নেপোলিয়নের পতনের কারণ সম্পর্কে আলোচনা কর অথবা, নেপোলিয়নের পতনের পেছনে কি কি কারণ দায়ী ছিল বা,নেপোলিয়নের পতনকে তুমি কীভাবে ব্যাখ্যা করবে?
![]() |
নেপোলিয়ান একজন সাধারণ সৈনিক রূপে জীবন শুরু করেছিল ৷ নানা গুণের অধিকারী ছিলেন নেপোলিয়ন ৷ জীবন শেষ হয় তার ফ্রান্সের সম্রাট হিসেবে ৷ তিনি ১৭৯৯ থেকে ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ছিলেন ইউরোপের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ ৷ কালের নিয়মে আজ যার উত্থান একদিন তার পতন হবে ঠিকই ৷ তেমনি নিয়তির পরিহাসে একসময় নেপোলিয়নেরও পতন ঘটে । নেপোলিয়নের ক্ষেত্রে একতা প্রযোজ্য ৷ ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে টিলসিটের সন্ধি স্বাক্ষরের পর থেকেই নেপোলিয়নের পতন ঘনিয়া আসে ৷ ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সেনাপতি আর্থার ওয়েলেসের কাছে ওয়াটারলোর যুদ্ধে পরাজয় তার পতনের কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে ৷ তবে, ওয়াটারলু যুদ্ধই নেপোলিয়নের পতনের পেছনে একমাত্র কারণ ছিল না নেপোলিয়নের পতনের পেছনে একাধিক কারণ বিরাজমান ছিল ৷
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
নেপোলিয়ন অল্প বয়স থেকেই একের পর এক সাফল্য লাভের ফলে নিজেকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী গগনচুম্বি করে তুলেছিল । নেপোলিয়নের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল সীমাহীন, তিনি নিজেকে অপরাজেও বলেও মনে করতেন এবং তার সামরিক বাহিনীর কার্যকারিতা সম্পর্কেও উচ্চকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেন । প্রবল আত্মপত্যায় এবং তার উচ্চাকাঙ্ক্ষার ফলস্বরূপ তিনি ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল কে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে উদ্যোগী হয়েছিলেন ৷ তার ফলে তিনি ইউরোপের বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে অন্ধ হয়ে একই সঙ্গে বিভিন্ন শক্তির বিরুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন এবং নেপোলিয়নের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রমাণ পাওয়া যায় মস্কো অভিযানের মধ্যে দিয়ে ৷ নেপোলিয়নের এই সীমাহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষা, তার পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল ৷
ইউরোপের জনগণকে স্বৈরাচারী শাসনের কবল থেকে মুক্ত করার আশ্রয় দিয়ে নেপোলিয়ান নিজেই বিজিত রাজ্য সমূহে স্বৈরাচারী শাসন প্রবর্তন করেছিলেন ৷ তিনি ফ্রান্সকে একটি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করেন ৷ ফলে জনগণ নেপোলিয়নের ব্যবহারে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন ৷ আবার ফরাসি জনগনের বাগ স্বাধীনতা হরণ , সাম্রাজ্যের সর্বত্র গুপ্তচর নিয়োগ,জনগণকে বিনা বিচারে আটক প্রভৃতি কাজের মাধ্যমে নেপোলিয়ন জনগণের ক্ষোভের বৃদ্ধি করেছিল ৷ ফলে সর্বোচ্চ নেপোলিয়ান বিরোধী মনোভাব দানা বেধেছিল ৷
নেপোলিয়ন ইংল্যান্ডের ভাতে না মারতে পেরে পাতে মারার জন্য অর্থনৈতিক দিক থেকে ইংল্যান্ডকে পঙ্গু করার নীতি নিয়েছিল ৷ এই উদ্দেশ্যে তিনি মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা ঘোষণা করেন ৷ এই অবরোধ ব্যবস্থা কার্যকরী হবার সাথে সাথে ইংল্যান্ড তথা ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে আর্থিক ক্ষেত্রে বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল ৷ ফলে এইসব দেশগুলির নেপোলিয়নের বিরোধী হয়ে ওঠে ৷ নেপোলিয়ান ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা জারি করলে শক্তিশালী নৌবাহিনীর অভাবে তা কার্যকরী করতে পারেননি ৷ বল প্রয়োগ করে অবরোধ কার্যকর করতে গিয়ে তিনি একসঙ্গে বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন ৷ এই সকল যুদ্ধ নেপোলিয়নের পক্ষে অশুভবার্তা বয়ে এনেছিল ৷ অন্যদিকে নেপোলিয়নের অবরোধের পাল্টা অস্ত্র হিসাবে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড অর্ডারস-ইন- কাউন্সিল নামে অবরোধ জারি করলে ফ্রান্সের যথেষ্ট ক্ষতি হয় ৷
ইতালির অভিযানের সময় নেপোলিয়ন পোপের রাজ্য অন্যায়ভাবে অধিকার করে নেন এবং তাকে বন্দী করে ফ্রান্সে নিয়ে আসেন । তাছাড়া নেপোলিয়ন মহাদেশীয় অবরোধ কার্যকর করতে গিয়ে রোমের শাসকদের বন্দী করে তার রাজ্য দখল করলে ইউরোপের ক্যাথলিক জনগণ নেপোলিয়নের প্রতি ক্রুদ্ধ হন ৷ ক্যাথলিক জনগণ ক্ষোপে ফেটে পড়ে এই ঘটনার সামান্য হলেও নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যের ভিত কে দুর্বল করেছিল ৷
নেপোলিয়ান অন্যায়ভাবে স্পেন অধিকার করে নিয়ে নিজের ভাই জোসেফকে সিংহাসনে বসিয়ে দেন ৷ কিন্তু স্পেন বাসিত তা মেনে নিতে পারেননি । ফলে স্পেনের জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেমিক সাধারণ মানুষ নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে তীব্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে । তারা পর্তুগালের সাথে একত্রিত হয়ে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে ৷ ছয় বছর ধরে এই যুদ্ধ চলে ৷ এই যুদ্ধে নেপোলিয়নের বিপুল অর্থ ব্যয় হয় ও মর্যাদা ক্ষুন্ন হয় ৷ তাই নেপোলিয়ান দুঃখ করে বলেছেন স্পেনীয় ক্ষত আমার সর্বনাশ করেছে ৷ এই যুদ্ধে নেপোলিয়নের ব্যাপক বিপর্যয় ঘটে ৷
নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় শক্তি বর্গের রাষ্ট্র জোট ফ্রান্সের সামরিক শক্তিকে নানাভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে ৷ ইউরোপের প্রায় সকল বৃহৎ শক্তি অস্ত্র ধারণ করে নেপোলিয়নের সামরিক পরিকল্পনা একপ্রকার বানচাল করে দিয়েছিল ৷ রাশিয়া মহাদেশীয় অবরোধ প্রথা মানতে অস্বীকার করলে নেপোলিয়ন রাশিয়া আক্রমণ করেন ৷ সেখানেই তার মহান সেনাদলের বেশিরভাগ সৈন্য তীব্র শীত,খাদ্য ও পানীয় জলের অভাবে মহামারী ও রুশ গোরিলা সৈনিকের আক্রমণে মারা যান । ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ওয়াটার লুর যুদ্ধে তিনি চূড়ান্তভাবে পরাজিত হন এবং সেন্ট হেলনা দ্বীপে নির্বাচিত হন ৷
সুতরাং বলা যায় যে নেপোলিয়নের পতনের জন্য উক্ত কারণ গুলি ছাড়াও একাধিক কারণ দায়ী ছিল যেমন সাম্রাজ্যের বিশালতা,ইংল্যান্ডের শক্তি,শক্তি সমবায় বা শক্তি জোট গঠন প্রভৃতি কম বেশি দায়ী ছিল ৷ ১৭৯২ সালে নেপোলিয়নের ফ্রান্সের রাজনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষবিন্দুতে আহরণ করেছিল ৷ কিন্তু ফরাসি সমাজকে তিনি স্থায়িত্ব দিতে ব্যর্থ হন এবং মাত্র ১৫ বছর বয়সের মধ্যেই ফরাসি সাম্রাজ্যের ভাঙ্গন সম্পূর্ণ হয় । নেপোলিয়নের ভুল এ গিয়েছিলেন মানুষ কখনও ঈশ্বর হতে পারেনা ৷ ওয়াটারলুর যুদ্ধে পরাজয়ের পর নেপোলিয়ানকে সিংহাসন যুক্ত করে ফ্রান্স থেকে ৫০০০ মাইল দূরে আটলান্টিক মহাসাগরের গভীরে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসনে পাঠানো হয় ৫২ বছর বয়সে এই বীরপুরুষের মৃত্যু হয় ৷ শেষ হয় ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ৷