জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে জহর লাল নেহেরুর ভূমিকা লেখ অথবা,জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য গুলি কি ছিল? এ আন্দোলনে একজন স্থপতি রূপে জহরলাল নেহেরুর ভূমিকা মূল্যায়ন করো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে সোভিয়েত রাশিয়া ও আমেরিকার নেতৃত্বে বিঘ্ন দুটি পরস্পর বিরোধী গোষ্ঠীতে বিভঙ্গ হয়ে পড়ে। অর্ধদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ধনতান্ত্রিক জোট, অপরদিকে সেদিয়েও রাশিয়ার নেতৃত্বে গড়ে ওঠে সমাজতান্ত্রিক জোট। স্বাধীনতার পর পরতে এই দুই গোষ্ঠীর কোনো একটিতে যোগ না দিয়ে সম্পূর্ণ ভাবে নিরপেক্ষ থাকার নীতিই হল জোট নিরপেক্ষ নীতি ৷ জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে মূল প্রবক্তা ছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুর এবং যুগোশ্লাভিয়ার প্রধানমন্ত্রী মার্শাল টিটো । পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুর বিশ্বাস করতেন যে, সামরিক জোট প্রতিষ্ঠা করে পৃথিবীতে শান্তি আনা সম্ভব নয় । বরং এই জোট যুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি করে, তাই তার লক্ষ্য ছিল স্বাধীন ও পক্ষপাত হীন নীতি গ্রহন করে পৃথিবীতে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা ।
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
ভারতে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রধান প্রবক্তা হলেন জহর লাল নেহেরু । ১৯৪৬ খ্রীঃ ৭ই সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান হিসাবে তিনি ঘোষনা করে সে ভারত সকল গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক জোটের বাইরে থেকে সকল দেশের সঙ্গে শান্তি পূর্ণ ভাবে সম্পর্ক স্থাপন করবে । ১৯৪৭ খ্রীঃ ২২ শে ডিসেম্বর ভারতীয় পররাষ্ট্র নীতির মূল সূত্র ব্যাখ্যা করে ভারতীয় গনপরিষদে তিনি বলেন যে ভারত সর্বপ্রকার রাষ্ট্র জোট ও ক্ষমতা লাভের প্রতিযোগিতা থেকে দূরে থেকে শান্তি প্রতিষ্ঠায় স্বচেষ্ট থাকবে । ১৯৪৯ খ্রীঃ সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ গুলিকে নিয়ে তিনি একটি জোট নিরপেক্ষ কূটনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন।
ভারতের পররাষ্ট্রনীতির একটি প্রধান অঙ্গ ছিল শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ৷ ১৯৫৪ খ্রীঃ চিনের প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই দ্বিতীয়বার ভারত ভ্রমনে এলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ় হয় । ১৯৫৪ খ্রীঃ ২৯ মে এপ্রিল দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কে নির্ধারণের ক্ষেত্রে ৫টি নীতি গ্রহন করা হয় যা পঞ্চশীল নীতি নামে পরিচিত । এই পাঁচটি নীতি হল - [i].দুইটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি পারস্পারিক মর্যাদা যাপন ৷[ii]. একে অপরকে আক্রমণ না করা [iii]. একে অপরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা [iv]. পরস্পরকে সমমর্যদা ও পারস্পরিক সহযোগিতা প্রদান [v]. গণতন্ত্র ও সাম্যবাদ নির্বিশেষে শান্তিপূর্ণ সহবাস্তান ৷ নেহেরু মনে করতেন যে," পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে পারস্পরিক সম্পর্ক সই পাঁচটি নীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে তুলতে পারলে পৃথিবীতে শান্তি বজায় রাখা সম্ভব হবে।'
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন শুধুমাত্র এশিয়া-আফ্রিকা মহাদেশের ব্যাপার ছিল না। ইউরোপীয় রাষ্ট্র যুগোশ্লাভিয়াও এই আন্দোলনে যোগদান করে ৷ স্ট্যালিনের সঙ্গে মতভেদের ফলে যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো কমিউনিস্ট দল থেকো সরে আসেন এবং জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে মুক্ত করেন । আবার ১৯৫৫ খ্রীঃ এপ্রিল মাসের শুরুতে এশিয়ার ১৪টি দেশ নিজেদের মধ্যে ঐক্য সুদৃঢ় করনে সাম্রাজ্যবাদ উপনিবেশবাদ বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে শপথ গ্রহণ করেন । অপর ১৯৫৫ খ্রীঃ ১৮ই থেকে ২৬ শে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং শহরে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের ২৯ টি দেশের প্রতিনিধিরা একজোট হয়ে একজন নিরপেক্ষ আন্দোলনে মিলিত হয় যা বান্দুং সম্মেলন নামে পরিচিত ৷ এই সম্মেলনের মূল উদ্যক্তা ছিলেন পন্ডিত জহর লাল নেহেরু অব্য ইন্দোনেশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আলি- শাস্ত্রো সিদ যোজো।
বান্দুং সম্মেলনের উল্লেখযোগ্য নেতামন্ডলীর নাম হল, ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল, মিশরের গামাল আব্দুল নাসেরের এবং ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ । এখানে উল্লেখ্য যে,পাকিস্তান, ইরান, ইরাক প্রভৃতি পশ্চিমী জোট ভুক্ত ৬টি দেশ এই সম্মেলন যোগদান করেন ৷ বলা হয় যে এই সম্মেলন থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সূচনা হয় ৷ এই সম্মেলনে উপনিবেশিক শাসনের অবসান,এশিয়া আফ্রিকা থেকে বর্ণ বিদ্যের নির্মূলী বারন, আনবিক ও পারমানবিক অস্ত্রের পরীক্ষণ ও ব্যবহার নিষিদ্ধ কারণ প্রভৃতি বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হয় । পাকিস্তান সম্মেলনে যোগদান করে । বান্দুং সম্মেলনে জহরলাল নেহেরুর পঞ্চশীল নীতি দশশীল নীতিতে পরিণত হয় ।
নেহেরু, নাসের,সুকর্ণ ও মার্শাল টিটো ছিলেন জোট নিরপেক্ষা আন্দালনের প্রধান নেতা ৷ ১৯৬০ খ্রীঃ সেপ্টেম্বর মাসে জাতি পুঞ্জের সাধারণ পরিষদে অধিবেশনের ফলে নেহেরু, নাসের সুকর্ণ, মার্শাল টিটো প্রমুখ নেত্রীবৃন্দ জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির একটি সম্মেলনের ব্যাপারে আলাপ আলোচনা শুরু করে ৷ এর ফল স্বরুপ ১৯৬১ খ্রীঃ ৫ই থেকে ১২ ই জন মিশরের রাজধানী কায়রোতে এই "Preparatory Conference" একটি অনুষ্ঠিত হয় ৷ এখানে ২২ টি দেশের বিদেশ মন্ত্রীরা এক বৈঠকে মিলিত হন । এই বৈঠকে এশিয়া,ইউরোপ এবং ল্যাটিন আমেরিকার ২১টি দেশ যোগদান করেন ৷ বেলগ্রেডের প্রস্তুতি সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুসারে জোট নিরপেক্ষ দেশগুলির প্রথম শীর্ষ সম্মেলনে বসে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে যুগশ্লোবিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে এই সম্মেলন চলে ১ সেপ্টেম্বর থেকে ছয় সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সোভিয়েত মার্কিন স্নায়ুযুদ্ধের উত্তপ্ত রাজনৈতিক বাতাবরণের মধ্যেই আয়োজিত হয় এই সম্মেলন ৷
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রধান প্রবর্তক হয়ে ভারত কিছু আন্তজাতিক রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি । সকাল আন্তজাতিক প্রশ্নে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে । যেমন - [1]. ১৯৫০ খ্রীঃ উত্তর ও দক্ষিন কোরিয়ার সুদ্ধ সম্পর্ক জটিল সমস্যার সমাধামে শাক্তধর রাষ্ট্রগুলির চ্যালেঞ্জের মুখে দাড়িয়ে ভারত অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । [2]. ইন্দো-চিনে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিকল্প জাতিয়তাবাদী সংগ্রাম ও পরে ভিয়েতনাম সমস্যা সমাধানেও ভারতের ভূমিকা ছিল এই উল্লেখযোগ্য। [3]. ১৯৫৬ খ্রীঃ সুয়েজ সংকট এবং মিশরের উপর ইঙ্গ-ফরাসি ও ইজরায়েলের আক্রমনের বিরুদ্ধে ভারত তীব্র প্রতিবাদ জানায় । চিনের সঙ্গে প্রবল বিবাদ থাকা সত্ত্বেও ভারত জাতিপুঞ্জের চিনের সদস্য হওয়ার জন্য সমর্থন জাপন করে । [4]. পাকিস্তানের সঙ্গেও সুসম্পর্ক রাখার ব্যাপারে ভারত চির দিনই আগ্রহী । কেবলমাত্র তাই নয় পৃথিবীর সবত্রই বর্ণ বৈষম্যবাদ, সাম্রাজ্য বাদ ও ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে ভারত প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে । কোমা জটিল অনুভুক্ত না হওয়ায় ভারতের পক্ষে নিরপেক্ষ ভাবে উভয় গোষ্ঠীর অন্যায়ের প্রতিবাদ করা সহজতর হয়েছে । সুতরাং এই জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে ভারত তথা জহর লাল নেহেরুর গুরুত্বকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই ।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নগুলি
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের উদ্দেশ্য
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল দুটি মহাশক্তির জোট (পূর্ব এবং পশ্চিম জোট) এর মধ্যে কোনো পক্ষ না নিয়ে স্বাধীনভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রক্ষা করা। এটি শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য গঠিত হয়েছিল।
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ছিল এটি কোনো একটি শক্তির জোটের সঙ্গে জোট বাঁধেনি, বরং স্বাধীন ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে পদ্ধতিগতভাবে কাজ করেছিল।
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রধান প্রবক্তা কে
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রধান প্রবক্তা ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু, এছাড়াও যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল টিটো এবং মিশরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
জোট নিরপেক্ষ নীতি বলতে কী বোঝো
জোট নিরপেক্ষ নীতি বলতে, কোনো একটি দেশের পক্ষ না নিয়ে স্বাধীনভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বজায় রাখার নীতি বোঝানো হয় । এটি যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে সমর্থন করে।
ভারতের জোট নিরপেক্ষ নীতি pdf
আপনি ভারতের জোট নিরপেক্ষ নীতি সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য এবং ডাউনলোডের জন্য PDF ফাইলটি এখানে পাবেন। [আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন ]
জোট নিরপেক্ষ নীতি কি ছিল জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের উদ্দেশ্য
জোট নিরপেক্ষ নীতি ছিল, একটি নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করে শক্তির জোট গুলো থেকে নিজেকে আলাদা রাখা, যাতে বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের ভূমিকা
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বিশ্বে একটি বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, যেখানে অনেক উন্নয়নশীল দেশ তাদের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে।
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন ১৯৫৫ সালে শুরু হয়েছিল এবং এর লক্ষ্য ছিল বিশ্বের স্বাধীন ও শান্তিপূর্ণ দেশগুলির একটি জোট তৈরি করা যা কোনো এক পক্ষের প্রতি পক্ষপাতিত্ব না দেখিয়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করবে।
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন pdf
আপনি জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের বিস্তারিত বিষয়ে PDF ফাইলটি এখানে পাবেন। [আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন ]
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে ভারতের ভূমিকা
ভারত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যেখানে নেহেরু তার নেতৃত্বে বিশ্বের শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্রগুলির সাথে সম্পর্ক বজায় রেখেছেন।
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বলতে কী বোঝো
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন হল একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলন যেখানে দেশগুলো কোনো একটি বড় শক্তির জোটের সঙ্গে যোগ না হয়ে নিজেদের স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে।
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের মূল্যায়ন করো
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বিশ্বরাজনীতিতে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, তবে কিছু দেশ বা শক্তির চাপের কারণে আন্দোলন কিছুটা দুর্বল হয়েছে। তবে এটি বিশ্বের বৃহৎ সংখ্যক দেশকে স্বাধীনতার পথে শক্তিশালী করেছে।