত্যে, চিত্রকলায়, ভাস্কর্যে এবং স্থাপত্যে। ঐস্লামিক সংস্কৃতির প্রভাব থেকেও এ সংস্কৃতি পুরোপুরি মুক্ত থাকতে পারেনি, পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ও রাজ্যসমূহে ততদিনে ইসলামের প্রসার ঘটেছে। আরবি ভাষা ও বিজ্ঞানচর্চা (বিশেষত ভেষজ ও চিকিৎসাবিজ্ঞান) আত্মস্থ করতে বাইজানটাইন পণ্ডিতরা দ্বিধা বোধ করেননি। রাজনৈতিক, সামরিক, ধর্মীয় ও অন্যান্য বহু কারণে ত্রয়োদশ শতক থেকে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের দুর্বলতা প্রকট হয়ে উঠতে থাকে, অবশেষে পঞ্চদশ শতকের মধ্যভাগে অটোমান তুর্কিরা এই একদা সমৃদ্ধ নগর সভ্যতার ওপর চরম আঘাত হানতে সক্ষম হয়।
কনস্টানটিনোপ্ল বিজয়ের মাধ্যমে তুর্কিরা এক হাজার বছরের প্রাচীন বাইজানটাইন সাম্রাজ্য ও সংস্কৃতির অবসান ঘটিয়েছিল। আলোচ্য সময় থেকে এই মহতী নগরী আর গ্রিকো-রোমান সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র ছিল না। এই নগরীর গ্রিক পণ্ডিতদের একাংশ আত্মরক্ষার্থে তাঁদের পুথিপত্র নিয়ে ইতালির বিভিন্ন নগর-রাষ্ট্রে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। সেখানে তাঁরা নতুন করে জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার সূত্রপাত করেছিলেন- এইভাবে ইতালিতে রেনেসাঁস-এর সূত্রপাত ঘটেছিল। এইসব জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা তাঁদের সঙ্গে বিলুপ্তপ্রায় বহু প্রাচীন গ্রিক ও রোমান পুথি-পুস্তক নিয়ে এসেছিলেন। ইতালির মানুষ এঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে দ্বিধা করেননি এবং এঁদের অনেককেই তাঁরা শিক্ষক হিসাবে বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ করেছিলেন। স্বভাবত এঁদের উদ্যোগে নতুন করে প্রাচীন গ্রিক ও লাতিন সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্প প্রভৃতির চর্চা শুরু হয়। এই চর্চার ফলে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নবজাগরণের প্রসার ঘটে। ইংরেজ ঐতিহাসিক লর্ড অ্যাক্টন (Lord Acton) মনে করেন যে, ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ থেকেই আধুনিক ইউরোপের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এই আধুনিক মহাদেশের অন্যতম স্তম্ভ ছিল একটি সুশিক্ষিত আমলাতন্ত্র, স্থায়ী সৈন্যবাহিনী, নিয়মিত ও সুষ্ঠু প্রশাসন ও কর- ব্যবস্থা, সম্প্রসারিত বাণিজ্য, শিল্পোন্নয়ন ও কৃষির অগ্রগতি। তুর্কিদের কাছে ইউরোপ শিখেছিল দুর্ভেদ্য দুর্গ নির্মাণ।
সাম্প্রতিককালের ইতিহাসবিদদের একাংশ এই মতের বিরোধিতা করেছেন। তাঁরা মনে করেন কনস্টানটিনোপ্লের পতনের পূর্বেই ইতালিতে রেনেসাঁসের সূচনা হয়েছিল। চতুর্দশ শতাব্দীতে বিশিষ্ট গ্রিক পণ্ডিত ক্রাইসোলোরাস (Chrysolorus) ভেনিসে গ্রিক চর্চার সূচনা করেছিলেন। যাই হোক, উপরোক্ত বিশ্লেষণ সত্ত্বেও পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য ও তার ঐতিহ্যমণ্ডিত রাজধানীর পতনের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। সামরিক ও ভৌগোলিক দিক থেকে কনস্টানটিনোপ্লের অবস্থান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর পার্শ্ববর্তী দার্দানেলিস ও বসফরাস প্রণালীর মাধ্যমে কনস্টানটিনোপ্ল ভূমধ্যসাগর ও কৃষ্ণসাগর যুক্ত ছিল। অটোমানরা এই জলপথের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করায় ইউরোপ থেকে ভূমধ্যসাগরের প্রবেশ পথে তুর্কি অধিকার হয় প্রধানত এই কারণেই ইউরোপের প্রথম যুগের নৌশক্তিগুলি (স্পেন ও পোর্তুগাল) নতুন বাণিজ্যপথের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। এদের এই প্রচেষ্টার ফলশ্রুতি ছিল কলম্বাস কর্তৃক আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কার, এবং ভাস্কো-ডা-গামার উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে ভারতে আসার সমুদ্রপথ আবিষ্কার।
কনস্টানটিনোপ্ল অধিকার করার সময় অটোমান তুর্কিরা হত্যা, ধ্বংস, লুঠতরাজ আর অগ্নিসংযোগের নিদারুণ তাণ্ডবলীলা চালিয়েছিল। সামরিক বলে বলীয়ান অটোমানদের চাপের সামনে নতিস্বীকার করে রোমানরা সাত সপ্তাহের মধ্যে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। ইতিপূর্বে বাইজানটাইন রাজধানী বহুবার অবরুদ্ধ হয়েছিল কিন্তু কখনোই তার চূড়ান্ত পতন ঘটেনি। যাই হোক, ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে বিজয়ী মুসলমান বাহিনী বীরদর্পে রাজধানীর বিশাল ও দুর্ভেদ্য প্রাচীর অতিক্রম করে নগরের প্রাণকেন্দ্রে প্রবেশ করেছিল। তারা হত্যা করেছিল পূর্ব রোমান সম্রাটকে, লুণ্ঠনলীলা চলেছিল অবাধে (২৭ মে, ১৪৫৩)।
কনস্টানটিনোপ্লে তুর্কিরা তাদের বিজয়-ধ্বজা উড়িয়ে দেওয়ার পরবর্তীকালে তারা সেখানে একদিকে যেমন একটি শক্তিশালী ও কার্যকরী প্রশাসন গড়ে তুলেছিল, অন্যদিকে তারা সেখানে রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক প্রয়োজনের বাস্তব তাগিদে পরধর্ম ও মতের প্রতি সহিষ্ণুতার বাতাবরণ সৃষ্টি করেছিল। তুর্কি নব বিজিত অঞ্চলে মিলেট (Millet) ব্যবস্থার প্রচলন করলে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ উপকৃত হয়েছিল। আর্মেনিয়ান, গ্রিক অন্যান্য খ্রিস্টানরা এবং ইহুদিরা তাদের ধর্মগুরু নির্বাচনের ক্ষেত্রে অবাধ স্বাধীনতা লাভ করেছিল। ইহুদিরা স্পেন থেকে বিতাড়িত হয়ে কনস্টানটিনোপ্লে আশ্রয় লাভ করে সেখানে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল; নানা শিল্পজাত পণ্য উৎপাদনেও তারা প্রয়াসী হয়েছিল। এদের কাছ থেকে বাণিজ্যিক মূলধন এবং কারিগরি কুশলতা (know-how) লাভ করে অটোমানরাও লাভবান হয়েছিল।
কনস্টানটিনোপ্ল অধিকারের ফলে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যের ওপর অটোমানদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রাচ্যের নানাবিধ বাণিজ্যপণ্য এখান থেকে রপ্তানি হত, এসবের মধ্যে অন্যতম ছিল রেশম, সুতিবস্ত্র, মশলা ও নানাবিধ কাঁচামাল (raw materials)। অতঃপর এগুলি পশ্চিম ইউরোপে আবার রপ্তানি করা হত। কিন্তু এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে এই অঞ্চলে পশ্চিমের মতো কারিগরি বা প্রযুক্তিগত এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বা অগ্রগতি প্রায় কিছুই হয়নি, ফলে এখানে কোনো বৃহৎ শিল্প গড়ে ওঠেনি।
বিজিত অঞ্চলে সংস্কৃতি চর্চা পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। এখানকার সাহিত্য, শিল্প ও চিত্রকলায় পরবর্তীকালে গ্রিক,-রোমান ও ঐস্লামিক সংস্কৃতির মিশ্র প্রভাব অনুভূত হয়েছিল। শিল্প ও স্থাপত্যের নিদর্শনগুলি আজও ইস্তাম্বুলে (অতীতের কনস্টানটিনোপ্লে) আগত পর্যটকদের বিস্মিত ও বিমুগ্ধ করে। আরব পণ্ডিতকৃত গ্রিক বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা ইউরোপের গবেষকদের প্রভাবিত করেছিল, তাদের চিকিৎসাবিজ্ঞান ইতিপূর্বেই ইউরোপে গৃহীত হয়েছিল। তুর্কি সাম্রাজ্যের অন্যতম ভিত্তি ছিল সৈন্যবাহিনী। প্রথম যুগে হালকা অস্ত্র- সজ্জিত ও দ্রুতগামী অশ্বারোহীদের উপর নির্ভরশীল হলেও পরবর্তীকালে তারা ইউরোপীয়দের ধাঁচেই বৃহৎ সেনাবাহিনী গড়ে তোলে। অধীনস্থ সামন্তরাই সৈন্যের জোগান দিতেন। কিন্তু ইউরোপীয়দের তুলনায় এই বাহিনী ছিল বহুগুণ ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন ও সুশৃঙ্খল। প্রধানত এই বাহিনীর সাহায্যে তুর্কিরা পূর্ব ও দক্ষিণ ইউরোপে প্রাধান্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। সম্প্রসারিত হয়েছিল অটোমান তুর্কি সাম্রাজ্যের সীমানা। জ্যানিসারি সৈন্যরা ছিল এই বাহিনীর অন্যতম স্তম্ভ।
কনস্টানটিনোপ্ল দখলের সঙ্গেই তুর্কি বিজয়রথের চাকা স্তব্ধ হয়ে যায়নি। তুর্কি বিজয় অভিযান পরিচালিত হয়েছিল দক্ষিণ ইউরোপের অন্যত্র। অটোমানরা একে একে বেলগ্রেড নগরী ও রোল্স দ্বীপ জয় করতে সক্ষম হয়। উপর্যুপরি দুইবার অবরুদ্ধ হয় হ্যাপ্সবার্গ সাম্রাজ্যের রাজধানী ভিয়েনা। ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে মোহকাসের যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে হাঙ্গেরি অটোমানদের পদানত হয়। ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মোরিয়া থেকে ভিনিসীয়দের উচ্ছেদ করা হয়। ঈজিয়ান দ্বীপপুঞ্জণ্ড তাদের হস্তচ্যুত হয়। অতঃপর গ্রিস তুর্কি অধিকারে আসে। অটোমান সাম্রাজ্যের সীমানা দক্ষিণ ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রসারিত হয়। বল্কান অঞ্চলে তুর্কি প্রভাব ইতিপূর্বেই বিস্তৃত হয়েছিল। সুলতান সুলেমানের নেতৃত্বাধীন তুর্কি শক্তি প্রায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। এইসময় থেকেই স্পেন ও অস্ট্রীয় পবিত্র রোমান সম্রাট পঞ্চম চার্লস সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার কথা ভেবে ভীতসন্ত্রস্ত বোধ করতে থাকেন। কিন্তু এই সংকট মুহূর্তে ইউরোপ ঐক্যবদ্ধভাবে বহিঃশত্রুর মোকাবিলা করতে পারেনি। বিশেষত অস্ট্রিয়ার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ফরাসি রাজ প্রথম ফ্রান্সিস উদীয়মান শক্তি তুরস্কের সঙ্গেই মিত্রতায় আবদ্ধ হন। সুলতান সুলেমানের মৃত্যুর (১৫৫৬) পরেও সুলতান দ্বিতীয় সেলিমের শাসনকালেও তুর্কি সম্প্রসারণ প্রায় অব্যাহত থাকে। এই পর্বে ভেনিস ও সাইপ্রাস অধিকৃত হয়। মাল্টা ও ক্রিট দ্বীপের ওপর অটোমান অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকে। হাঙ্গেরির উপর অধিকার আরও দৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপিত হয়। অবশেষে পোপ পঞ্চম পায়াসের উদ্যোগে ভেনিস ও স্পেনকে নিয়ে তুর্কি-বিরোধী লিগ গঠিত হলে তুর্কি অগ্রগতি, বিশেষত তাদের নৌবহরের অগ্রগতি সাময়িককালের জন্য স্তব্ধ হয়।