চীনে প্রজাতন্ত্রিক বিপ্লবের প্রেক্ষাপট আদর্শগত পটভূমি এবং সান-ইয়াৎ সেনের ভূমিকা আলোচনা অথবা,১৯১১ খ্রিস্টাব্দে চীন বিদ্রোহের কারণ, ব্যর্থতা, ফলাফল আলোচনা কর। এই বিদ্রোহ কি অসমাপ্ত ছিল?
১৯১১ খ্রীঃ চীনের প্রজাতন্ত্রিক বিপ্লবের কারণ/পটভুমি সান ইয়াৎ সেনের ভূমিকা প্রগাতান্ত্রিক চীনে তাঁর তিনটি নীতি কতখানি রূপায়িত হয়েছিল? বিপ্লবের ব্যর্থতাঃ
আধুনিক চীনের ইতিহাসে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ প্রজাতন্ত্রিক বিপ্লব গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা ৷ এই বিপ্লব সম্পর্কে একদল ঐতিহাসিক মনে করেন যে এই বিপ্লবকে মূলত একটি ডাইনাসটিক রেভেলিউশন তত্ত্ব আখ্যা দেয়া যেতে পারে , কেননা এই বিপ্লব সামাজিক কাঠামোর দিক দিয়ে কোন বড় রকম পরিবর্তন সাধন করেননি ৷ তারপর এক দল গবেষক ১৯১১ এর বিপ্লবকে যে মূল্যায়ন করেছেন সেই মূল্যায়ন অনুযায়ী কয়েকটি পর্যায়ে বৈপ্লবিক কার্যকলাপ ফলস্রুতি হিসাবে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পূর্ণ হয়েছিল । বাস্তবিক পক্ষে হাজার ১৯১১ সালের বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দিক দিয়ে নাটকীয় পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল কিন্তু কোন সম্প্রদায় বা শ্রেণি কর্তৃক ক্ষমতা অধিগ্রহণের ঘটনা পরিলক্ষিত হয় না ৷ উর্বর মাঞ্চু রাজবংশের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির অবক্ষয় অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল । এস এন রয়ের মতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট মাঞ্চু রাজতন্ত্রের পতন ও প্রজাতন্ত্রিক বিপ্লবের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল ৷
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
বিভিন্ন কারণের সমাবেশের ফলে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল ৷ এর মধ্যে রাজনৈতিক কারণ হিসেবে মাঞ্জু রাজবংশের দুর্বলতা বিষয়টি উল্লেখ্য করা যেতে পারে ৷ ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় অর্থে থেকে বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে দিয়ে মাঞ্চুরাজ বংশের দুর্বলতা প্রকট হয়ে ওঠে ৷ অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় সংকটের মোকাবিলা মাঞ্জু রাজবংশের পক্ষে সম্ভব হয়নি ৷ ১৮৩৯ থেকে ৪০ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত আফিমের যুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে চীনের ওপর যে অসম চুক্তির বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে ৷ ১৮৫০ এর দশকে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে আফিম বিদ্রোহ এবং বাহ্যিক দিক থেকে ফ্রান্সের সাথে সংঘাত পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছিল ৷
১৮৯৫ দশকে চীন জাপান যুদ্ধে চীনের পরাজয় মাঞ্জু রাজবংশের দুর্বলতা কে প্রবল করে তুলেছিল । ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে জাপান কোরিয়া অধিকার করলে সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণ হয় যে মাঞ্জু রাজবংশ সামরিক দিক থেকে বিদেশীদের আক্রমণ মোকাবিলার মত অবস্থায় ছিল না । এই জাতীয় পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য ষাটের দশকে তুংচি পুণস্থাপনের প্রয়াস নেওয়া হয় । ঐতিহাসিক মেরি-সি- রাইট এই প্রসঙ্গে তাকে ,"লাস্ট স্টার্ট অফ চাইনিজ কনভারসেশন " বলে আখ্যা দিয়েছেন ৷ এই প্রচেষ্টা সামরিকভাবে সফল হলেও জাপানের নিকট পরাজয় পুনরায় যে সংকটের সৃষ্টি করেছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে শত দিবসের সংস্কার অনুষ্ঠিত হয় । কিন্তু এই সংস্কার বিভিন্ন সমস্যার প্রান্ত গুলিকে ছুঁয়ে গিয়েছিল কিন্তু গভীরে প্রবেশ করতে পারেননি ৷
১৯০১ সাল থেকে মাঞ্জু রাজবংশের বাঁচানোর জন্য সর্বশেষ সংস্কারের প্রচেষ্টা শুরু হয় ৷ চীনের ইতিহাসে যার "late china reformation" নামে পরিচিত ৷ এই সংস্কার প্রচেষ্টা অনুযায়ী শত দিবসের সংস্কারের তুলনায় চীনের সমস্যা সমূহের অনেক গভীরে প্রবেশ করেছিল ৷ কিন্তু আশ্চর্যজনক ঘটনা হলো এই যে সংস্কারের মাধ্যমে রাজবংশ যতই নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল ততই রাজনীতির জোরে বালিতে তলিয়ে যায় ।
এই সংস্কার কে শিল্প সংক্রান্ত সংস্কার প্রচেষ্টা গুরুত্ব দেয়া হয় ৷ নতুন ধরনের পাঠ্যসূচী, নতুন ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি ইত্যাদির প্রচলন করা হয়েছিল ৷ নতুন এই পরিকল্পনা নতুন ধরনের রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি করেছিল ৷ বিশেষ করে ছাত্র সম্প্রদায় যারা মাঞ্জু রাজবংশের বিরোধিতা একটি মানসিক কথা গড়ে তুলেছিল ৷ তাছাড়া এদের মধ্য থেকে যারা সামরিক বাহিনীতে যোগদান করে তাদের অনুসৃত সংশয়ের উর্ধ্বে ছিল না এই সংস্কারের প্রচেষ্টা দখল প্রাদেশিক স্তরে কেন্দ্র প্রদেশের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়ে পুনর্বিন্যস্ত হয় ।
সাংবিধানিক সংস্কারের দরুন প্রদেশ গুলি আরো বেশি সুযোগ সুবিধার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে ৷ প্রাদেশিক পরিষদগুলিকে রাজবংশ বিরোধী উদ্দেশ্য ব্যবস্থা করা হয় সরকারি স্তরে প্রাদেশিক অফিসাররা অর্থনৈতিক ব্যাপারে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করে ৷ ফলে পরবর্তী চীন সংস্কার প্রচেষ্টা কতগুলি নতুন শক্তির সৃষ্টি করে যেগুলি পুরনো ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করে ৷
উদারতান্ত্রিক আন্দোলনের ব্যর্থতা ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবের পথ প্রশস্ত করেছিল ৷ লিয়াং চীং চাই এর নেতৃত্বে এই আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল কাউ ইউয়ের সঙ্গে তার যোগসূত্র ছিল এবং পাশ্চাত্য ধ্যান ধারণা ও আদর্শ মানসিক সহযোগিতা কে সঙ্গে গ্রহণ করেন ৷ তবে তারা এই প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ রক্ষণশীল ও বিপ্লবী উভয় দিক থেকেই সমালোচিত হয় ৷ ফিয়ার ব্যাংক তার "ইস্ট এশিয়া দ্য মডার্ন ট্রান্সফর্মেশন" গ্রন্থে বলেছেন যে," শত দিবসের সংস্কার সফল হলেও মাঞ্জু রাজতন্ত্র অর্থ সংকট কাটিয়ে উঠতে পারত কিন্তু তা ঘটেনি ৷"
তাছাড়া পশ্চিমী আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল প্রজাতন্ত্রিক বিপ্লব ৷ বিদেশের শিক্ষারত চীনা ছাত্ররা পাশ্চাত্য উদারনীতি গণতন্ত্র ও সামাজিক সত্যের ধারণা অর্জন করে এবং এরাই পরবর্তীকালে সান-ইয়াত-সেনের নেতৃত্বে গুপ্ত সমিতি গঠন করে চীনকে বিপ্লবমুখী করে ৷ ফ্যায়ার ব্যাংক এ প্রসঙ্গে জাপানের বিশেষ ভূমিকা উল্লেখ করেছেন ইউরোপ থেকে জাপানে গিয়ে তুং জেং, বেং হুই নামক গুপ্ত সমিতি গঠন করেন ১৯১১ বিপ্লবে জাপানের ভূমিকা অনস্বীকার্য ৷
১৯১১ প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের একটি আদর্শ গর্ত পটভূমি ছিল এর প্রধান উপাদান গুলি ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার এবং প্রশাসনিক সংস্কার ৷ ফেয়ার ব্যাংক দেখিয়েছেন যে চীনের ছাত্ররা পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদ গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র প্রভৃতির রাজনৈতিকতার মতাদর্শের সংস্পর্শে এসে এই চীনের প্রাচীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ও রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে কার্যকরী ভূমিকা নিতে থাকে ৷ ফরাসি বিপ্লব ইতালির ঐক্য আন্দোলন রাশিয়ার সমাজবাদী আন্দোলন প্রভৃতির বিবরণ চিনা ছাত্ররা অনুপ্রাণিত করে ৷ অ্যাডাম স্মিথ এর "ওয়েলথ অফ নেশন" , মন্তেস্কুর "স্পিরিট অফ লজ" প্রভৃতি গ্রন্থ চীনা যুব সমাজকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উদ্বৃত্ত করে ৷
M.B zensen তার "জাপান এন্ড সায়ন্তার" গ্রন্থে দেখেছেন যে জাপান চীনা প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের সংগঠনের সান-ইয়াত-সেন সহ বিপ্লবীদের নানাভাবে উদ্ভিত করেছিলেন ৷ ১০ই অক্টোবর ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে বিপ্লবী অভ্যুর্থানের মুহূর্তে তিনি জাপানে ছিলেন ৷ বিপ্লবীদের হাত শক্ত করার উদ্দেশ্যে সান-ইয়াত-সেন চীন সরকারকে বিদেশি ঋণ পাওয়ার পথ বন্ধ করেন এবং দেশে ফিরে আসেন ঐতিহাসিকরা এই প্রসঙ্গে সান-ইয়াত-সেন প্রাক বিপ্লব কর্মসূচির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন ৷ ১৮৯০ এর দশকে স্থানীয় শ্রেণীর নেতৃত্বে একটি গোষ্ঠী প্রতিশ্রুত হয় যার লক্ষ্য ছিল প্রজাতন্ত্রের ব্যবস্থার পরিবর্তন করা ৷ ১৮৯৫ এ একটি সশস্ত্র বিপ্লব সংঘটিত হয় এই সময় সংস্কারের দাবিতে জোরালো আন্দোলন শুরু হয় ৷ এই সময় সংস্কারপন্থীদের সাথে বিপ্লবীদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে ৷ সান-ইয়াত-সেন পশ্চিমী শিক্ষার প্রসার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যার উন্নত প্রবৃত্তি বিষয়ে জোর দেন এই প্রস্তাব সরকার গ্রহণ না করলেও তিনিও বিপ্লবের দিকে আকৃষ্ট হন । ইউরোপে থাকাকালীন ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি পূর্ণ পরিকল্পিত জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের সাথে সমাজতন্ত্র আদর্শ যুক্ত করেন ৷ এইভাবে রচিত হয় তার বিখ্যাত তিনটি নীতি বা সান- মিন-চুই এর ভিত্তি ৷
(১). জনগণের মধ্যে জাতীয় সচেতন বা জাতীয়তাবাদ
(২). গণতন্ত্র এবং
(৩). জনগণের জন্য জীবিকা, সমাজতন্ত্র ৷
এই নীতি বিশ্লেষণ করে সান-ইয়াত-সেন বলেন যে," জাতীয়তাবাদ চীন জাতিকে মাঞ্জু শাসনের উচ্ছেদের প্রেরণা যোগায় ৷ গণতন্ত্র চীন জাতিকে রাজনৈতিক প্রশাসনিক ও বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতার অধিকারী করণে এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে আর্থিক সাম্য ৷
বক্সার বিদ্রোহের সময় সান-ইয়াত-সেন ক্যান্টন বিদ্রোহ ও সংগঠনের চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফরওয়াজ আশ্রয় নিতে বাধ্য হন ৷ বিংশ শতকের গোড়ায় ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পরিভ্রমণ করে ,তিনি বিপ্লবী দল গঠনের তৎপর হন ৷ এই দলের সামনে তিনি তিনটি নীতি প্রচলন করেন ৷ মাঞ্চু শাসনের উচ্ছেদ জাতীয় শাসনের প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক বা অধিকার এবং সমতার ভিত্তিতে জমি বন্টন ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে জাপানি বিভিন্ন বিপ্লবী দলের সমন্বয়ে তিনি দল প্রতিষ্ঠা করেন ৷ তিনি তিনটি পর্যায়ে আন্দোলনের কর্মসূচি রূপায়ণের জন্য দেশবাসীকে আহবান করেন ৷
সময়কালে সারাদেশে একাধিক বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটে, ভূঁপে, পিকিং, ক্যান্টন, ওয়ান টু প্রভৃতি অঞ্চলে বিপ্লব সংঘটিত হয় ৷ মাঞ্জু সরকারের সেনাপতি এর সাথে হাত মিলিয়ে তিনি বিপ্লব সম্পূর্ণ করেন ৷ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলে প্রজাতন্ত্রের বিপ্লব সম্পূর্ণ হয় ৷
মার্কসবাদী ঐতিহাসিকরা ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবকে মূলত একটি বুর্জোয়া বিপ্লব বলে অভিহিত করেন ৷ এম এন রায় তার "রিভলিউশন এন্ড কাউন্টার ইনফরমেশন ইন চায়না" গ্রন্থে এই বিপ্লবকে চীনের প্রজাতান্ত্রিক ও বুর্জয়াদের মধ্যে তথা সমাজতন্ত্র এবং উপনিবেশিকদের মধ্যেকার এক সমঝোতা রূপে উল্লেখ করেছেন ৷ একদল ঐতিহাসিক মনে করেন ,"১৯১১ বিপ্লব বাস্তবে ডাইনেস্টিক revolution ছাড়া রাজতান্ত্রিক কিছু ছিল না কারণ প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লব স্থায়ী হয়নি ৷" কারণ এই বিপ্লবের পর আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন ঘটেনি ৷ যাই হোক 1911 এর বিপ্লব চীনে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের পরিবর্তে প্রজাতন্ত্রের স্বার্থ শাসন প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট যে প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল এ বিষয়ে সন্দেহ নেই ৷