গান্ধি-আরউইন চুক্তির প্রধান দিকগুলি সংক্ষেপে বিবৃত করো।
উদারনৈতিক প্রতিনিধিরা গোল টেবিল বৈঠককে ভারতের পক্ষে তাৎপর্যপূর্ণ জয় হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করেন। লন্ডন থেকে ফিরে তাঁরা কংগ্রেস নেতৃবর্গকে আপস করার জন্য অনুরোধ জানান। কিন্তু তাঁদের আবেদন দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়। এখানে গান্ধিজির প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল যথেষ্টই না-সূচক। প্রকাশ্য বিবৃতি তথা ব্যক্তিগত চিঠিপত্র ক্ষেত্রেই, কোনরকম মীমাংসার সম্ভাবনা সম্পর্কে তিনি গভীর নিরাশা ব্যক্ত করেন, কিন্তু হঠাৎ আরউইন-এর সঙ্গে দিল্লীর আলোচনার পরে এই পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়।
১৯৩১ সালের ৪ মার্চ গান্ধি-আরউইন চুক্তি সম্পাদিত হয়। আন্দোলন চলার সময় গান্ধিজি কেন আরউইনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজী হয়েছিলেন এবং চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন তা নিয়ে সমসাময়িক ঐতিহাসিক- দের মধ্যে তীব্র বিতর্ক রয়েছে। ভগৎ সিং ও কমরেড-দের মৃত্যুদন্ড রদের শর্তে চুক্তি স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করায় তিনি অনেকের কাছেই তিক্ত ভাষায় সমালোচিত হয়েছেন। অনেকেই এই চুক্তিকে কৃষকদের প্রতি চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা হিসাবে দেখেছেন। গান্ধি-আরউইন চুক্তি সাক্ষরের পরও এলাহাবাদ কৃষক আন্দোলন চলেছিল এবং জাতীয় নেতৃত্ব যথারীতি এই আন্দোলনে হ্রাস টানতে চেয়েছিল। অনেক ক্ষেত্রে এই আন্দোলন এতটাই জঙ্গি হয়ে উঠেছিল যে গান্ধি ও বুর্জোয়াদের পক্ষে তা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। এই অভিযোগ -গুলি বিপিন চন্দ্র ও অমলেশ ত্রিপাঠী সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন,
বিপিন চন্দ্র বলেছেন যে, 'গণ-আন্দোলন স্বল্পস্থায়ী হয়ে বাধ্য, চিরকাল তা চলতে পারে না, জনগণের আত্মত্যাগের ক্ষমতা সক্রিয় কর্মীদের মতো সীমাহীন নয়'। আন্দোলনের বাড়া ও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতে শ্রান্তির ছাপ নিশ্চিতই ছিল। কিন্তু বিপিন চন্দ্রের এই মত স্বয়ং গান্ধিজির বিরুদ্ধে যায়। ১৯৩২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি গান্ধি একটা ফরাসি পত্রিকাতে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে মন্তব্য করেন যে, 'আন্দোলনের আসন্ন ব্যর্থতা সংক্রান্ত ধারণা ছিল না। আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ার কোন চিহ্নই স্পষ্ট ছিল না'। ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বর থেকেই গান্ধি সম্পূর্ণ নিজস্ব কারনে আন্দোলন প্রত্যাহার করার কথা ভেবেছিলেন, আন্দোলনের পথ পরিহার করে বণিককুলের চাপের কাছে মাথা নত করা গান্ধি-আরউইন চুক্তি সম্পাদনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। অমলেশ ত্রিপাঠীর মতে বণিকদের চাপ গান্ধির ওপর যেমন ছিল, আরউইনের ওপরও তেমনি ছিল। আরউইন আন্দোলন থামানোর জন্য বণিকদের ওপর নির্ভর করতে চেয়েছিলেন, ১৯৩০ সালে বোম্বাইর বণিকেরা সপ্ত ও জয়াকারকে মধ্যস্থতা করার জন্য তাগাদা দেন। তাঁদের আবেদন দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়। ১৯৩১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ মার্চ গান্ধির সঙ্গে আরউইনের প্রায় সাতবার সাক্ষাৎকার হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে সঞ্চ ও জয়াকরো উপস্থিত ছিলেন। গান্ধিজির প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল যথেষ্ট না-সূচক। ১১ ফেব্রুয়ারি পর্য্যন্ত প্রকাশ্য বিকৃতি তথা ব্যক্তিগত চিঠিপত্র দুই ক্ষেত্রেই, কোনরকম মীমাংসার সম্ভাবনা সম্পর্কে তিনি গভীর নিরাশা ব্যক্ত করেন। কিন্তু হঠাৎ ১৪ ফেব্রুয়ারি আরউইনের সঙ্গে আলোচনায় এই অবস্থার পরিবর্তন হয়। এই প্রক্ষাপটে ৪ঠা মার্চ গান্ধি-আরউইন চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি 'দিল্লি
চুক্তি' নামেও পরিচিত। এই চুক্তিতে সিদ্ধান্ত হয়:
- দমনমূলক আইন ও অর্ডিন্যান্সগুলি প্রত্যাহার করা হবে।
- হিংসাত্মক কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত বন্দিরা ছাড়াও অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দিদের সরকার মুক্তি দেবে।
- সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগদানের জন্য যাদের সম্পত্তি বাজায়প্ত করা হয়েছিল, তাদের সম্পত্তি প্রত্যর্পণ করা হবে। (ঘ) ব্রিটিশ পন্য বর্জন করা চলবে না।
- যে সব সরকারি কর্মচারী আইন অমান্য আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন তাঁদের পুনর্বহালের বিষয়টি বিবেচিত হবে।
- কংগ্রেস আইন অমান্য আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেবে।
- ভারতীয় সংবিধানের খসড়া রচনার জন্য আসন্ন গোলটেবিল বৈঠকে কংগ্রেস প্রতিনিধি পাঠাতে রাজি হয়। চুক্তির সিদ্ধান্তগুলি দেখানই বোঝা যায় যে, আইন অমান্য করা শুরুর আগে গান্ধিজির ১১ দফা দাবির একটি দাবিও ব্রিটিশ সরকার মেনে নেয়নি। লবণ আইনও পর্য্যন্ত প্রত্যাহত হয় নি। তাছাড়া এই চুক্তি সংগ্রেস প্রস্তাবের সঙ্গেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, কারণ ১৯২৯ সালের লাহোর কংগ্রেসের গৃহীত প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করে গান্ধি-আরউইন চুক্তি সম্পাদিত হয়নি।
আরউইন জোর দিয়েছিলেন- (ক) যুক্তরাষ্ট্র; (খ) ভারতীয়দের প্রতি দায়িত্ব, (গ) সংরক্ষণ ও রক্ষাকবচ এর ওপর। গান্ধি, যেগুলি অবিলম্বে মেনে নেন। ১৯৩১ সালের মার্চ মাসে কংগ্রেসের করাচি অধিবেশন গান্ধি-আরউইন চুক্তি অনুমোদিত হলেও জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ নেতারা এই চুক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন।
৫ মার্চের দিল্লী চুক্তির ২ নং ধারার স্থির করা হয় যে, 'সংরক্ষণ ও রক্ষাকবচ' এর আওতায় পড়বে এই বিষয় যেমন- প্রতিরক্ষা, বিদেশ-নীতি সংখ্যালঘুদের অবস্থা, ভারতের আর্থিক ঋণ, তথা দায়মুক্তি। আইন অমান্য আন্দোলনের বন্দীদের ছেড়ে দেওয়া হলেও ভগৎ সিং-এর প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা যৎসামান্যই করা হল। লবণ ও অরাজনৈতিক স্বদেশি প্রচার সম্পর্ক কিঞ্চিৎ ছাড় দেওয়া হলো, কিন্তু কিছুদিন আলাপ-আলোচনা চালানোর পর গান্ধি তাঁর দুটি দাবি ছেড়ে দিলেন। সেই দাবি দুটি হলো-পুলিশি অত্যাচারের তদন্ত এবং ইতিমধ্যেই তৃতীয় কোন পক্ষের কাছে বেচে দেওয়া বাজেয়াপ্ত জমি ফেরত। গান্ধিজির মনোভাব কেন যে পরিবর্তন হয়েছিল, সে এক ঐতিহাসিক প্রহেলিকা। শুধু উদারনৈতিক নেতৃবর্গের চাপের যুক্তি দিয়ে তার উত্তর মেলে না। এমন কথাও গুরুত্ব দিয়ে বলা যায় না যে গান্ধি নেহাৎই আরউইনের কথায় বিশ্বাস করে এই কাজ করেছিলেন।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ গান্ধি-আরউইন চুক্তির প্রধান দিকগুলি সংক্ষেপে বিবৃত করো। এই নোটটি পড়ার জন্য