বাংলায় ভারত ছাড়ো আন্দোলন সম্পর্কে লেখ অথবা, ভারতছাড়ো আন্দোলনের প্রভাব আলোচনা কর
ক্রিপস এর প্রস্তাব ভারতবাসীর অনুভব করে যে ইংরেজ সরকার কখনো স্বেচ্ছায় তাদের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেবে না তাই স্বাধীনতা পেতে হলে সরকারি ইংরেজদের সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া ছাড়া দ্বিতীয় পথ নেই ৷ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের জবাব হিসাবে ব্রিটিশ সরকার তার সামরিক বাহিনীর দ্বারা ভারতবাসীর উপর যে অক্ষর্থ নির্যাতন অত্যাচার চালিয়ে আসছিল তাতে ভারতীয়রা বিক্ষুব্ধ হয়ে মুক্তির পথ খুঁজতে শুরু করে ৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনের তুলনায় খাদ্যের যোগান কম, মূল্যবৃদ্ধি চালের দাম বেড়ে যাওয়া, কেরোসিন, কাপড় ওষুধের দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়া ইত্যাদি সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা ফায়দা তোলার চেষ্টা করেন কিন্তু ব্রিটিশ সরকার এই অপচেষ্টা আটকাতে তেমন উদ্যোগী হয়নি ৷
অসহযোগ আইন অমান্য আন্দোলনে ভারতবাসী স্বাধীনতা আকাঙ্ক্ষাকে তীব্রতর করে তুলেছিল ভারতবর্ষে চেয়েছিল শেষবারের মতো এক সর্বভারতীয় গণ আন্দোলন গড়ে তুলে ব্রিটিশদের কাছে থেকে তাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে ৷ ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে দেশের শীর্ষ নেতাদের জঙ্গি মানসিকতা বিশেষত গান্ধীজীর অবমাননীয় মনোভাব একটি গণ আন্দোলনের পটভূমি রচনা করেন ৷ জাতীয় নেতাদের গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎগতিতে আন্দোলন ভারতের সর্বোচ্চ ছড়িয়ে পড়ে ৷ "ইংরেজ তুমি ভারত ছাড়ো" ধ্বনিতে আকাশ বাতাস আলোড়িত হতে থাকে ৷
ভারতছাড়ো আন্দোলন বা ৪২ এর আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিল বাংলা বোম্বাই,আমেদাবাদ পাটনার মত কলকাতা ও ঢাকা শহরে এই আন্দোলন লক্ষ্য করা যায় ৷ বাংলায় বিভিন্ন অঞ্চলে যেমন তমলুক কাথী, মালদাহ, যশোর, নদীয়া বরিশাল প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে ৷ 1942 খ্রিস্টাব্দে আগস্ট মাসে বাংলায় যে আন্দোলন শুরু হয় তার মধ্যে মেদিনীপুর জেলার জনগণের অংশগ্রহণ শীর্ষস্থান অধিকার করে আছেন ৷ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে ভারত ছাড়ো আন্দোলনই ছিল ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার প্রধান গণঅভ্যুত্থান ৷ মেদিনীপুর জেলার সকল শ্রেণীর নারী-পুরুষ যুবক এই বিদ্রোহের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ নিয়েছিল ৷ এক সরকারি প্রতিবেদন থেকে মেদিনীপুরের ৪২ এর বিদ্রোহের গভীরতা ও ব্যাপকতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় ৷ মেদিনীপুরের বিদ্রোহী জনতা একটি প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর মতোই নিজেদের সংগঠন কর্মসূচী নেতৃত্ব ইত্যাদি পরিকল্পিতভাবে গ্রহণ করতেন ৷ শিক্ষা বাহিনীর গোপন সংবাদ সংগ্রহ, যুদ্ধক্ষেত্রে আহতদের সেবা করা,সমর কৌশল ইত্যাদি বিষয়ে তাদের পূর্ব পরিকল্পনা করা থাকতো ।
তমলুক মহাকুমায় ভারতছাড়ো আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র ছিল তমলুক, সুতাহাটা, নন্দীগ্রাম ৷ বিদ্রোহীরা এক সভায় স্থির করেন যে একসঙ্গে থানা, আদালত ও কয়েকটি সরকারি দপ্তর আক্রমণ করা হবে ৷ এই জন্য 'বিদ্যুৎ বাহিনী' নামে স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গঠন করা হয় ৷ জেলা সদর থেকে আক্রমণের লক্ষ্যে স্থল গুলি বিচ্ছিন্ন করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় । ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে বড় বটগাছ কেটে রাস্তা গুলির ওপর ফেলে রাখা হয় ৩০ টি রাস্তার ওপর থাকা ছোট ছোট সেতু ভেঙে ফেলা হয় । টেলিগ্রাফ ও টেলিফোনের তার কেটে দেওয়া হয় । প্রায় ১৯৪টি টেলিগ্রাফ এর খুঁটি উপড়ে ফেলা হয়, পূর্ব পরিকল্পনার মত প্রায় ২০,০০০ স্বেচ্ছাসেবী পাঁচটি পৃথক দলের বিভক্ত হয়ে আক্রমণ চালায় ৷
তমলুক থানা দখলের সময়ে অপূর্ব দেশভক্তি ও সাহস দেখান আন্দোলনকারী জনতা ৷ নির্ভয়ে ব্রিটিশ তমলুকের গুলির সামনে বুক পেতে দেয় অসীম বীরত্ব দেখায় গ্রাম্য গৃহবধূ ৭০ বছর বয়স্ক বিদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা পুলিশের হুমকি অগ্রাহ্য করে তিনি জাতীয় পতাকা হাতে তমলুক থানা ও মহকুমা শাসকদের দপ্তরের দিকে এগোতে থাকলে সেনা ও পুলিশ তাকে গুলি করে । এই অবস্থাতেই তিনি জাতীয় পতাকা তুলে ধরে তিনি দেশীয় সেনাদের ইংরেজদের চাকরি ছেড়ে আসার আহ্বান জানায় । এই সময় দ্বিতীয় গুলি এসে তার কপালে বৃত্ত হয় বন্দেমাতারাম বলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ৷ বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা সাহস ও আত্মত্যাগের ঘটনা সারাদেশে ৪২ এর বিপ্লবীদের গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে ৷
সুতো হাঁটাই সামরিক পোশাকে শিক্ষিত বিদ্যুৎ বাহিনী ও ভগিনী সেনা সিবির' পরিচালিত বিশাল জনতা থানা দখল করে আগুনে ভগ্নিভূত করে ৷ মহিষাদল থানাতেও বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা সমবেত হয়ে স্বাধীনতা প্রস্তাব দেয় ৷ দেশীয় সিপাহীরা আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করতে অস্বীকার করেন ভগবানপুর থানা দখলের অভিমানের নেতৃত্ব দেন ঋষিকেশ গায়েন ৷ এখানে পুলিশের গুলিতে ১৭ জন শহীদ হন ৷ আবার নন্দ্রীগ্রাম থানা দখল করতে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন ৫ জন ৷ ১৯৪২ এর অক্টোবরের মধ্যে সুতাহাটা পটাশপুর খেজুরি থানা এলাকায় আন্দোলনকারীদের হাতে চলে যায় ৷ বাংলায় গভর্নর হার্বার গোটা পরিস্থিতিকে প্রতিরোধ করার জন্য সেনাবাহিনীর পূর্ণরক্ষার প্রয়াগের দাবি তোলেন ৷
কাথি মহাকুমাতে প্রায় চার হাজার স্বেচ্ছাসেবক দলে দলে ভাগ হয়ে দপ্তর আক্রমণ করেন এবং গ্রামে গ্রামে আন্দোলন সংঘটিত করে ৷ স্কুল, কলেজ, সরকারি, দপ্তর, আদালত, দোকান, বাজার সব অচল হয়ে থাকে কারণ ছাত্র, শিক্ষক, সরকারি কর্মী,আইনজীবী সহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষ আন্দোলনে যোগ দেন ৷ পিছাবলি গ্রামে পুলিশ ১১ জন স্বেচ্ছাসেবক কে গ্রেফতার করেন বিশাল জনতা পুলিশকে ঘেরাও করে রাখে, এদের দাবি ছিল সহকর্মীদের মুক্তি না দিলে আরো পিছাবলি বাধ্য হয়ে পুলিশ ১১ জনকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় ৷ একই দিনে পুলিশ স্বেচ্ছাসেবকদের একটি শিবিরে আক্রমণ করে অত্যাচার চালায় এবং ৪০ জনকে গ্রেফতার করে ৷ আন্দোলনকারীর থানা সরকার টেলিগ্রাম অফিস আক্রমণ করে ও তা ধ্বংস করে ৷ তবে অক্টোবরের শুরু থেকেই সেনাবাহিনী গ্রামে গ্রামে গিয়ে নির্যাতন চালাতে শুরু করে ৷ বেতাব নারী ধর্ষণ ইত্যাদি চালিয়ে ব্রিটিশরা সেনা আন্দোলন কারীদের ওপর প্রতিশোধ নিতে থাকে ৷ ডক্টর রমেশ চন্দ্র মজুমদার ইংরেজদের এই অত্যাচারকে মারাঠা বর্গির আক্রমণের থেকে নিশংস বলে অভিহিত করেছেন ৷"
উত্তরপ্রদেশের বালিয়া মহারাষ্ট্রের সাতারার মতো মেদিনীপুরের তমলুক মহাকুমাতেও ও তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় ৷ ১৬ অক্টোবর প্রচন্ড ঝড় ও বন্যায় মেদিনীপুর গ্রাম জীবনকে বিধ্বস্ত করেছিল ৷ তা সত্বেও বিদ্রোহের বিশিষ্ট নেতা অজয় কুমার মুখোপাধ্যায় জানিয়ে দেন যে কোন কারনেই আন্দোলন বন্ধ হবে না ৷ এর কিছু দিন পরেই তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করে বিপ্লবীরা ব্রিটিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন ৷ জাতীয় সরকারের সর্বাধিনায়ক হন সতীশ চন্দ্র সামন্ত আর্য সচিব ও স্বরাষ্ট্র সচিব হন অজয় মুখোপাধ্যায় ও সুনীল কুমার ধারা ৷ জাতীয় সরকার নানা স্থানেই নিজস্ব জেলা ও থানা গড়ে তোলে এই সরকার অর্থ সংগ্রহের জন্য জমিদারদের কাছ থেকে জরিমানা আদায়,অপহরণ করে অর্থ আদায়,ডাকাতি ইত্যাদি কর্মসূচি গ্রহণ করে ৷
জাতীয় সরকার ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্তদের নানাভাবে সাহায্য করেন ৷ বিচার আইনশৃঙ্খলা, স্বাস্থ্য,শিক্ষা , কৃষি ইত্যাদি নানা দপ্তর প্রতিষ্ঠা করে প্রশাসনিকের সক্রিয় রাখার চেষ্টা করেন ৷ সরকার অবশ্যই এই ব্যবস্থা মেনে নেয়নি ৷ পুলিশ ও সেনাবাহিনী দিয়ে আন্দোলনকারীদের নানাভাবে নির্যাতন চালানো হয় ৷ ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার টিকে ছিল ৷ জাতীয় সরকারকে নানাভাবে শক্তি তো যোগায় কমিউনিস্টরা এমনকি মুসলমানরাও জাতীয় সরকারের সমর্থনে এগিয়ে যান । মে মাসে সতীশ চন্দ্র সামন্ত বন্দী হলে অজয় মুখোপাধ্যায় সর্বাধিনায়ক হন ৷ তিনিও কারারুদ্ধ হলে আন্দোলন চালিয়ে যান সুনীল কুমার ধারা ৷ তবে শেষ পর্যন্ত গান্ধীজীর আহবানে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার নিজের অস্তিত্বের অবসান ঘোষণা করেন ৷
আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা গুলিকে ৪২ এর আন্দোলনের ব্যাপক আকার দেয় ৷ কলকাতা স্কুল কলেজ পরিবহন বন্ধ করে হরতাল পালিত হচ্ছে ৷ টেলিগ্রাফ টেলিফোন ও বিদ্যুৎ সংযোগ বাহিনী তার ও খুঁটি উপড়ে ফেলা হয় ৷ সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সংঘটিত মিছিলে হাজার হাজার মানুষ ইংরেজ ভারত ছাড়ো ধনী দিতে দিতে শহর পরিক্রমণ করে ৷ ঢাকা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ যশোর প্রভৃতি পূর্ব বাংলার শহর গুলিতে ও আন্দোলন দানাবাদে ৷ এমনকি হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান, বীরভূম প্রভৃতি জেলার আগস্ট আন্দোলনের জনগণকে ব্যাপক অংশগ্রহণ করেছে ৷ জনতার আক্রমণে রেলস্টেশন, ডাকঘর বিভিন্ন সরকারি অফিস ও আদালত ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় । পুলিশ নির্মম অত্যাচার চালিয়ে আন্দোলন স্তব্ধ করার চেষ্টা করে ৷ তা সত্ত্বেও প্রায়ই দু সপ্তাহ জনতার অভ্যুত্থান অব্যাহত ছিল ৷
ডঃ সব্যসাচী ভট্টাচার্যের মতে ১৯৪২ সাল বাংলার ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রমী বছর ৷ কংগ্রেসের নেতারা জনগণকে সংঘটিত করার কাজে বিশেষ ভূমিকার না নিলেও জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কংগ্রেসের পতাকা হাতে নিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপ দিয়েছিল ৷ আন্দোলন শুরুর আগে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে কংগ্রেসের সদস্য সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছিল ৷ তবে ৪২ এর অভ্যুত্থানের সময় কংগ্রেসের জনসংখ্যা অনেকটাই বৃদ্ধি পায় ৷ ডঃ ভট্টাচার্য দেখিয়েছেন যে বাংলাতেও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে মুসলমানদের অংশগ্রহণ ছিল খুব কম , এমনকি মুর্শিদাবাদের মতো মুসলিম ঔষধ এলাকাতেও মুসলিম ছিল মাত্র 2% ৷ এটি ছিল জাতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক বিভেদ মূলক প্রবণতার অন্যতম পরিণতি ৷ তা সত্ত্বেও এ কথা বলা যায় যে ১৯৪২ সালের আন্দোলন যেভাবে জাতীয় জাগরণ ঘটিয়েছিল ইতিপূর্বে তা দেখা যায়নি ৷
সম্ভাব্য প্রশ্নঃ
- ভারতছাড়ো আন্দোলনের পটভূমি ও অগ্রগতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও
- ১৯৪২ এর আগস্ট আন্দোলন সম্পর্কে যা জানো লেখো
- ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারতছাড়ো আন্দোলন সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লেখ
- ভারতছাড়ো আন্দোলনের প্রকৃতি আলোচনা কর? এই আন্দোলনের গুরুত্ব কি