খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে গান্ধিজীর ভূমিকা বিশ্লেষণ করো। অথবা,Analyze the role of Gandhiji in Khilafat and non-cooperation movement.

 খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে গান্ধিজীর ভূমিকা বিশ্লেষণ করো। 

খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে গান্ধিজীর ভূমিকা বিশ্লেষণ করো।


খিলাফৎ আন্দোলনঃ


 ভারতের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে অন্যতম ঘটনা হল খিলাফৎ ও অসহযোগ আন্দোলন। তুরস্ক সাম্রাজ্যের অধিপতি সুলতান সমগ্র মুসলিম জগতের পরম শ্রদ্ধেয় ধর্মীয় প্রধান বা খলিফা হিসাবে স্বীকৃত হতেন। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের পরাজয় ঘটলে ব্রিটেন তুরস্ককে ছিন্নভিন্ন করতে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহন করে। রিটেন কর্তৃক তুরস্কের সুলতান তথা খলিফার এই বিপর্যয় ও অবমাননা আন্তর্জাতিক মুসলিম আতৃত্বকে বিচ্ছুর করে তোলে । আলিভাতৃদ্বয়ের নেতৃতে ভারতে খালিফার মর্যদা নামে রক্ষার জন্য যে আন্দোলন দেখা দেয় তাহা খিলাফৎ আন্দোলন নামে পরিচিত।


 অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলনের আদর্শে বিশ্বস গান্ধিরী ভারতের রাজনীতির রঙ্গমকে প্রবেশ করেন। তিনি হিন্দু মুসলিমের বাতাস্থাপনে প্রয়াসী হন। গাছনদী প্রথম থেকেই বিলাফত আন্ডেশাসনের নেতাদের সাধ উকাম্বালনে রাখেন। ১৯১৯ সালে গাজলী দিল্লীতে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় বিলাব মোতায়েনের সভাপতি নির্বাচিত হন। তাঁর পরিচালনায় প্রস্তাব গৃহীত হয় যে, তুরস্কের সার মুসলমানদের পক্ষে সন্তোষজনকভাবে মীমাংসিত না হলে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে ব্যকর আন্দোলন প্রয়োগ করা হবে। মুসলীমলিগ এই প্রস্তাব সমর্থন করে।


 গান্ধীজী খিলাফৎ আন্দোলনের প্রধান দাবীগুলির প্রতি সমর্থন জানান। তিনি ১৯১৯ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় খিলাফৎ সম্মেলনে যোগদান করেন। এই সম্মেলনে প্রথম অসহযোগ আন্দোলনকে সর্বভারতীয় রূপ দেবার প্রস্তাব হয়। খিলাফতিদের দাবীগুলি হল- ক) খলিফার সাম্রাজ্য অক্ষুন্ন রাখা, খ) পবিত্র স্থান হিসাবে মক্কা-মদিনার ওপর থেকে বিদেশী হস্তক্ষেপ নিবারণ করা, গ) প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, জেরুজালেম প্রভৃতি অঞ্চলে খলিফার আধিপত্য বজায় রাখা।


খিলাফৎ আন্দোলনের প্রথম পর্বঃ


 ১৯১৯ সালে খিলাফৎ আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে ভারতীয় মুসলীম নেতারা তুর্কী সুলতানের প্রতি সহানুভূতি জানান। বোম্বাইয়ে নরমপন্থী মুসলীম, বণিকরা বড়লাটের কাছে তুর্কী সুলতানের প্রতি ন্যায়-বিচারের দাবী জামান। মিঞা মহম্মদ ছোটানীর নেতৃত্বে বোম্বাই খিলাফৎ কমিটি স্থাপিত হয়। গান্ধিজী বোম্বাই ও লক্ষ্ণৌতে খিলাফৎ সম্মেলনে বক্তৃতা দেন। খিলাফতি নেতারা উপলব্ধি করেন যে, হিন্দুদের সহযোগিতা ছাড়া খিলাফৎ দিবস সফল করা যাবে না। এজন্য মুসলিম নেতারা হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ওপর জোর দেন।


খিলাফৎ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বঃ 


১৯২০ খ্রিঃ পর্যন্ত খিলাফৎ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় অনুষ্ঠিত হয়। ইতিমধ্যে এই আন্দোলনের ওপর থেকে নরমপন্থী বোম্বাইগোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ হারায়। মৌলনা আজাদ ও আলি ভ্রাতৃদ্বয় জেল থেকে মুক্ত হলে খিলাফৎ আন্দোলনে গরম হাওয়া বইতে থাকে। কেন্দ্রীয় খিলাফৎ সমিতি বড় লাটের কাছে তিনদফা দাবী পেশ করে। হজরৎ মোহানী ব্রিটিশ পণ্য বয়কটের জন্য দাবী জানান। ১৯২০ সালে খিলাফৎ দাবী উপলক্ষ্যে গান্ধীজীর পরামর্শে হরতাল পালিত হয়। এই আন্দোলন সাধারণ মুসলীমদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে।


খিলাফৎ আন্দোলনের তৃতীয় পর্বঃ

 ১৯২০ খ্রিঃ মে মাস থেকে খিলাফৎ আন্দোলনের তৃতীয় পর্যায় শুরু হয়। পরাজিত তুরস্কের ওপর ব্রিটিশ সরকার সেভরের সন্ধি চাপিয়ে দিলে ভারতীয় মুসলীম নেতাদের মনে ক্রোধ ও হতাশা দেখা দেয়। তার ব্রিটিশ সরকারের কাছে চারটি দাবী পেশ করে- ক) তুরস্কের খলিফার সিংহাসন দখে খ) আরবের ইসলামীয় ধর্মস্থানগুলির পবিত্রতা রক্ষার জন্য মুসলীম সার্বভৌমত্বের অধীনে তীর্থস্থানগুলিকে রক্ষা করা, গ) খলিফার সাম্রাজ্য অক্ষুন্ন রাখা, ঘ) মক্কা-মদীনায় ইউরোপীয় হস্তক্ষেপ না করা।


 সেভারের সন্ধি দ্বারা খিলাফৎদের দাবী পূরণ না হওয়ায় গান্ধিজীর পরামর্শে এবং আলি ভাতৃদয়ের উদ্যোগে সত্যাগ্রহ বা অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। গান্ধিজী ঘোষনা করেন যে, খিলাফৎ দাবী উপলক্ষ্যে সত্যাগ্রহ করা হবে। এজন্য তিনি ক) ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া খেতাব, খ) কাউন্সিল থেকে পদত্যাগ, গ) নির্বাচন বর্জন, ঘ) খাজনা বন্ধের প্রস্তাব দেন।


 খিলাফৎ আন্দোলন একেবারে নিরুণক ছিল না। এই আন্দোলনে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে এক অভূতপূর্ব একা দেখা দিয়েছিল। এই আন্দোলনের প্রভাবে ব্রিটিশ সরকারও কিছুটা ভীত হয়েছিল। গান্ধিজী ভারতের জাতীয় সংগ্রামকে এক নতুন ধারায় প্রবাহিত করেন। তিনি পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড, রাওলাট আইন ও স্ব-রাজের দাবীর সাথে খিলাফৎ দাবীকে একত্রে যুক্তকরার কথা বলে ন। এর ফলে ভারতের জাতীয় আন্দোলন প্রাতিষ্ঠানিক গন্ডী পেরিয়ে গণমুখী আন্দোলনে পরিণত হয়।


অসহযোগ আন্দোলনঃ


 ১৯২০ সালে কংগ্রেসের কলকাতার বিশেষ অধিবেশনে গান্ধিজী অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ওই বছর নাগপুরে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। কংগ্রেসের নরমপন্থী ও চরমপন্থী উভয় নেতৃত্বই বিভেদ ভুলে এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।


অসহযোগ আন্দোলনের উদ্দেশ্যঃ


 ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার রাওলাট আইন পাশের মাধ্যমে ভারতীয়দের সর্বপ্রকার বাক্তি স্বাধীনতা হরণ করে। বিনা বিচারে যে- কোনো ব্যক্তিকে আটক রাখা যাবে এবং অভিযুক্ত বাক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের বা আইনজীবী নিয়োগেরও কোনো অধিকার থাকবে না। এই কালা কানুনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। অসহযোগ আন্দোলনের অন্যতম, উদ্দেশ্য ছিল এই কালাকানুন প্রত্যাহার করানো।


 রাওলাট আইনের প্রতিবাদে পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের নিরস্ত্র মানুষের সমাবেশে ইংরেজ সরকার যে জঘন্যতম হত্যাকান্ড সংঘটিত করেছিল, তাতে সারা দেশে প্রচন্ড ক্ষোভ ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। এই হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল ডায়ারের শাস্তিদানের দাবীতে সারা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। অসহযোগ আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এর উপযুক্ত শাস্তিপ্রদান। অসহযোগ আন্দোলনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ন উদ্দেশ্য ছিল স্বরাজ অর্জন করা। গান্ধিজী বলেন, তিনি এক বছরের মধ্যেই স্বরাজ-এর লক্ষ্যে পৌছে দেবেন। 



প্রত্যাহারের কারণঃ



চৌরিচোরা ঘটনাঃ অসহযোগ আন্দোলন যখন প্রবলতম আকার ধারণ করে তখন উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার চৌরিচৌরা গ্রামে এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। ১৯২২ সালে এক শোভাযাত্রার ওপর ইংরেজ পুলিশ গুলি চালালে ক্ষিপ্ত জনতা পুলিশ চৌকিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে ২২জন পুলিশ অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। ফলে এই আন্দোলন হিংসার পথে অগ্রসর হচ্ছে দেখে গান্ধিজী এই আন্দোলন প্রত্যাহার করেন।


 গান্ধিজী এভাবে হঠাৎ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় ভারতে এক হতাশার সৃষ্টি হয়। চিত্তরঞ্জন দাশ, মতিলাল নেহরু, লাজপৎ রায় প্রমুখ নেতৃবৃন্দ গান্ধিজীর এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা করেন। তাঁরা এই সিদ্ধান্তকে জাতীয় বিপর্যয় বলে অভিহিত করেন। এক্ষেত্রে গান্ধিজি যুক্তি দেখান যে নীতি ও আদর্শভ্রষ্ট হলে জাতীয় আন্দোলনে সাফল্য পাওয়া সম্ভব নয়। এ ছাড়া নিরস্ত্র জনগণ হিংসার আশ্রয় নিলে অস্ত্রশক্তিতে বলীয়ান ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে জয়লাভ কখনোই সম্ভব নয়।



গান্ধিজীর অসহযোগ আন্দোলনের যেমন উপরোক্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল তেমনি তিনি সত্য ও অহিংসার মহান আদর্শের ওপর ভিত্তি করে এক শোষণহীন ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এজনা এই আন্দোলন ছিল একাধারে রাজনৈতিক ও মানবতাবাদী।


গান্ধীজী কীভাবে খিলাফত আন্দোলনে জড়িত হয়েছিলেন

মহাত্মা গান্ধী খিলাফত আন্দোলনে জড়িত হন ১৯১৯ সালে, যখন তিনি ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত রক্ষার দাবিতে আন্দোলনে সমর্থন জানান। এই আন্দোলন মূলত তুরস্কের খিলাফতকে রক্ষা করার জন্য সংগঠিত হয়েছিল, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিপন্ন হয়ে পড়ে । গান্ধীজি মুসলিম নেতাদের সাথে একাত্ম হয়ে খিলাফত আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন এবং এই আন্দোলনকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত করার চেষ্টা করেন ৷ গান্ধীজির নেতৃত্বে, খিলাফত আন্দোলন এবং অসহযোগ আন্দোলন একত্রিত হয় । তিনি ১৯২০ সালে সর্ব ভারতীয় কংগ্রেসের নাগপুর সম্মেলনে খিলাফত আন্দোলনের দাবিগুলোকে স্বরাজের সাথে যুক্ত করেন এবং উভয় লক্ষ্য অর্জনের জন্য একটি অসহযোগ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন ৷ গান্ধীজির এই কৌশল মুসলিম এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে সহায়ক হয়, যা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একটি বৃহত্তর আন্দোলনে রূপান্তরিত হয় । তিনি মুসলমানদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগিয়ে তোলেন এবং তাদেরকে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন ৷ এভাবে, গান্ধীজির খিলাফত আন্দোলনে জড়িত হয়ে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করে।

গান্ধীজী ও খিলাফত আন্দোলনের মধ্যে যোগসূত্র কী

গান্ধীজী খিলাফত আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন মুসলিম সম্প্রদায়ের সমর্থন অর্জনের জন্য । তিনি উপলব্ধি করেন যে মুসলিমদের সমর্থন ছাড়া ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম সফল হবে না। গান্ধীজী খিলাফত আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন এবং এই আন্দোলনকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাথে যুক্ত করার চেষ্টা করেন । তিনি মুসলিমদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগিয়ে তোলেন এবং তাদেরকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অহিংস সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন । ১৯২০ সালের নাগপুর সম্মেলনে গান্ধীজি খিলাফত আন্দোলনের দাবিগুলোকে স্বরাজের সাথে যুক্ত করেন এবং অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে উভয় লক্ষ্য অর্জনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন । এর ফলে, হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের একটি উদাহরণ সৃষ্টি হয় এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গড়ে ওঠে । এভাবে, গান্ধীজীর খিলাফত আন্দোলনে অংশগ্রহণ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিনি মুসলিম সম্প্রদায়ের সমর্থন অর্জন করে এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।


About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟