১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে মেইজি জাপানের সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো। Discuss the main features of the Japanese Constitution of 1889
১৮৬৮ খ্রিঃ জাপানের সম্রাট কর্তৃক প্রদত্ত তথাকথিত সংবিধানে 'চাটার ওথ' নামে পরিচিত একটি শর্ত অনুযায়ী জাতির ইচ্ছানুসারে দেশের শাসন পরিচালনার প্রস্তাব করা হয়। 'চার্টার ওথের' ওপর ভিত্তি করেই জাপানে সংবিধানের আন্দোলন শুরু হয় এবং এই আন্দোলনের মধ্যে প্রতিনিধিমূলক সরকার গঠনের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়। সংবিধান সংক্রান্ত আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করে 'উগ্রপন্থী দল' নামে পরিচিত রাজনৈতিক গোষ্ঠী। বেসামরিক আমলাদের মধ্য থেকেই ইহা গঠিত হয় এবং এই দলের নেতৃত্ব লাভ করেন ইতাগাকি-ও-ওকুমা। ১৮৮৩ খ্রিঃ প্রিন্স ইতোরের ওপর সংবিধান রচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রিন্স ইতো-র তত্ত্বাবধানে সংবিধান রচিত ও পরিমার্জিত হওয়ার পর প্রিভি কাউন্সিল তা অনুমোদন করে ১৮৮৯ খ্রিঃ স্বয়ং সম্রাট জাতির নিকট এই সংবিধান ঘোষণা করেন। ১৮৯০ খ্রিঃ এই সংবিধান কার্যকরী করা হয়।
সম্রাটের ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের আদর্শ অনুসরণ করে সম্রাটই সমস্ত ক্ষমতার উৎস এবং সমস্ত সুযোগ-সুবিধা দানের অধিকারী এবং সামন্ততান্ত্রিক প্রয়োগ করেন- এই দুটি চিন্তাধারার সমন্বয় সাধন করে জাপানের নতুন সংবিধান রচিত হয়। সংবিধানের প্রথম অধ্যায়ে সম্রাটের ক্ষমতা ও মর্যাদা সম্পর্কে আলোচনা করা হয় এবং সম্রাটের ক্ষমতাকে পবিত্র ও অলঙ্ঘনীয় বলে বর্ণনা করা হয়।
সম্রাটকে সাম্রাজ্যর প্রধান রূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তবে সম্রাট মন্ত্রিপরিষদ ও প্রিভি কাউন্সিল নামে দুটি সাংবিধানিক পরামর্শ পর্ষদের মাধ্যমে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন। স্কুল ও নৌবাহিনীর প্রধান অধ্যক্ষের পদ অধিকার করার, সামরিক ও বেসামরিক উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের নিযুক্ত করা, ডিট এবং অনুমতি অনুসারে আইন প্রণয়ন ও প্রবর্তন এবং অর্ডিন্যান্স ঘোষণা করার সুযোগ ভোগ করতেন। তবে সম্রাটের ঘোষিত কোনো অর্ডিন্যান্স প্রচলিত কোনো আইনের পরিবর্তন সাধনে অসমর্থ ছিল।
সম্রাটের মনোনীত ব্যক্তিদের দ্বারা মন্ত্রিপরিষদ ও প্রিভি-কাউন্সিল গঠিত হত। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ তাঁদের কার্যকলাপের জন্য ডিট-এর পরিবর্তে সম্রাটের নিকট দায়ী থাকতেন। সংবিধান রচিত হবার পূর্বেই এই দুটি প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। ১৮৮৯ খ্রিঃ সংবিধানের চতুর্থ অধ্যায়ে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়।
সংবিধানে উল্লেখ না থাকলেও পরবর্তীকালে কর্ম পরিষদের আর একটি সংস্থা গঠিত হয়। এই সংস্থা 'Genro' (Elder Statesmen) নামে পরিচিত। সম্রাটের ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের পর জাপানের রাজনৈতিক পরিবর্তনের যুগের প্রভাবশালী ও প্রধান প্রধান ব্যক্তিগণ এই সংস্থার সদস্যপদ লাভ করেন। এই সংস্থার সদস্যগণ যুদ্ধঘোষণা শান্তিস্থাপন প্রভৃতিসহ শাসনতান্ত্রিক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে নীতি নির্ধারণ, এমনকি মন্ত্রিপরিষদের ও প্রিভি-কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতেন।
জাপানের নতুন সংবিধানের সর্বাপেক্ষা বৈশিষ্ট্যপূর্ন সংস্থা ছিল ডিট (Diet) অর্থাৎ জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত আইনসভা। ডিট দুটি কক্ষে বিভক্ত ছিল-উচ্চকক্ষ দেশের সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত হত। এই কক্ষের সদস্যবৃন্দ তাঁদের শ্রেণীর নির্বাচিত ব্যক্তিরূপে অথবা ব্যক্তিগত যোগ্যতার বলে আইনসভায় প্রবেশ করার সুযোগ পেতেন। নিম্নকক্ষের সদস্যবৃন্দ নির্বাচকমন্ডলীর দ্বারা নির্বাচিত হতেন। ডিটের অধিবেশন আহ্বান, স্থগিত ও বাতিল করার অধিকার সম্রাট ভোগ করতেন। নতুন প্রণীত সকল আইনের উভয় কক্ষের সম্মতি লাভ করা প্রয়োজন হত। প্রত্যেক বছর অন্তত তিন মাসের জন্য ডিটের অধিবেশন আহ্বান করার জন্য সংবিধানে একটি শর্ত গৃহীত হয়। তবে প্রয়োজন হলে সম্রাট যে কোনো সময় আইনসভার অধিবেশন আহ্বান করতে পারেন।
সংবিধানের ষষ্ঠ অধ্যায়ে রাষ্ট্রের অর্থসংক্রান্ত বিষয়াদি আলোচিত হয়। আইনসভার নিম্নকক্ষকে অর্থসংক্রান্ত বিষয়ের উপর কর্তৃত্ব করার ন্যূনতম ক্ষমতা দেওয়া হয়। তবে কর ধার্য এবং প্রচলিত করের কোনো প্রকার পরিবর্তন বা পরিবর্ধনের জন্য ডিটের উভয় সভার সম্মতির প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কয়েকটি কর ধার্যের ব্যাপারে গলার স্বাধীনতা ভোগ করত। বায়-সংক্রান্ত বিষয়েও আইনসভা খুব সীমিত ক্ষমতা ভোগ করত। একমাত্র অতিরিক্ত ব্যয়বরাদ্দের সময় আইনসভার সদস্যবৃন্দ আলাপ-অলোচনা করার ও বাধা দেওয়ার সুযোগ পেতেন।
সংবিধানে আরও তিনটি অধ্যায় রয়েছে। পঞ্চম অধ্যায়ে রাষ্ট্রের কার বিভাগ এবং বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। দ্বিতীয় অধ্যায়ে নাগরিকের অধিকার এবং কর্তব্য সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়। তবে নাগরিকের অধিকার দেশের প্রচলিত আইনের সাথে পূর্ণ সঙ্গতি রেখেই বিধিবদ্ধ করার হাবস্থা করা হয়। সংবিধানের সপ্তম অধ্যায়ে কয়েকটি শর্ত ও প্রস্তাব সংযোজন করা হয়। এইসব সংযোজনের মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হল সংবিধান সংশোধনের শর্তাবলী। তবে একমাত্র সম্রাট-ই সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব উত্থাপন করার অধিকার ভোগ করতেন।
১৮৯০ খ্রিঃ নতুন সংবিধান অনুযায়ী জাপানের শাসনব্যবস্থা প্রচলিত হলেও নতুন নতুন নানা রূপ সমস্যার উদ্ভব হয়। পরবর্তী চার বছরের মধ্যে দু-বার আইনসভা ভেঙে দিয়ে নতুন আইনসভা গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়। বিশেষতঃ বাজেট সংক্রান্ত বিষয়েই আইনসভায় প্রবল অসন্তোষ ও বিক্ষোভ দেখা দেয়। তবে ১৮৯৪ খ্রিঃ চীন-জাপান যুদ্ধ শুরু হবার পর জাপানের রাজনীতিবিদগণের দৃষ্টি অভ্যন্তরীণ বিষয় থেকে বৈদেশিক বিষয়ে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হলে সংবিধান সংক্রান্ত সংঘর্ষ বহুলাংশে দূরীকৃত হয়।
১৮৬৮ খ্রিঃ সম্রাট প্রদত্ত চার্টার ওথের ভিত্তির ওপর নির্ভর করে জাপানের সংবিধান রচিত হলেও সম্রাটের তদানীন্তন উদার মনোভাব এই সংবিধানে যথাযোগ্য স্থান লভা করেনি। সামুরাই শ্রেণীর মুখপাত্র হিসাবে কাউন্ট পরবর্তীকালে প্রিন্স ইতো জাপানের সংবিধান রচনা করার পূর্ণ দায়িত্ব লাভ করেন। সংবিধান রচনার সময় তিনি তিনটি মৌলিক নীতির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন- ক) জাতির প্রতি সম্রাটের উপহার হিসাবে সংবিধানের স্বীকৃতি, খ) সামন্ত প্রথা বিলুপ্তির পর ক্ষমতায় আসীন শ্রেণীর অধিকার ও মর্যাদার যথোপযোগী সংরক্ষণ এবং গ) জনপ্রতিনিধিমূলক সংস্থা গঠন। এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য তিনি প্রথম ও দ্বিতীয় বিষয় দুটির উপর বিশেষ গুরুত্ব দেন এবং তৃতীয় বিষয়টিকে যথাসম্ভব অবহেলা করেন। কারণ প্রজাতান্ত্রিক সরকার গঠনের পরিবর্তে তিনি 'নিয়ন্ত্রিত রাজতন্ত্র' গঠন করার চেষ্টা করেন।