রুশ শিল্পায়নে রাষ্ট্রের ভূমিকা অথবা,রুশ শিল্পায়নে রাষ্ট্রের ভূমিকা আলোচনা কর
রুশ শিল্পায়নে রাষ্ট্রের ভূমিকা:
অষ্টাদশ শতকের ইউরোপের একটি তাৎপর্যময় ঘটনা হলো শিল্প বিপ্লব। এই শিল্প বিপ্লব সর্বপ্রথম ইংল্যান্ডে শুরু হয়েছিল এরপর থেকে ধীরে ধীরে ইউরোপের বিভিন্ন মহাদেশের ছড়িয়ে পড়ে। ইউরোপের বৃহৎ দেশগুলির মধ্যে রাশিয়ার শিল্পায়ন সবচেয়ে দেরিতে শুরু হয়েছিল। বলা যায় উনিশ শতকের চল্লিশের দশকে রাশিয়ার বস্ত্রশিল্পে আধুনিক প্রযুক্তির প্রথম প্রয়োগ হয়, কিন্তু রাশিয়ার শিল্পবিপ্লব অব্যাহতগতিতে এগোতে পারেনি। ষাটের দশকে জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার ভূমিদাসদের মুক্তি দিয়ে ও অন্যান্য সংস্কার প্রবর্তন করে শিল্পায়নের পরিবেশ তৈরি করে দেন। ভূমিদাসরা মুক্তি পাবার পর শিল্পে শ্রমিকের সরবরাহ বেড়েছিল। তাছাড়া এই সময় থেকে শিল্পপতি, বণিক, কারিগর ইত্যাদিকে নিয়ে উদ্যমী মধ্যবিত্তশ্রেণির আবির্ভাব হয়। উনিশ শতকের শেষদিক থেকে, বিশেষ করে নব্বুই-এর দশক থেকে, শিল্পায়নের গতি দ্রুততর হয়।) গোরসেনক্রনের (Gerschenkron) হিসেব অনুযায়ী এই সময় রাশিয়াতে উন্নয়নের হার ছিল ৮ শতাংশ। স্টোলিপিনের সংস্কার বিশ শতকের গোড়ার দিকে রাশিয়ার কৃষি অর্থনীতির পরিবর্তন ঘটিয়েছিল, কৃষির উৎপাদন বেড়েছিল, কৃষকের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। শিল্পে শ্রমিকের জোগান বেড়েছিল কারণ জনসংখ্যা বেড়ে চলেছিল, কৃষকদের ওপর গ্রামীণ মিরের নিয়ন্ত্রণ ছিল না, কৃষকরা মুক্তি পেয়েছিল।
রাশিয়ায় শিল্পায়নের ক্ষেত্র তৈরি করে দেন অর্থমন্ত্রী উইট (Witte) (১৮৯২-১৯০৩)। তিনি রাষ্ট্রের নেতৃত্বে শিল্পায়নের পরিকল্পনা করেন। দেশে রেলপথের বিস্তার ঘটেছিল, তিনি শুল্ক ব্যবস্থার সংস্কার করেন এবং বিদেশিদের আকৃষ্ট করার জন্য স্বর্ণমান চালু করেন। আমদানি কমিয়ে রপ্তানি বাড়িয়ে তিনি পুঁজি সংগ্রহ করেন। ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম ও ইংল্যান্ডের পুঁজিপতিরা এখানকার শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগ করেছিল। উনিশ শতকের শেষদিকে রাশিয়ায় ২৫,০০০ বেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল, এই শিল্পগুলি আটটি শিল্পাঞ্চলে কেন্দ্রীভূত ছিল। এই শিল্পাঞ্চলগুলিতে মৌলিক ও ভারী শিল্প স্থাপিত হয়। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়াতে লগ্নিকৃত বিদেশি মূলধনের পরিমাণ ছিল ৯০০ মিলিয়ন রুবল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে রাশিয়ায় লগ্নিকৃত মোট মূলধনের এক-তৃতীয়াংশ ছিল বিদেশি।
এই সমস্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ফলে রাশিয়ায় বস্তু, কয়লা, লোহা, ইস্পাত, ধাতু, রাসায়নিক, তেল ও বিদ্যুৎ শিল্প গড়ে উঠেছিল। রাশিয়ার শিল্পবিপ্লবের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বিদেশি সহায়তায় অতি দ্রুত শিল্পায়ন। ইউরোপের আধুনিক প্রযুক্তি এই শিল্পায়নের কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল। ইংল্যান্ডের মতো রাশিয়ায় ছোটো ও মাঝারি শিল্প থেকে বৃহদায়তনের যন্ত্রশিল্প গড়ে ওঠেনি। অতি অল্প সময়ের মধ্যে রাশিয়ার আধুনিক বৃহদায়তনের যন্ত্রশিল্পগুলি গড়ে উঠেছিল।
রাশিয়ার শিল্প পণ্যের প্রধান ক্রেতা ছিল ঐ দেশের সরকার। এশিয়ায় পারস্য, আফগানিস্তান, চিন তুরস্ক ও মঙ্গোলিয়া প্রভৃতি দেশ রাশিয়ার শিল্প পণ্য কিনত। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ব্যর্থ বিপ্লবের পর রাশিয়ার শিল্পায়ন আবার দ্রুতগতিতে চলতে থাকে। এইভাবে রাশিয়া এক শিল্প পরিপূর্ণ দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল।