ইউরোপের কৃষি বিপ্লব বলতে কি বোঝো
প্রাক শিল্প বিপ্লবকালীন ইউরোপে সমাজ ও অর্থনীতির সম্পর্কিত আলোচনার প্রথমে যে বিষয়টি স্মরণে রাখা প্রয়োজন তা হল এই পর্বের অর্থনীতি ছিল মূলত কৃষিভিত্তিক । শিল্পের ক্রমশ ও বিকাশ ঘটতে শুরু হলেও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা মূলত নিহিত ছিল গ্রামীণ কৃষির ওপর ৷ আসলে শিল্পের দ্রুত বিকাশ একান্তভাবে নির্ভরশীল ছিল কৃষির উন্নয়নের ওপর ৷ শিল্প অর্থনীতি ও কৃষি অর্থনীতির মধ্যে একটা বিভাজনরেখা থাকলেও প্রাক আধুনিক ইউরোপের এইরূপ শহুরে শিল্প অর্থনীতি ও গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতির মধ্যে সুস্পষ্ট বিভাজন রেখা নির্ধারণ করা সব সময় সম্ভব হয়নি ৷
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
প্রাক আধুনিক পর্বে ইউরোপের কৃষির বিকাশের জন্য শহর ভিত্তিক অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীলতা সেভাবে লক্ষ্য করা যায়নি ৷ কারণ এই পর্বে ইউরোপীয় কৃষি ক্ষেত্রে কিছু প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটলেও শ্রম নিবিড়তা এই ছিল প্রধান । মধ্যযুগীয় সময়কালে ইউরোপীয় অর্থনীতির স্থানীয় বাজার ও তার পশ্চাৎ ভূমির প্রয়োজনীয়তার দ্বারা ইউরোপীয় অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারিত হয়েছিল ৷
মধ্যযুগে ইউরোপের শহর ও নগরের উদ্ভব ঘটতে থাকলেও পার্শ্ববর্তী এলাকার ৫০ থেকে ১০০ মাইল এলাকা জুড়ে একাধিক পশ্চাৎ ভূমি গড়ে উঠেছিল ৷ কৃষি ক্ষেত্রে উৎব্ত্ত উৎপাদনের একটি বড় অংশ এই সমস্ত অঞ্চলে বিক্রয় করা হতো । কৃষিজ উৎপাদনের একটি অংশ অবশ্য তারা আঞ্চলিক বা সীমারেখার বাইরেও গমন করত যা কৃষি উন্নয়নকে যথেষ্ট সহায়তা প্রদান করেছিল ৷ কেননা এগুলি বুর্জোয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং বাণিজ্যিক স্বার্থের সঙ্গে সম্পৃক্তি ছিল ৷ এই কারণে এই পর্যায়ে শিল্প অর্থনীতির বিকাশের জন্য কৃষিজ সম্পদকে ব্যবহার করার প্রয়োজনীয়তা যথেষ্ট মাত্রায় ছিল ।
কৃষি অর্থনীতির সঙ্গে শিল্প অর্থনীতির সম্পর্কের বিষয়টি কিছুটা পরিমাণে প্রযুক্তিগত ও রাজনৈতিকত বিষয় দ্বারা নির্ধারিত ছিল ৷ কৃষি ক্ষেত্রে উদবৃত্ত উৎপাদন বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল ৷ আর এই ভাবেই কৃষির উদ্বুদ্ধ সম্পদ ইউরোপীয় অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রগুলিকে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল ৷ মধ্যযুগে ইউরোপের বিশেষীকরণ এবং রোটেশন পদ্ধতি কৃষি উৎপাদনকে বৃদ্ধি করেছিল ৷ ফলে জার্মানি পোল্যান্ড সহ বহু রাজ্যের শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ৷
কৃষির অগ্রগতির ক্ষেত্রে পশুর প্রজনন ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ইউরোপীয় অর্থনীতির এক নতুন দিক নির্ণয় করে ৷ পশু প্রজনন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মেষ পালকের গ্রীষ্মকালে পশুগুলিকে পর্বতের উচ্চতম অংশ নিয়ে যেতেন এবং শীতের আগে পশুগুলিকে আবার পরবর্তী নিচের দিকে নিয়ে আসতেন ৷ এর ফলে পশু প্রজনন একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশায় পরিণত হয় ৷ পাশাপাশি এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমণের দরুণ পথের বিভিন্ন স্থানে বৃহৎ ক্ষুদ্র একাধিক বাজার গড়ে উঠতে থাকে, উদাহরণস্বরূপ লন্ডন,প্যারিস ছাড়াও রাইনল্যান্ড ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে একাধিক বাজার গড়ে উঠেছিল ৷ এই বাজারগুলিকে কেন্দ্র করে কৃষি দ্রব্য সরবরাহের সুযোগ তৈরি হয় । যা কৃষি ক্ষেত্রের বিকাশ ঘটায় ৷
দেখা যায় যে ইউরোপ জুড়ে পরবর্তীকালে যে দ্রুত শিল্পায়ন ঘটেছিল তার মূল সম্ভাবনা নিহিত ছিল ইউরোপীয় কৃষির সমৃদ্ধির উপর ৷ কৃষি ক্ষেত্রে নানা পদ্ধতির প্রয়োগ বিশেষীকরণ,রোটেশন সিস্টেম ইত্যাদির মধ্য দিয়ে কৃষির যে অগ্রগতি ঘটেছিল তাকে পাথেয় করেই শিল্পায়ন ত্বরান্বিত হয় । এই প্রসঙ্গে বলা যায় ইউরোপের শিল্প বিপ্লব ছিল পূর্বতন কৃষি বিপ্লবের উপর প্রতিষ্ঠিত ৷ আলোচনা শেষে বলা যায় ইউরোপে কৃষিই ছিল তাদের অর্থনীতির ভিত্তি আর শিল্প ছিল তাদের ভবিষ্যৎ ৷
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
- ষোড়শ শতকে ইউরোপে কৃষিক্ষেত্রে কি পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল?
- ষোড়শ শতকের ইউরোপের কৃষিবিপ্লব সম্পর্কে আলোচনা করো।
- ইউরোপের কৃষি বিপ্লব