পরবর্তী বৈদিক যুগের সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর
![]() |
ঋগবেদ পরবর্তী আর্য সমাজের গঠনে আসে পরিবর্তন। ঋগবেদ যুগে বর্ণপ্রথা সমাজে খুব অল্পই দেখা গিয়েছে বলে আপনারা জেনেছেন। সময়ের সাথে সাথে ধীরে ধীরে বর্ণভেদ প্রথা স্পষ্ট হতে থাকে। বংশানুক্রমিক পেশাজীবী সম্প্রদায়গুলোর উত্থান ঘটে। পুরোহিত এবং অভিজাত সম্প্রদায়ের জীবিকা এই সময় বংশগত হয়ে পড়ে। জীবিকার ভিত্তিতে বৈশ্য ও শূদ্ররাও বিভক্ত হতে থাকে। এ যুগের সমাজের মানুষ চারটি বর্ণে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এগুলো হচ্ছে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। এ যুগের সমাজে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। আর ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব ব্রাহ্মণের হাতে থাকায় এ যুগের ব্রাহ্মণদের ক্ষমতা প্রচুর বৃদ্ধি পায়। আর্য সমাজের প্রথমদিকে ধর্ম পরিচালনা করতে পারে এমন যাজক শ্রেণীর সংখ্যা ছিল ঘোলটি। ধীরে ধীরে বাকি পনেরটি যাজক শ্রেণীকে পিছনে ফেলে রেখে ধর্ম পরিচালনার প্রধান পুরোহিত হয়ে পড়ে ব্রাহ্মণরা। কৃষিকাজ সংক্রান্ত উৎসব অনুষ্ঠানে প্রধান পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করতেন ব্রাহ্মণ। রাজা যাতে যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারেন তার জন্য ব্রাহ্মণ প্রার্থনা করতেন। বিনিময়ে রাজাকে একটি অঙ্গীকার করতে হতো যে, তিনি ব্রাহ্মণদের কোনরকম ক্ষতি করবেন না। আর্য সমাজে চার বর্ণের যে বিভাজন আসে তাতে ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্যান্যদের ভূমিকার ব্যাপারটিও স্পষ্টভাবে দেখা যায় পরবর্তী বৈদিক যুগের সমাজে। এ যুগে ক্ষত্রিয়রা রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব লাভ করতেন। বৈশ্যরা ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। পরবর্তী বৈদিক যুগে বৈশ্যরাই ছিল একমাত্র শ্রেণী যাদের রাজস্ব দিতে হতো এবং এই রাজস্বের উপর নির্ভরশীল ছিলেন ক্ষত্রিয়রা। ক্ষত্রিয়দের কাছে বৈশ্যরা যাতে পদানত থাকে সেজন্য এই যুগে কয়েকটি আচার অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল। উল্লিখিত তিনটি উচ্চ বর্ণের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল। এই তিন বর্ণের মানুষেরা উপনয়ন বা পৈতা পড়তে পারতেন। এ অধিকার শূদ্রদের ছিল না। তবে, একথা মানতে হবে যে পরবর্তী বৈদিক যুগের সমাজে বর্ণভেদ প্রথা তেমন সুনির্দিষ্ট আকার ধারণ করতে পারেনি। তাই, বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে তখনও বিয়ে শাদী প্রথা চালু ছিল। কোথাও কোথাও কোন ক্ষত্রিয় এ যুগে ব্রাহ্মণের বদলে যাগ-যজ্ঞ পরিচালনা করতেন এবং বেদ পাঠ করতেন। তবে, সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে শূদ্রের তেমন কোন মর্যাদার আসন ছিল না। শুদ্র সম্বন্ধে বক্তব্য পাওয়া যায় 'ঐতরেয় ব্রাহ্মণ' গ্রন্থে। সেখানে বলা হয়েছে শুদ্র অন্যের দাস, যখন ইচ্ছা তাকে তাড়িয়ে দেয়া যায় বা হত্যা করা যায়। ধীরে ধীরে বর্ণগুলো বিভিন্ন বংশে চিহ্নিত হয়ে পড়ে। আর তার ফলাফল হিসাবে বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। বেদ পাঠ এবং ধর্ম কর্মে পুরোহিতের ভূমিকা পালন করেন ব্রাহ্মণরা। 'সূত্র' গ্রন্থগুলোতে বর্ণভেদ প্রথার বিবর্তনের মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়। 'মনুসংহিতা'-য় উল্লেখ করা হয়েছে- কিভাবে ব্রাহ্মণদের উত্থান ঘটে এবং বর্ণপ্রথার কঠোরতা আরোপিত হয়। শূদ্রদের গৃহস্থালি কাজে অংশ গ্রহণের স্বীকৃতি ছিল। সময়ের সাথে সাথে আর্য সমাজে শূদ্রদের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। অন্য বর্ণের লোকেরা তাদের স্কুলে অপবিত্র হবে এমন বিধানও জারি করা হয়। অর্থাৎ সমাজ বিধান অনুযায়ী উচ্চবর্ণের মানুষেরা ছিল 'পবিত্র'। অপবিত্র শূদ্রদের ছায়া মাড়ালে জাত যাবে তাদের। এর ফলে ছোঁয়াছুঁয়ির দোষ সমাজকে কলুষিত করে।
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
সমাজে মেয়েদের অবস্থান
ঋগবেদ পরবর্তী যুগের আর্য সমাজে মেয়েদের তেমন মর্যাদা দেয়া হতো না। কন্যা সন্তান জন্ম হওয়াকে অভিশাপ মনে করা হতো। এই সময়ের অন্যতম বিধানকর্তা ছিলেন ধর্মশাস্ত্রের পণ্ডিত 'মনু'। তাঁর মতে, নারীকে স্বাধীনভাবে বসবাস করতে দেয়া অনুচিত। বাল্যকালে মেয়েদের পালন করবে পিতা, যৌবনে স্বামী, আর বুড়ো বয়সে পুত্র। তবে এই যুগেও নারীদের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ ছিল। কেউ কেউ শিক্ষা ক্ষেত্রে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এ যুগের শাস্ত্র চর্চায় খ্যাতিলাভ করেছিলেন গার্গী ও মৈত্রেয়ী নামের দুই মহিলা। এ যুগে রাজা ও ধনী শ্রেণীর পুরুষেরা বহু বিবাহ করতে পারতেন। সমাজে একদিকে বাল্যবিবাহের প্রচলন ছিল; অন্যদিকে, নিষিদ্ধ ছিল বিধবা বিবাহ। নারীরা উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি লাভ করতে পারতেন না।
গোত্র ও আশ্রম প্রথাপরবর্তী ঋগবেদ যুগে গোত্র প্রথার উদ্ভব ঘটেছিল। আক্ষরিক অর্থে 'গোত্র' শব্দের অর্থ ছিল গরুর খোয়াড়। কিন্তু, পরবর্তীকালে গোত্র বলতে একই পূর্ব-পুরুষের উত্তরাধিকারীদের চিহ্নিত করা হতে থাকে। এক গোত্র থেকে অন্য গোত্রে যাওয়ার তেমন বাঁধা ছিল না। তবে, একই গোত্রের দু'জনের মধ্যে বিয়ে ছিল নিষিদ্ধ। ঋগ্বৈদিক যুগে আশ্রম প্রথা সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায়নি। কিন্তু, পরবর্তী বৈদিক যুগে আমরা আশ্রম প্রথা সম্বন্ধে ধারণা পাই। বৈদিক সাহিত্যে চারটি আশ্রমের উল্লেখ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে ব্রহ্মচারী (ছাত্র), গৃহস্থ, বাণপ্রস্থ ও সন্ন্যাস।
পরবর্তী বৈদিক যুগের মানুষের পোশাক এবং খাদ্য সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায় বৈদিক সাহিত্যে। জানা যায়, এ যুগের তুলা ও পশমী বস্ত্র আর্যদের পোশাক ছিল। নারী-পুরুষ উভয়েই অলঙ্কার ব্যবহার করতো। অলঙ্কার প্রধানত: স্বর্ণ দিয়ে তৈরি করা হতো। এ যুগে আর্যদের খাদ্য তালিকায় ছিল দুধের ননী, শাক-সব্জি, ফল ও মাংস ইত্যাদি।
ঋগবেদ-পরবর্তী আর্যদের সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে সে যুগের সাহিত্য থেকে ধারণা লাভ করা যায়। এ সময়ে আর্য সমাজের গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল বর্ণ প্রথার অবস্থান। চার বর্ণে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল সমাজ। পেশার বিচারে এভাবে সমাজকে বিভক্ত করা হয়েছিল। অন্যদিকে, পিতৃতান্ত্রিক আর্থ সমাজে নারীর অবস্থান নিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে। সমাজে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান বৃদ্ধি পেতে থাকে।