বিশ্বায়ণ বলতে কী বোঝ। সমকালীন সংস্কৃতির উপর বিশ্বায়ণের প্রভাব লেখো ।

বিশ্বায়ন একটি আধুনিক ধারণা। একুশ শতকের আলোচনায় এটি একটি মূখ্য বিষয়। বিশেষ করে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাতে বিশ্বায়নের কদর অনেক । অধ্যাপক অমিয়কুমার বাগচী বলেছেন, -বিশ্বায়ণ কথাটি বিভিন্ন অর্থে এবং বিভিন্ন প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হওয়ায় এর কোনো সর্বজন গ্রাহ্য সংজ্ঞা তৈরীর চেষ্টা পন্ডশ্রম মাত্র । রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান সমস্ত ক্ষেত্রেই বিশ্বায়ণের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় ।
বিশ্বায়নের একটি অন্যতম অনুষঙ্গ হলো সাংস্কৃতিক বিকাশ। বিশ্ব ব্যবস্থায় সংস্কৃতির পরিধি ক্রমশ বাড়ছে। মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতি চেতনা বিস্তার ঘটেছে। এক দেশের সংস্কৃতি সহজে অন্য দেশে প্রবেশ করছে। সাংস্কৃতির বিশ্বাস ও বিশ্বব্যাপী প্রবাহে বিশ্বায়নে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটছে। বিশ্বায়ণ হল দেশীয় সীমানার উর্দ্ধে শিল্প-কর্পোরেশনের প্রসারতা এবং আন্তসীমা ভিত্তিক অর্থনৈতিক সুবিধা ও সম্পর্কের এক সংযুক্ত প্রক্রিয়া, যা ক্রমাগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দ্রুত পরিণতি লাভ করেছে।
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
বৈষয়িক ক্ষেত্রে বিশ্বায়ণ কথাটি দুটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়-
- বিশ্বায়ণ একটি জগৎ ব্যাপী প্রক্রিয়া সমষ্টি।
- বিশ্বায়ণ হল কতকগুলি নির্দিষ্ট আর্থিক বা বৈষয়িক নীতির সমাহার, যে নীতিগুলি গ্রহন করলে বিশ্বায়ণের প্রক্রিয়া তরান্বিত হতে পারে ।সংস্কৃতি প্রসঙ্গে সমাজ বিজ্ঞানী Jones বলেন, "Culture is the sum of man's creations" অর্থাৎ মানব সৃষ্ট সব কিছুর সমষ্টিই হচ্ছে সংস্কৃতি ৷
বিশ্বায়ণ বলতে বোঝায়, বিশ্বব্যাপী তথ্য-প্রযুক্তির অগ্রগতি, বিমানপথে মাল পরিবহনের বহুল প্রচলন, টাকার বাজারে ফাটকাবাজি, দেশের সীমানা । পেরিয়ে ক্রমবর্ধমান পুঁজি প্রবাহ, কেবল চ্যানেলের প্রসার, গণ-বিপনন, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, বহুজাতিক কর্পোরেটের শক্তি বৃদ্ধি, নতুন আন্তর্জাতিক শ্রম-বিভাজন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শ্রমের অবাধ চলাচল, উত্তর আধুনিকতা প্রভৃতি । সমাজবিজ্ঞানী থমসন এর মতে, "বিশ্বাস হল গতিশীল এবং প্রারম্ভিক সংবেদনশীল মানসিক কাঠামো যা অভিজ্ঞতার আলোকে পরিবর্তনশীল" এটি সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ।
সাংস্কৃতিক বিশ্বাস এবং দৃষ্টিভঙ্গির তাৎপর্য
"সংস্কৃতি" শব্দটি ইংরেজী প্রতিশব্দ হল এই Culture, ল্যাটিন শব্দ "Colere থেকে এই Culture শব্দটি এসেছে। Colere সংস্কৃতিক শব্দের অর্থ হলো কর্ষণ করা বা চাষ করা। অর্থাৎ সংস্কৃতি বলতে বুঝায় কর্ষণের মাধ্যমে প্রাপ্ত বিষয়। মানব সংস্কৃতির অত্যন্ত শক্তিশালী উপাদান হল বিশ্বাস। বিশ্বাস কোন বিশেষ একটি বিষয় সম্পর্ক ব্যক্তির সত্যের স্থির প্রত্যয়ন। প্রত্যেক সমাজের মানুষের মধ্যে বিভিন্ন জিনিসের প্রতি বিভিন্ন রকমের বিশ্বাস দেখতে পাওয়া যায়। যেমন তথ্য প্রযুক্তির যুগে বিশ্বায়নের ভূমিকার প্রতি আস্থা। বিশ্বায়নের এক সমাজ অন্য সমাজের সংস্কৃতিকে লালন পালন করছে। এতে সংস্কৃতির পরিবর্তনের সাথে সমাজে প্রথা কৃষ্টি, আচরণের পরিবর্তন করতে হয় যা মানুষের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে শিক্ষা উন্নয়নের প্রয়োজন। সকল বিশ্বাসই হলো সংস্কৃতির অঙ্গ। তাছাড়া এই পৃথিবীতে যাবতীয় বিশ্বাসের উপর এক অদৃষ্ঠ শক্তি সর্বদা যা বিশ্বাসের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম ।
সাম্প্রতিক বিশ্বায়ণ প্রক্রিয়ার পাঁচটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় -
- আন্তর্জাতিকভাবে অর্থনৈতিক লেনদেন প্রজিন্যার দ্রুত বিকাশ,
- বাণিজা তবা বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলির দ্রুত অগ্রগতি,
- সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের ব্যাপকতা,
- বিশ্বব্যাপী যাতায়াত ও যোগাযোগের উন্নতি এবং
- ভাবধারা আদান- প্রদানের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নতি।
বর্তমানে বিশ্বায়নের দুটি প্রকিয়া সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়- উৎপাদনের বিশ্বায়ণ এবং লগ্নিপুঁজির বিশ্বায়ন। ১৯৯৮ সাল থেকে উৎপাদন প্রক্রিয়ার দ্রুত বিশ্বায়ণ লক্ষা করা যায় । যেমন-
- বিশ্ব-ব্যাঙ্ক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডার যে কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস কর্মসূচী তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির ওপর চাপিয়ে দেয়, তার ফলে এই প্রক্রিয়া জোরদার হয়।
- বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে গ্যাটের মাধ্যমে যে সব চুক্তি সম্পাদিত হয় এবং যা পরে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থায় চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে, সেই চুক্তিগুলি বিশ্বায়ণ প্রক্রিয়াকে তেজি করে তোলে।
- সমস্ত প্রক্রিয়ার পেছনে চালিকা শক্তি হিসাবে বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলি কাজ করে।
- তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির আত্মনির্ভর শিল্পের ক্ষতি হয় এবং ঐ দেশে বেকার বৃদ্ধি পায়।
বিশ্বায়ন বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্য পারস্পরিক যোগাযোগ ও নির্ভরশীলতা বৃদ্ধির এক সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। বিশ্বায়ন পুরো বিশ্বকে একই ছাতার নীচে নিয়ে এসেছে যা ঐক্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। বিশ্বায়ন শিল্প, শিক্ষা, সংস্কৃতিক বিনিময়ের নতুন-নতুন সুযোগ এবং নতুন প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক ধ্যান ধারণা বিনিময়ের দারুন সুযোগ তৈরি করেছে। তথ্য বিপ্লব এবং অল্প কিছু রাষ্ট্র এবং প্রতিষ্ঠানের হাতে যে শক্তি কেন্দ্রিভূত হচ্ছে তার ফলে এক নতুন সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে । বাজার বৃদ্ধির কারণে বিশ্বায়ন শিক্ষার উন্নতি চায়। বিশ্বায়ন বিজ্ঞাপনকে অত্যন্ত ফলপ্রসু বলে মনে করে। আর সেজন্য টিভি, সংবাদপত্র ও বেতার তাদের লক্ষ্য ।
বিশ্বায়নের মূল লক্ষ ইংরাজি ভাষার প্রসার। মাতৃভাষা ত্যাগ করে মানুষ যত ইংরাজি শিখবে তত বাজার বাড়বে, প্রসারিত হবে । তাছাড়া বর্তমান দুনিয়া ইন্টারনেটের কবলে রয়েছে এবং বিশ্বের ওয়েবসাইট গুলির ৮০ শতাংশই ইংরাজি ব্যবহার করা হয় । ফলে সাক্ষরতা এবং ভাষা-শিক্ষার সম্প্রসারণের মাধ্যমে ডাকেল সাহেব বাজার হাতে রাখার যে নিখুঁত প্রস্তাব দিয়েছেন তার ফলাফল মারাত্মক হয়েছে । তৃতীয় বিশ্বের একটি মানুষ জন্মেই মা-কে মা না বলে মাদার বা মম বলছে । বিশ্বায়ন বলছে মা মাদার হলে বড়ো হবেন । মাকে জীর্ণ কুটিরে মানায়, আকাশচুম্বী প্রাসাদ তাঁর পক্ষে বেমানান । এসব তত্ত্বকে সাধারণভাবে মেধাবী ছেলেরা সমর্থন করবে, কারণ তাদেরকে 'ক্যাম্পাস নিয়োগের' মাধ্যমে নিযুক্ত করে মোটা মাইনের ব্যবস্থা করা হয়েছে । তারা অনেকেই অতি উৎসাহে বলতে বলতে শুরু করেছে, পৃথিবী পাল্টিয়ে যাচ্ছে ।
বিশ্বায়নের ভাবনা থেকে গণমাধ্যমগুলির স্বাধীনতা বিষয়টিও জেনে নিতে হবে। গণমাধ্যম হবে বিক্রির উপাদান, মার্কিন ভাষায় What sells, একে অনুকরণ করে আজ ভারতে সর্বত্র বলা হচ্ছে, সেই সংবাদপত্র প্রকাশ কর, সেই উপন্যাস গল্প লেখ সেই বিজ্ঞাপন দাও, সেই সিরিয়াল তৈরী কর যা 'পাবলিক সেবন করে'। মার্কিন ম্যাগাজিনগুলি ম্যাডোনার লাস্যময়ী ছবি ছাপিয়ে কোটি-কোটি ডলার আয় করে এর যথার্থতাও প্রমাণ করেছে। দেশে দেশে এই জাতীয় প্রগতিশীল সংস্কৃতিকে পুরস্কারও দেওয়া হচ্ছে।
বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞানের আবিষ্কারের ফলে সংস্কৃতির উপরি কাঠামোর ব্যাপকতর পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। তাই সংস্কৃতি বিশ্বাস মানুষের এমন একটি অনুশীলন কর্ম যা মানুষকে সুন্দরভাবে ও সুনিয়ন্ত্রিতভাবে সমাজের সদস্যদের মনোভাবের আদান-প্রদান ও পারস্পরিক সহযোগিতামূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দেয়। যার ফলে ভাল মন্দ বিচার, বর্জন ও গ্রহণে একটি ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করে।
যে দেশের মানুষ ভোরবেলা দুটো মুড়ি খেয়ে মাঠে যাবারও সামর্থ্য রাখে না, তাদের সুরেলা কণ্ঠে মিস্টি মিস্টি ভাষায় এফ-এম বেতার তরঙ্গে 'ভোরাই' পরিবেশন করা হচ্ছে । টিভি চ্যানেলগুলি ২৪ ঘন্টাই কিনে নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়া ব্যারণরা CNN-র মাধ্যমে টিভি দখলে উদ্যত । কারণ তারা দেখছে ইরাক আক্রমণকে মার্কিন জনসাধারণ CNN দেখে সমর্থন দিয়েছে । তাই তারা টিভিকে বলেছে The living room war। মিডিয়া ব্যারণরা মনে করছে, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় টিভি ঠিকমতো ব্যবহার করা যায়নি বলেই মার্কিন জনসাধারণ ওই যুদ্ধের বিরোধীতা করেছিলেন। আজ আর চিন্তা নেই । টিভি চ্যানেলের সাহায্যে ঘরে ঘরে সমর্থন তৈরী করে যুদ্ধ আরম্ভ করা যাবে । কাজেই বাইরে বোমা ফেলার আগে ড্র ইংরুমে টিভি-র পদায় সে বোমার চাষ শুরু করা দরকার । পরিশেষে বলা যায়, প্রতিটি দেশ তার সমাজস্থ ব্যক্তিদের সংস্কৃতি বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে প্রতিনিয়ত শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নীতকরণের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে ৷
বিশ্বায়ণ বলতে কী বোঝ? সমকালীন রাজনীতির উপর বিশ্বায়ণের প্রভাব লেখো।

বিশ্বায়ন একটি আধুনিক ধারণা। একুশ শতকের আলোচনায় এটি একটি মূখ্য বিষয়। বিশেষ করে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাতে বিশ্বায়নের কদর অনেক । অধ্যাপক অমিয়কুমার বাগচী বলেছেন, বিশ্বায়ণ কথাটি বিভিন্ন অর্থে এবং বিভিন্ন প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হওয়ায় এর কোনো সর্বজন গ্রাহ্য সংজ্ঞা তৈরীর চেষ্টা পন্ডশ্রম মাত্র। রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান সমস্ত ক্ষেত্রেই বিশ্বায়ণের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
- আন্তর্জাতিকভাবে অর্থনৈতিক লেনদেন প্রক্রিয়ার দ্রুত বিকাশ,
- বাণিজ্য তথা বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলির দ্রুত অগ্রগতি,
- সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের ব্যাপকতা,
- বিশ্বব্যাপী যাতায়াত ও যোগাযোগের উন্নতি এবং
- ভাবধারা আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নতি।
বিশ্বায়ণ বলতে কী বোঝ। ভারতের ওপর বিশ্বায়নের প্রভার আবোচনা করো ৷
