গজনীর সুলতান মামুদের থেকে মোহাম্মদ ঘুরির আক্রমণ কোন কোন ক্ষেত্রে ভিন্ন ছিল? মোহাম্মদ ঘুরির সাফল্যের কারণগুলি লেখ
ভারতবর্ষের ইতিহাসে তাৎপর্য বহনকারী ঘটনা হলো সুলতান মামুদ ও মোহাম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমণ । মহম্মদ ঘুরির কৃতিত্ব বিচার করতে গিয়ে তার পূর্ববর্তী আক্রমণকারী সুলতান মামুদের সাথে তুলনামূলক আলোচনা অনিবার্যভাবে এসে পড়ে ৷ তবে এই দুই যোদ্ধার তুলনামূলক বিচার করতে গিয়ে ঐতিহাসিক দ্বিমত পোষণ করেছেন ৷ স্ট্যনলি লেনপুল সুলতান মামুদকে মহাম্মদ ঘুরির তুলনায় অনেক বেশি সফল ও প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করেন ৷ ঐতিহাসিক সৈয়দ জামাত মনে করেন মহাম্মদ ঘুরির ছিলেন একজন সাধারণ সমনায়ক সুলতান মামুদের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে ধারাবাহিক সাফল্য তিনি পাননি ৷
অধ্যাপক ইরফান হাবিবের মতে কয়েকটি যুদ্ধে মহাম্মদ ঘুরি পরাজিত হয়েছিলেন ৷ এটা যেমন সত্য তেমনি এটাও সত্য যে প্রকৃত যোদ্ধার মতো তিনি পরাজয়ের গ্লানি মুছে ফেলে তা নতুন উদ্যমের পরবর্তী অভিযানের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন এছাড়াও কর্ম কৃতিত্বের নয় ৷ তাছাড়া মনে রাখা দরকার যে মামুদের তুলনায় মহাম্মদ ঘুরি কে ভারতে অনেক বেশি বড় ও সুসংগঠিত রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছিল ৷
আরও পড়ুন
যোদ্ধা বা সেনাপতি হিসেবে পিছিয়ে পড়লেও রাজনীতিবিদ ও সংগঠক হিসেবে মহম্মদ ঘুরি সুলতান মামুদকে অতিক্রম করে যেতে পেরেছেন ৷ সুলতান মামুদের ভারত আক্রমণের মূল প্রেরণা ছিল এ প্রদেশের অতুল সম্পদ ৷ ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনের কোন ইচ্ছাই তার ছিল না । অন্যদিকে মহম্মদ ঘুরেছিলেন রাজনৈতিক দূরদর্শীর অধিকারী ভারতের সম্পদ নয় ভারতের মাটিতে নতুন রাজ্যের ভিত্তি স্থাপনই ছিল তার লক্ষ্য ৷
স্বরাজ্য থেকে দূরবর্তী ভূখণ্ডে নতুন শাসনতান্ত্রিকভিত্তি রচনার জন্য যে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার প্রয়োজন মহম্মদ ঘুরির চরিত্রে তার অভাব ছিল না । অন্যদিকে সুলতান মামুদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা যথেষ্ট অভাব ছিল ৷ সাহিত্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সুলতান মামুদ ছিলেন অনন্য কৃতিত্বের অধিকারী ৷ তার আমলে একাধিক জ্ঞানীগুণী পণ্ডিত দার্শনিক গজনির রাজসভায় উজ্জ্বল করেছিলেন ৷ তাই ঐতিহাসিক লেনপুল মনে করেন শিল্প সাহিত্যের অনুরাগী হিসাবে সুলতান মামুদের তুলনায় মহম্মদ ঘুরির ছিলেন নগণ্য ৷
মহম্মদ ঘুরীর সাফল্যের কারণ :-
ভারতের বিরুদ্ধে মোহাম্মদ ঘুরির সাফল্য তথা সামরিক ঐতিহ্যের অধিকারী ভারতীয় হিন্দুদের পরাজয় বাস্তব হলেও কিছুটা আশ্চর্যজনক ৷ শিক্ষা সংস্কৃতিতে সুদীর্ঘ ঐতিহ্যের ধারক বিশাল আয়তন জলবহুল এমন একটি দেশের নবউল্থিত তুর্কি জাতির হাতে দ্রুত পতন সত্যই অভূতপূর্ব একটি ঘটনা ৷ ঐতিহাসিকরা এই বিচিত্র পরিণতির কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে একাধিক তথ্য ও গুরুত্বের অবতারণা করেছেন ৷
ইরফান হাবিব মন্তব্য করেছেন যে এত বিশাল একটি দেশ যার বিপুল জনসংখ্যা এবং শিক্ষা সংস্কৃতির বিচারে অগ্রণী উচ্চতর শ্রেণীর অধিকারী । সমকালের বিচারে যার জ্ঞান-বিজ্ঞানের মান যথেষ্ট উন্নত একটি অতি সাধারণ মানের আক্রমণ কারীর হাতে সে দেশের এত সহজে পরাজিত হওয়ার ঘটনা মানব সভ্যতার ইতিহাসে কদাচিৎ ঘটেছে ৷ ভারতীয় সমাজ ছিল এক অচলায়তন এবং বর্ণবৈষম্যের ভরা অন্যদিকে ঘুরির বিজয় ছিল অসাম্প্রদায়িক ও সঠিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ।
সমকালীন ভারতের সমাজে অর্থনীতি ধর্ম ইত্যাদি নানা কারণে তুর্কিদের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের প্রতিরোধ দুর্বল হয়েছিল ৷ ভিন্সেন্ট স্মিথ লেনফুল প্রমূখ মোহাম্মদ ঘুরির সাফল্যের কারণ হিসেবে হিন্দুদের তুলনায় তাদের সবল দেহ অসীম সাহস অদম্য মনোবলের কথা উল্লেখ করেছেন ৷ ঐতিহাসিক এলফিন স্টোন লিখেছেন দুর্ধর্ষ সেলজুক তুর্কি এবং তাকারদের বিরুদ্ধে বিজয়ী মুসলমান সৈনিকদের তুলনায় অপেক্ষা কৃত ভদ্র ও নম্রমনা হিন্দুদের পরাজয় ছিল স্বাভাবিক পরিণতি ৷
অধ্যাপক নিজামি তৎকালীন ভারতবর্ষের ত্রুটিপূর্ণ সমাজব্যবস্থাকে ভারতীয়দের পরাজয়ের প্রধান কারণ বলে উল্লেখ করেছেন ৷ তিনি লিখেছেন কঠোর জাতিভেদ ও বর্ণবৈষম্য ভারতের সামাজিক জীবনে ভেদাভেদের যে প্রাচীর তুলেছিল তা সমগ্র সামরিক ব্যবস্থা টাকে রুগ্ন ও দুর্বল করেছিলেন ৷ ভারতীয় সমাজে যে অবক্ষয় এসেছিল তাতে লাভবান হয়েছিল আক্রমণকারী মোহাম্মদ ঘুরির সেনাবাহিনীরা ৷
উপরীয়ক্ত আলোচনা শেষে এ কথা বলা যায় মোহাম্মদ ঘুরির কর্তৃক ভারত বিজয় ভারতের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে ৷ তুর্কিদের সাফল্য ভারতের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে গভীরতর পরিবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে তুর্কি বিজয়ের ফলে ভারতের সামরিক সংগঠন ও যুদ্ধনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে ৷