লর্ড কার্জন কেন বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব দিয়েছিল এবং এর তাৎপর্য কি অথবা,বঙ্গ ব্যবচ্ছেদ এর পরিকল্পনা কি প্রশাসনিক প্রয়োজনে গৃহীত হয়েছিল অথবা, বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা কতটা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল
পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন এবং বৈদিক পুনরুজ্জীবনের ফলে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দী জুড়ে বাংলা প্রদেশে একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছিল । তার মধ্যে দিয়ে উপনিবেশিক ব্যবস্থা এক নব উথিত শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে । ব্রিটিশ শাসনের প্রথাগত আমলে সরকারী কেরানি হিসাবে কাজ করা লোকেরা পশ্চিমা জ্ঞান, বিজ্ঞান এবং দর্শনের সংস্পর্শে আসার ফলে রাজনৈতিক চেতনা বিকাশ করেছিল । এই রাজনৈতিক চেতনা শেষ পর্যন্ত একাধিক রাজনৈতিক সভা গঠনের দিকে পরিচালিত করে, যা 1885 সালে জাতীয় কংগ্রেসে পরিণত হয় । ব্রিটিশ সরকার 1857 সালের মত বিদ্রোহ প্রতিরোধের প্রচেষ্টায় এই দলটিকে স্বীকৃতি দেয় । যাইহোক, বাংলা ধীরে ধীরে রাজনৈতিক কেন্দ্রে বিকশিত হয় । কার্যকলাপ কারণ শিক্ষিত বাঙালিরা নব্য- জাতীয়তাবাদে বিচলিত ছিল, ব্রিটিশ প্রশাসন এই ব্যক্তিরা কী করছে সেদিকে খুব একটা নজর দেয়নি । এমন পরিস্থিতিতে লর্ড কার্জন বাংলা ও ভারতের ভাইসরয় হিসেবে আগমন করেন ।
লর্ড কার্জন যখন ভারতে আসেন, তখন তিনি বেশ কিছু প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন আনেন । কিন্তু বাঙালা বিভাজনই সবচেয়ে বড় বিতর্কের জন্ম দেয় । বাঙ্গালীরা বিভিন্ন কারণে অনেক অসুখী ছিল । বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে এর বিস্ফোরণ ঘটে । লর্ড কার্জনের বাংলাকে ভাগ করার প্রস্তাব বাংলা ও ভারত উভয়ের জাতীয়তাবাদী নীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় । বিপিন চন্দ দাবি করেন যে বাংলাদেশের বিচ্ছেদ ঘোষণা জাতীয় সংগ্রামের দ্বিতীয় পর্বের সূচনা করে এবং উগ্র রাজনৈতিক দলগুলোর উত্থান ও বৃদ্ধির দরজা খুলে দেয় ।
বঙ্গভঙ্গোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনীতিবিদ ও ঐতিহাসিক মহলে তুমুল বিতর্ক দেখা গেছে । সাম্রাজ্যবাদকে সমর্থনকারী ইতিহাসবিদরা দাবি করেন যে কার্জন প্রশাসনিক প্রয়োজনে এই পছন্দটি করেছিলেন । অন্যদিকে, অন্যদিকে সমসাময়িক ও পরবর্তীকালের জাতীয়তাবাদীরা বলেন লর্ড কার্জনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল "বিভেদ ও শাসন নীতি" কায়েম করে বাংলার নবদিত ও জাতীয়তাবাদী শক্তিকে দুর্বল করা । শাসনের সুবিধাগুলো ছিল শুধু অজুহাত মাত্র । প্রশাসনিক উদ্বেগগুলি 1903 সাল পর্যন্ত প্রাধান্য পেয়েছিল । বাংলার মাত্রা মাঝে মাঝে অনেক ব্রিটিশ কর্মকর্তাকে শঙ্কিত করেছে । যদিও এটি কার্জনের প্রশাসনের অধীনে পরিচালিত হয়েছিল, তবে বাংলাকে টুকরো টুকরো করার চক্রান্ত অনেক আগে থেকেই চলছিল ।
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
1857 সালের মহান বিদ্রোহ ভারতের সরকারী কাঠামো পুনর্গঠনের জন্য ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করেছিল । তখন থেকেই তারা বাংলা ভাগ করার প্রস্তাব বিবেচনা করে আসছে । ১৮৭৪ এর ১ আসামকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং ১৮৭২ এর মধ্যে শ্রীহট্ট ও লুসাইকে আসামের অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব এসেছিল । ১৮৯৭ এ আসামের প্রধান কমিশনার উইলিয়াম ওয়ার্ড সর্বপ্রথম একটি ধারণা জন্ম দিয়েছিলেন যে চট্টগ্রাম,নোয়াখালী, ত্রিপুরা, ঢাকা সহ ময়মনসিংহ কে নিয়ে বাংলা থেকে পৃথক করে আসামের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত । যাইহোক, বিষয়টি অমীমাংসিত রেখেছিল এবং বাংলা বিভাগের প্রসঙ্গটি আবার উত্থাপিত হয়েছিল । "অ্যন্ড্র ট্রেডার" 1901 সালে বারলাট কার্জনকে মধ্যপ্রদেশ ও বাংলার মধ্যে সীমানা পুনর্নির্মাণের প্রস্তাব দেন । এরই মধ্যে বাংলার জনসংখ্যা ৭ কোটি ৮০ লক্ষ এবং অ্যন্ড্র ট্রেডার বাংলার ছোট লাট হন ৷ কার্জনের নির্দেশে ফ্রেডার ১৮৯৬ এর ওয়াডের পরিকল্পনাটাই সামান্য রদবদলে করে 1903 এর ২৮ মার্চ কার্জনের কাছে পেশ করেন । পরিকল্পনাটি অনুমোদন করে, স্বরাষ্ট্র সচিব রিজলি চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতার বাণিজ্যিক সুবিধার উল্লেখ করেন । তিনি তার বার্তায় বেশ স্পষ্ট করে বলেছিলেন যে যদিও আসাম চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে প্রতিযোগিতায় খুশি হবে, তবে বাংলা এতে বিশেষ আগ্রহী নয়, তাই তিনি এই প্রস্তাবটিকে সমর্থন করেন যদি এটি বাস্তবায়ন করা যায় । ফ্রেজারই প্রথম যিনি বিভাজন থেকে বাংলার রাজনৈতিক লাভের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, যা কার্জন সমর্থন করেছিলেন । শেষ পর্যন্ত, ১৯০৩ এবং ৩রা ডিসেম্বরের প্রস্তাবের দলিলটি "রিজলে পেপার" নামে সর্বশ্রিকরণের প্রকাশিত হয় ।
মনে হয় কার্জন বাংলা বিভাগের এই ধারণার সাথে জড়িত ছিলেন না । এটি ছিল রেজালের কর্তৃত্ব এবং ফ্রেজারের ধারণা । অ্যান্ড্রু ফ্রেজার ভেবেছিলেন কলকাতার কয়েকটি সাময়িকী এবং কয়েকজন নেতা এই এলাকায় বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের উদ্রেক করতে পারে । এইভাবে, তিনি পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়ার ইচ্ছা করেছিলেন । আমি এই বিষয়ে ফ্রেজার এবং রেসলির সাথে একমত প্রকাশ করেছিলেন । সরকারের পরিকল্পনা স্বর্গের আগে প্রচারের সাথে সাথে সমগ্র বাংলাদেশ জাতি প্রতিবাদে উত্তেজিত হয় । 1903 সালে কংগ্রেস অধিবেশনে রিজালের বাংলাকে বিভক্ত করার প্রস্তাবকে "জঘন্য" বলে অভিহিত করা হয় । বাংলা ভাগের পরিকল্পনা সফল হলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিভক্ত হবে এবং জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠবে ।
কার্জন এবং পরবর্তী ইংরেজ শাসকদের মতে, প্রশাসনিক কারণে ব্রিটিশ প্রশাসন বাংলাকে ভাগ করেছিল । তবে জাতীয়তাবাদীরা তাদের অভিযোগ তুলেছে । বৃটিশ সরকার বাংলার জাতীয় আন্দোলনকে তার মূল থেকে আক্রমণ করতে চেয়েছিল । কার্জন এই মুহুর্তে তার চিঠিতে তার লক্ষ্য স্পষ্ট করেছেন । তার মতে বাঙালিরা নিজেদেরকে মহান দেশ মনে করে । কলকাতার লটপ্রসাদের কর্তৃত্ব একজন বাবুর উপর ন্যস্ত থাকবে । সুতরাং বঙ্গ ভঙ্গের পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে ভারতবর্ষের এমন একটা শক্তিকে সংগত ও সুধীরোগ করা হবে যা অশান্তির উৎস হয়ে উঠবে । এই কথা মাথায় রেখে 1904 সালের 18 ফেব্রুয়ারি কার্জন ঢাকায় যান এবং সেখানে একটি ভাষণ দেন । পরিকল্পনাটি ছিল পূর্ব বাংলার সুপরিচিত মুসলমানদেরকে কলকাতার হিন্দু অভিজাত নেতাদের বিরুদ্ধে লিভারেজ হিসেবে ব্যবহার করা । সুমিত সরকারের মতে ইংরেজদের শাসকদের প্রকৃত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিম ও পূর্ববঙ্গের প্রভাবশালী হিন্দু রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা । রিজাল লিখেছেন, "সম্মিলিত বাংলাদেশ একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তি ওই প্রদেশ ভেঙে দিলে ওই শক্তি আর থাকবে না ৷"
কার্জন বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনার শেষ খসড়া রচনা করেন । ১৯০৫ সালে ১৬ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গের দিন ধার্য হয় এবং ওই দিনে পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হয় বাংলা 15 টি জেলা হারালো ৷ খন্ডিত বাংলা প্রদেশের জনসংখ্যা হল ৫ কোটি ৪০ লক্ষ তার মধ্যে ৪ কোটি ২ লক্ষ হিন্দু এবং ৭০ লক্ষ মুসলিম নবগঠিত প্রদেশটির নাম হলো পূর্ববঙ্গ ও আসাম যার জনসংখ্যা ছিল ৩ কোটি ১০ লক্ষ তার মধ্যে ১ কোটি ৮০ লক্ষ মুসলমান এবং ১ কোটি ২০ লক্ষ হিন্দু । বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপট আলোচনার প্রসঙ্গে যে তার জে. আর ম্যাকলেস Indian economic and social history review" তে প্রকাশিত. "The decision to partition Bengal in ১৯০৫ প্রবন্ধে জোরের সাথে বলেছেন বঙ্গ বিভাজনের সিদ্ধান্তের পেছনে শাসনতান্ত্রিক সুবিধার বিষয়টি ছিল মুখ্য এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল গৌণ ৷ তবে ডঃ সুমিত সরকার তার "Swadeshi movement in Bengali ১৯০৩-১৯০৪" গ্রন্থে সমালোচনা করে বলেন ব্রিটিশরা উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে বাংলাদেশকে ভাগ করেছিল শাসনতান্ত্রিক সুবিধার স্বার্থে কোন বিকল্প ব্যবস্থার কথা মাথায় আনেননি । রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে, ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠী বলেছিলেন যে কার্জনের বাংলাকে ভাগ করার সিদ্ধান্ত দুটি জিনিস দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল: প্রথমত, বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দুর্বল করার ইচ্ছা এবং দ্বিতীয়ত, বাঙালি জনগণের জন্য একটি প্রকাশ্য শত্রুতা । 1904 সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় কার্জনের মন্তব্যগুলি বাংলার মুসলিম ও হিন্দু জনসংখ্যার মধ্যে একটি প্রাচীর তৈরি করার তার আকাঙ্ক্ষা প্রদর্শন করে । সবই ছিল অজুহাত, শাসনতান্ত্রিক সুবিধার যুক্তি ।
তবে বাংলা ভাগের সিদ্ধান্ত সেখানকার জনগণ মেনে নেয়নি । বাংলা ভাগ করা ছিল কার্জনের সিদ্ধান্ত, যা স্বদেশী আন্দোলনের জন্ম দেয় । এই আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতের জাতীয় আন্দোলন এক নতুন উচ্চতায় উন্নীত হয় । ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের প্রায় যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ধারার আবির্ভাব ঘটেছিল ৷ এই স্বদেশী আন্দোলনের সময় রক্ষণশীল নরমপন্থী থেকে রাজনৈতিক চরমপন্থী নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ ও বয়কট থেকে বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদ ৷ শ্রমজীবী মানুষের প্রতিবাদ নারীদের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ অরণ্য এত পালন সমস্ত রাজনৈতিক ব্যাপার উৎস ছিল বঙ্গভঙ্গ কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই স্বদেশী আন্দোলন । অমলেশ ত্রিপাঠির মতে, বাঙালি জনগণ যে আঘাত সহ্য করেছিল তার প্রতিরোধে সমস্ত পটভূমির বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল ।"