মুঘল আমলে সুরাট বন্দরের গুরুত্ব অথবা,মুঘল আমলে সুরাট বন্দরের গুরুত্ব আলোচনা করো?

 মুঘল আমলে সুরাট বন্দরের গুরুত্ব অথবা,মুঘল আমলে সুরাট বন্দরের গুরুত্ব আলোচনা করো?  

সমসাময়িক বিভিন্ন বন্দরের মধ্যে সুরাট বন্দর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার পিছনে বিশেষ অবদান ছিল নিঃসন্দেহে মুঘলদের অবদান সবথেকে বেশি । তবে এর পিছনে একাধিক কারণ ছিল। শহরের নিরাপত্তা মুঘল শাসনের অধীনে সুরক্ষিত হয়। পশ্চাৎ ভূমির সঙ্গে সড়ক পথে এই বন্দরের যোগ সূচিত হয়। সুরাট মুসলমান তীর্থক্ষেত্র মক্কায় হজ যাত্রার জন্য মুঘলদের প্রধান বক্তর হিসেবে পরিগণিত হয়। প্রতি বছর হজে যাবার জন্য তারা সুরাটে এসে জাহাজ ধরে। তবে সুরাটের ক্ষেত্রে এসব পরিবর্তন বা বন্দর হিসেবে তার এই গুরুত্ব অর্জন হঠাৎ করে ঘটেনি। অন্যদিকে সুরাটের এই উত্থানের পেছনে শুধুমাত্র যে মুঘলদেরই যে হাত ছিল, তেমন টাও নয়। ষোড়শ শতকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পশ্চিম ভারত সাগরকে ঘিরে তিনটি নতুন মুসলমান শক্তির আবির্ভাব ঘটে। ভারতে মুঘল, পারস্যে সাফাভি আর মিশর ও সিরিয়ায় অটোমান সাম্রাজ্য। 


 ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধে আরব ভূখন্ডের পূর্বাংশে অটোমান সাম্রাজ্যের প্রসার এই অঞ্চলে সুদৃঢ় শাসন প্রতিষ্ঠা করে। ইসলাম ধর্মের প্রধান তীর্থক্ষেত্রগুলি তাদের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে এবং এলেপ্পো, দামাস্কাস, কায়রো, মক্কা যাবার তীর্থযাত্রার পথে তারা শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। মুঘলরা আরব সাগরের পূর্বপাড়ে যখন হজ যাত্রার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিত, তখন পশ্চিমপাড়ে হজ যাত্রার জন্য উপযুক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে অটোমানরা। অটোমানরা ভারত সাগর থেকে পর্তুগিজদের উৎখাত করতে পারেনি তরে তাদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করতে পারেনি তবে তাদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করতে পেরেছিল। এই পরিস্থিতিতে সুরাট বন্দরের উত্থান ঘটে। বস্তুত পারস্য উপসাগরে সাফাভিদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং লোহিত সাগরীয় অঞ্চলে অটোমানদের প্রাধান্যের বিষয়টি বন্দর হিসাবে সুরাটের উত্থানের পথকে প্রশস্ত করে। যোড়শ শতকে ভারত মহাসাগরের পশ্চিমে বাণিজ্যের বিশেষ বাড়বাড়ন্ত দেখা দেয়। 

আর সুরাট হয়ে পড়ে সেই বাণিজ্যের প্রধান বন্দর।


ষোড়শ শতকে ভারতের পশ্চিম উপকূলে পর্তুগিজদের দ্বারা নির্মিত নয় এমন দুর্গের সংখ্যা হাতে গোনা। এর মধ্যে বন্দর হিসাবে সুরাট ক্রমশ সমুদ্র বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে। এ অঞ্চলের প্রাচীন বিখ্যাত বন্দর দিউয়ের তুলনায় সে অধিক গুরুত্ব অর্জন করে। অন্যদিকে লোহিত সাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে সমুদ্র বাণিজ্যে, বিশেষত গোলমরিচের বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, খাজা সফরের মৃত্যুর পরও সুরাটের সমৃদ্ধি অব্যাহত থাকে এবং এ নগর পর্তুগিজ আক্রমণ প্রতিহত করতে সমর্থ হয়। ১৫৪৬ সালে খাজা সফরের পর খুদাওয়ান্দ খান রুমি সুরাট বন্দর নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষার দায়িত্ব সামলান। পরবর্তীকালে গুজরাট অভিযান কালে আকবর ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে  সুরাট দখল করেন। রাজনৈতিক পালা বদলের মধ্যেও বন্দর হিসেবে সুরাটের সমৃদ্ধি অব্যাহত থাকে । মুঘলরা শহরটি দখল করার পর সমৃদ্ধ গাঙ্গেয় দোয়াব অঞ্চলের সঙ্গে সুরাটের সংযোগ স্থাপিত হওয়ায় এর সমৃদ্ধি ও বাণিজ্য আরো বৃদ্ধি পায়। মুঘলদের দ্বারা অধিকৃত হবার পূর্বের সুরাট অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী বন্দরের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী বা সমৃদ্ধশালী বন্দর হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে।


মূলত সুরাটের উত্থান কতগুলো পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল। প্রথম পর্যায় ১৫৩০-এর দশকে যখন ধীরে ধীরে ক্যাম্বে বন্দরের অবনমন ঘটছিল তখন সেই পরিস্থিতির সুযোগে রান্ডের উত্থানের পথ প্রশস্ত হয়। এবং এই সময়ে সুরাট কিছুটা লাভবান হয়েছিল। কিন্তু সে সম্ভাবনা কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত হয় দিউ ও সুরাটের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে। দ্বিতীয় পর্যায়ে পর্তুগিজরা ১৫৩৫ সালে দিউ দখল করে। এই ঘটনার তিন বছরের মধ্যে ১৫৩৮ সালে সুরাটের গভর্নরের দিউ অভিযান ব্যর্থ হলে খাজা সফর দুর্গ নির্মাণ করে সুরাট শহরের সুরক্ষার ব্যবস্থা যেমন সুনিশ্চিত করেন, তেমনি বাণিজ্যিক সম্ভাবনার দিক থেকে বন্দর  হিসেবে সুরাট কেবল ক্যাম্বেই নয়, দিউ এরও বিকল্প হয়ে ওঠে।  এরপর থেকে দিউ পর্তুগিজদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ফলে পশ্চিম এশিয়া, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বণিকরা এসে ভিড় করে সুরাট বন্দরে। এ সময়ে সুরাট উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ পশ্চাৎভূমির প্রধান বন্দর অপেক্ষা বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ৎ বা কেন্দ্রে হিসাবে বেশি বিকাশ লাভ করে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার থেকে লোহিত সাগর পর্যন্ত জলপথে প্রসারিত গোলমরিচ ব্যবসার মধ্যবর্তী কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে এই সুরাট বন্দর। এই ভাবে সুরাট ১৫৪০-এর দশকের মধ্যভাগে সুমাত্রা ও পশ্চিম- এশিয়ার মধ্যে নৌ-পরিবহন ও বাণিজ্যিক  যোগসুত্ররূপে অবতীর্ণ হয়। এই শহর পশ্চিম এশিয় বণিক ও সুমাত্রার ব্যবসায়ীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।

আর এভাবে মুঘল আক্রমণের পূর্বেই সুরাট এক বহুজাতিক রূপ লাভ করে। মুঘলদের দ্বারা সুরাট অধিকৃত হলে দক্ষিণ গুজরাট ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে আরও প্রত্যক্ষভাবে ও সংযুক্ত হয়ে যাওয়ায় উত্তর ভারত ও গাঙ্গেয়-দোয়ার অঞ্চল এর পশ্চাত ভূমিতে পরিণত হয়। ফলে ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে

সুরাট ভারতের বৃহত্তম বন্দরে পরিণত হয়।





About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟