রেনেসাঁস বলতে কী বোঝো আলোচনা কর

রেনেসাঁস বলতে কী বোঝো আলোচনা কর অথবা,নবজাগরণ মানবতাবাদ বলতে কী বোঝায়? নবজাগরণ শিল্পে এর প্রভাব কী ছিল?

রেনেসাঁস বলতে কী বোঝো আলোচনা কর

৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে অটোম্যান তুর্কিদের আক্রমণে পূর্ব রোম সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তানবুল) এর পতনের ঘটনাকে সাধারণভাবে ইউরোপে আধুনিকযুগের সূচনা বলে মনে করা হয় । তবে দেশ ভেদে আধুনিক যুগের আগমনের ক্ষেত্রে তারতম্য ছিল । যে সমস্ত ঘটনার মধ্য দিয়ে ইউরোপের আধুনিকযুগের আগমন ঘটেছিল সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল রেনেসাঁস, ধর্মসংস্কার আন্দোলন, ভৌগোলিক আবিষ্কার, বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ও পুঁজিবাদের আগমন

আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন

ফরাসি শব্দ Renaistre থেকে রেনেসাঁস শব্দের উৎপত্তি। রেনেসাঁস কথার আক্ষরিক অর্থ হল পুনর্জন্ম। পঞ্চদশ শতকে প্রথমে ইটালিতে ও পরে পশ্চিম ইউরোপে প্রাচীন গ্রিক ও রোমান শিক্ষা সংস্কৃতির পুনরায় চর্চার সূত্রপাত হয়। এর ফলে পশ্চিম ইউরোপে যে নতুন সংস্কৃতিগত বা বুদ্ধিগত পুনরুজ্জীবন ঘটেছিল তা ইউরোপীয় নবজাগরণ বা রেনেসাঁস নামে পরিচিত।

ইউরোপের নবজাগরণের প্রথম প্রকাশ ঘটেছিল ইটালিতে কারণ, ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে অটোম্যান তুর্কিদের আক্রমণে গ্রিক ও রোমান সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল কনস্টান্টিনোপলের পতন ঘটে। এরপর গ্রিক ও রোমান সংস্কৃতির বিষয়ের পণ্ডিতদের অনেকে তাদের মূল্যবান পুঁথিপত্র সঙ্গে নিয়ে মূলত ইটালির বিভিন্ন শহরে ও ইউরোপে এসে আশ্রয় নেয়। ক্রমশ ইটালির একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রিক ও রোমান সংস্কৃতির চর্চা শুরু হয় এবং একে কেন্দ্র করেই গ্রিক ও রোমান সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন ঘটে। এই পুনরুজ্জীবনের পশ্চাতে ইটালির ফ্লোরেন্স, জেনোয়া, মিলান, রোম ও অন্যান্য নগরের শাসক ও বিত্তশালী বণিক ও নাগরিকদের পৃষ্ঠপোষকতা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। ফ্লোরেন্সের শাসক মেদিচি পরিবার বিশেষত, কসমো ও তাঁর পৌত্র লরেঞ্জো প্রচুর অর্থদান করে গ্রিক ও রোমান সংস্কৃতি বিষয়ক পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন ও নবজাগরণের সূচনা হয়। এভাবে ফ্লোরেন্স “দ্বিতীয় এথেন্স” নামে পরিচিতি লাভ করে। ইটালির এই নবজাগরণ ঢেউ ক্রমশ জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যাণ্ড, পোর্তুগাল ও স্পেনে ছড়িয়ে পড়ে।

রেনেসাঁসের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ছিল এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো -

  1. অজানাকে জানার ইচ্ছা ও আগ্রহ এবং যুক্তির ভিত্তিতে বিশ্লেষণ ও তা গ্রহণ। দ্বাদশ শতকের শেষদিক থেকেই ইউরোপের মানুষদের চিন্তাজগতে এই প্রবণতা শুরু হয়েছিল এবং পঞ্চদশ শতকে গ্রিক ও রোমান সাহিত্য ও দর্শন পাঠের মাধ্যমে তা আরোও বৃদ্ধি পেয়েছিল।
  2. নবজাগরণ উদ্ভূত যুক্তিবাদের প্রভাবে প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বাধাগুলি ক্রমশই অপসৃত হতে থাকে। পাশাপাশি মানুষ আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে।
  3. নবজাগরণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল মানবতাবাদ, এর মূল কথা ছিল আধ্যাত্মিক বিষয়গুলির পরিবর্তে ইহলৌকিক জগতের ওপর গুরুত্ব আরোপ এবং মানুষের হিতসাধন। ফ্রান্সিসকো পেত্রার্ক (১৩০৪-১৩৭৪ ( খ্রিঃ) ছিলেন মানবতাবাদের জনক। পরবর্তীকালের উল্লেখযোগ্য মানবতাবাদী হলেন নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, লিওনার্দো-দ্য-ভিত্তি, দ্যান্ডে প্রমুখ।
  4. প্রাচীন গ্রিক রোমান সাহিত্য, দর্শন, শিল্পবিজ্ঞান প্রভৃতি চর্চার ফলে সমসাময়িক সাহিত্য, দর্শন ও শিল্পকলায় তা আরো প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। ফ্লোরেন্স, রোম, ভেনিস প্রভৃতি স্থান রেনেসাঁ স্থাপত্যের প্রধান কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে। লিওনার্দো-দ্য-ভিঞ্চি, মাইকেল এঞ্জেলো প্রমুখ চিত্রকলায় নতুন রীতির প্রবর্তন করেন, পাশাপাশি জাতীয় ভাষা ও স্থানীয় ভাষা সাহিত্যের বিকাশ ঘটে। ষোড়শ শতকে ইটালিয়, ফরাসি, জার্মান, ইংরেজ ও স্প্যানিশ ভাষার উদ্ভব ঘটে।
  5. নবজাগরণের ফলে বিজ্ঞানচর্চায় এসেছিল গতি, বিজ্ঞান গবেষণার ফলে প্রাকৃতিক ঘটনার রহস্য অনুসন্ধান ও মানবকল্যাণ সম্ভব হয়েছিল। পাশাপাশি মধ্যযুগের প্রচলিত অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারও  অনেকাংশে দূরীভূত হয়েছিল।

রেনেসাঁ কী ? অথবা, রেনেসাঁ বলতে কী বোঝা

রেনেসাঁ কী ? অথবা, রেনেসাঁ বলতে কী বোঝা

উরোপের ইতিহাস ষোড়শ শতকে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল, যার একটি দিক মানুষের চিন্তা-ভাবনার উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল । এটা ছিল রেনেসাঁ (Renaissance) বা নবজাগরণ । নবজাগরণের ইংরাজি প্রতিশব্দ হল রেনেসাঁ, যার সাধারণ অর্থ অতীতের পূণর্জাগরণ । বস্তুতঃ, মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগের ইউরোপের রূপান্তরের কালে শিল্প, সাহিত্য, জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যে দীর্ঘ আলোচনা করা হয়েছে, তাকে নবজাগরণের অঙ্গ বলেই মনে করা হয়। মধ্যযুগে চার্চের গোড়ামির জন্য ইতিহাস, সাহিত্য, দর্শন, শিল্প, বিজ্ঞানচর্চা বন্ধ হয়ে গেলে মানুষ অন্ধকারের গহণ বনে আলোকের সন্ধানে হাতরে বেরায়। ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও কুসংস্কার মানুষকে আচ্ছন্ন করে ফেলে ছিল । যুক্তি ও প্রগতির পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে । অজ্ঞানতার এই অন্ধকারময় জগৎকে দূর করে অতীত জ্ঞানের আলোকে ইউরোপকে উদ্ভাসিত করে তোলার প্রচেষ্টাকেই রেনেসাঁ বা নবজাগরণ বলে অভিহিত করেছেন।

আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন

এই রেনেসাঁ শব্দটির প্রয়োগ কিভাবে ঘটল তা নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায়, ফরাসি ঐতিহাসিক মিশলে (১৮৫৫ খ্রীঃ) প্রথম রেনেসাঁ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। চতুর্দশ শতকের ইতালিতে চিন্তার আলোড়ণ ও উদ্দীপনা এবং তার মধ্যে নব জন্মের প্রতিফলন লক্ষ্য করে মিশলে এই শব্দটি প্রয়োগ করে ছিলেন। তবে এর আবির্ভাব কবে হয়েছিল সেপ্রসঙ্গে দেখা যায় রাতারাতি একদিনে হঠাৎ করে এটা সম্ভব হয়নি। চর্তুদশ শতকের অনেক আগেই মানুষের চিন্তা জগতে বা মানসিকতায় একটা বিরাট পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল। এতদিন পর্যন্ত মানুষ ধর্মের উপর অত্যাধিক নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু এই সময় থেকে মানুষ ক্রমে ইতিহাস, সাহিত্য, দর্শন, শিল্প, বিজ্ঞানচর্চার ইত্যাদির উপর আগ্রহী হতে থাকে। এর পরিণতিতে মানুষের মনে নানান জিজ্ঞাসা ও অনুসন্ধিৎসা দেখা দেয়, যা তাকে বিশেষ ভাবে যুক্তিবাদী ও প্রগতিশীল করে তোলে। এই যুক্তিবাদের প্রভাবে মানুষ ধর্মকে এক নতুন দৃষ্টিতে বোঝার চেষ্টা করে। ষোড়শ শতকে ইউরোপে যে রেনেসাঁর প্রভাব দেখা দিয়েছিল তার মূল কিন্তু এই সময়েই গ্রোথিত হয়ে ছিল।

ইতালিতেই প্রথম প্রকাশ ঘটে ছিল এই নতুন চিন্তা ভাবনার। ইতালিতে মূল রোপনের পর ক্রমশ তা ডালপালা বিস্তার করে ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের অন্যত্র। কিন্তু ইতালিতে কেন প্রথম রেনেসাঁর উদয় হল সে প্রসঙ্গে আলোচনা করলে দেখা যাবে, সেখানকার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি রেনেসাঁর প্রসারে বিশেষ সহায়তা করে ছিল। এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা নিয়ে ছিল ফ্লোরেন্স, ভেনিস, রোম, লুক্কা প্রভৃতি শহরগুলি। ১৪৫৩ খ্রিঃ কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের পর সেখানকার পন্ডিতেরা ইতালিতে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন। ইতালির শহরগুলির ধনী ব্যক্তিদের আশ্রয় ও সমর্থণ লাভ করায় তাদের পক্ষে নতুন ধরণের চিন্তা ভাবনায় কোন রকম ছেদ পড়েনি। ফলে তারা ইতিহাস, সাহিত্য, দর্শন, শিল্প, বিজ্ঞানচর্চায় নিশ্চিন্ত মনে পেরে ছিলেন আত্মনিয়োগ করতে।

রেনেসাকে আমরা দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করতে পারি। একঅর্থে এটি ছিল প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার পুনরুজ্জীবন এবং এটি প্রসারিত হয়েছিল চিরাচরিত পদ্ধতিতে, অর্থাৎ পুঁথিপত্র ও হস্তলিপি মালার পাঠের মাধ্যমে। ভিন্নতর অর্থে রেনেসাঁ ছিল আধুনিক চিন্তা মানসের উৎস-রুপে বিবেচিত উদ্ভাবনের যুগ। এই চিন্তার অন্যতম বাহক ছিল অসংখ্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, যার মধ্যে বিশেষ তাৎপর্য দাবী করে মুদ্রনযন্ত্রের আবিষ্কার। ইতিহাস দেখিয়েছে এই মুদ্রনযন্ত্রের আবিষ্কার ইউরোপের ইতিহাসকে নতুন পথে চালিত করেছিল। রেনেসাঁ প্রসূৎ জ্ঞান-বিজ্ঞান এর উপর ভর করে অনেক দূর পাড়ি দিয়েছিল।

তোমাকে অনেক ধন্যবাদ রেনেসাঁস বলতে কী বোঝো আলোচনা কর এই নোটটি পড়ার জন্য

About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟