গুপ্ত যুগের ভাস্কর্য শিল্প বিষয়ে তুমি কি জানো তা আলোচনা কর
প্রাচীন ভারতীয় শিল্প প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল গুপ্তযুগের ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে। এই যুগের ভাস্কর্যে শিল্প ভাবনার সঙ্গে চিন্তা ও মননের এক অভূতপূর্ব মিলন ঘটেছিল। একথা অবশ্য স্বীকার্য যে, গুপ্তযুগের ভাস্কর্যের অভাবনীয় বিকাশ রাতারাতি সম্ভব হয়নি। কয়েক শতাব্দীর শিল্প ভাবনার বিবর্তনের পরিণতি ঘটেছিল গুপ্তযুগে। এই বিবর্তনের ধারায় গান্ধার শিল্পশৈলীতে গ্রিক ও রোমান ভাবধারারও পরিবর্তন ঘটে এবং এই শিল্প ভারতীয়ত্ব অর্জন করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য মথুরা, অমরাবতী শিল্পে ইতিপূর্বেই প্রাণী ও উদ্ভিদজগতকে ছাড়িয়ে মনুষ্যমূর্তি নির্মাণের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছিল। এককথায় অমরাবতীর শিল্পশৈলীকে অতিক্রম করে গুপ্তযুগের ভাস্কর্য এক অতীন্দ্রিয় স্তরে পৌঁছায়।
গুপ্তযুগে ভাস্কর্য শিল্পের অন্যতম প্রধান দিক হল মনুষ্যমূর্তি। গুপ্তযুগের শিল্পীরা মনুষ্যমূর্তির বাইরের আকৃতির সঙ্গে অন্তরের ভাবধারার এক অপূর্ব মিলন ঘটাবার চেষ্টা করেছিল। এই যুগের ভাস্কর্যের দুটি প্রধান কেন্দ্র হল মথুরা ও সারনাথ। এছাড়া পূর্ব ভারতে পাটলিপুত্রকে কেন্দ্র করে শিল্পসাধনার প্রচলন ঘটেছিল। এই তিনটি প্রধান কেন্দ্র ছাড়াও মধ্যপ্রদেশের উদয়গিরি, ভিলসা, এবান ও মান্দাসোরে কিছু শিল্পকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, গুপ্তশিল্পকলার প্রধান কেন্দ্র সারনাথ হলেও এর প্রভাব বিস্তৃত ছিল পূর্বে আসাম থেকে পশ্চিমে গুজরাট পর্যন্ত এবং দক্ষিণে দাক্ষিণাত্য থেকে উত্তরে কাশ্মীর পর্যন্ত। প্রথমে গুপ্তযুগের ভাস্কর্যের ভাণ্ডার হিসেবে মথুরা ও সারনাথ
প্রসঙ্গে আলোচনা করা বাঞ্ছনীয় হবে।
মথুরায় লাল বেলেপাথরে এবং অনেক সময় ঈষৎ হলুদ বর্ণ চুনাপাথরে বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের মূর্তি নির্মিত হয়েছিল। মথুরা ভাস্কর্য শিল্প সম্পর্কে নীহাররঞ্জন রায়ের বক্তব্য হল-মথুরার ভারী, দৃঢ়, স্কুল, সূক্ষ্মাণুভূতিবিহীন বুদ্ধ বোধিসত্ত্ব গুপ্ত আমলে সূক্ষ্ম, মার্জিত ধ্যানকেন্দ্রিক, যোগগর্ভ বৃদ্ধ বোধিসত্ত্ব মূর্তিতে রূপান্তর লাভ করে। এই রূপান্তরের মধ্যে সমগ্র ভারতীয় বৃদ্ধি ও কল্পনার মনন ও সাধনার সুগভীর ইতিহাস বিধৃত।
বৃদ্ধগয়ার বোধিসত্ত্ব মূর্তিটি ছাড়াও মথুরায় বেশ কিছু বুদ্ধমূর্তি পাওয়া গেছে। জামালপুরে প্রাপ্ত খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের দন্ডায়মান বুদ্ধমূর্তি, কাটরায় প্রাপ্ত খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের বুদ্ধমূর্তি, কুশীনগরে প্রাপ্ত পঞ্চম শতকের শায়িত বুদ্ধমূর্তি। এলাহাবাদের কাছে মানকুয়ারে মস্তকমুণ্ডিত বুদ্ধমূর্তি উল্লেখযোগ্য। শিল্প সমালোচকদের মতে, মথুরার এই মূর্তিগুলিতে কুষাণযুগের স্থূলতা ও বিশালতা অনেকটা নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল।
মথুরার শিল্পে কিছুটা বৈদেশিক প্রভাব থাকলেও, সারনাথের বুদ্ধমূর্তিগুলিতে কিন্তু বৈদেশিক প্রভাব একেবারেই ছিল না। পুরোপুরি ভারতীয় শৈলীতে নির্মিত সারনাথের বুদ্ধমূর্তিগুলি নির্মিত হয়েছে চুনারের বেলেপাথরে। সর্বপ্রথম সারনাথে বুদ্ধদেবের ধর্মপ্রচারের বিষয়টি একটি উপবিষ্ট বুদ্ধমূর্তির দ্বারা স্মরণীয় করে রাখা হয়েছে। বস্তুতপক্ষে সারনাথে পাওয়া বুদ্ধমূর্তিগুলি হল গুপ্তযুগের ভাস্কর্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এগুলির মধ্যে প্রশান্তি ও সন্তোষের এক অপূর্ব ছবি ফুটে উঠেছে। এছাড়া সারনাথের মূর্তিতে শিল্পী তাঁর অপরিমেয় রুচিবোধের পরিচয় দিয়েছেন। পার্থিব আকাঙ্ক্ষা থেকে অনেক দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে এই মূর্তিগুলিকে। ভারতীয় শিল্পের এক স্বতন্ত্র সৃষ্টি হিসেবে সারনাথের মূর্তিগুলিকে বিবেচনা করা যেতে পারে। মথুরা সারনাথ ছাড়াও পাটলিপুত্রে প্রধানত বৌদ্ধধর্মকে কেন্দ্র করে শিল্পরীতি গড়ে
উঠেছিল। অর্থাৎ, মথুরা সারনাথের ন্যায় পাটলিপুত্রও ছিল বৌদ্ধ শিল্পকেন্দ্র। পাটলিপুত্রের শিল্পরীতির স্পষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয় বিহারের সুলতানগঞ্জের বুদ্ধমূর্তিতে। এছাড়াও নালন্দায় প্রাপ্ত বিশালাকার বুদ্ধমূর্তি এবং রাজগিরে মনিয়ার মঠের মূর্তিগুলি এই শিল্পের পর্যায়ে পড়ে। পাটলিপুত্র শিল্পরীতির ওপর মধুয়া ও সারনাথ শিল্পের প্রভাবকে একেবারে অস্বীকার করা যাবে না।
মথুরা, সারনাথ ও পাটলিপুত্র ছিল মূলত বৌদশিল্পকেন্দ্র। এগুলি ছাড়াও উদয়গিরি, ভিলসা, এরান, দেওগড় ভিতরগাঁও প্রভৃতি অঞ্চলে কিছু শিল্পকেন্দ্র গুপ্তযুগে গড়ে উঠেছিল। তবে এই কেন্দ্রগুলি ছিল প্রধানত ব্রাহ্মণ্যধর্মকেন্দ্রিক শিল্প। পূর্ব মালবে, খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের উদয়গিরিতে বিস্তুর বরাহ অবতারের মূর্তি পাওয়া গেছে। দেওগড়ের অনন্ত শয্যায় শায়িত বিছুমূর্তি ও শিবের যোগীমূর্তি, ভূমার মন্দিরের সূর্যমূর্তি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, দীর্ঘকাল ধরে ভারতবর্ষে শিল্পের ক্ষেত্রে যে বিবর্তন ঘটে চলেছিল তার পরিণতি ঘটেছিল গুপ্তযুগে। বিশেষ করে মথুরা ও সারনাথ শিল্পে। গুপ্তযুগের ভাস্কর্য ভারতের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্য। এই ভাস্কর্যে মনুষ্যমূর্তির প্রাধান্য বিশেষ করে মূর্তির মুখে এক স্বর্গীয় ভাব ফুটিয়ে তোলা এই শিল্পরীতির এক অপূর্ব অবদান। তবে কেবল হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তিই নয়। বুদ্ধদেবের মূর্তি নির্মাণের ক্ষেত্রে গুপ্তভাস্কর্য সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেছিল। সারনাথের অর্ধনিমিলিত চক্ষু-বুদ্ধমূর্তি তার এক অসাধারণ উদাহরণ। তবে গান্ধার শিল্প বা তার অনুকরণে নয়, এই ভাস্কর্য সম্পূর্ণ ভাবতীয় শিল্পরীতিতেই বিকশিত হয়েছিল-এখানেই গুপ্তভাস্কর্যের বৈশিষ্ট্য