১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধের গুরুত্ব আলোচনা করো।
১৯৪৯ খ্রিঃ অক্টোবরে গণপ্রজাতন্ত্রী চিন স্থাপিত হলে ডিসেম্বরে ভারত চিনকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তাহা সত্ত্বেও চিন ১৯৫০ খ্রিঃ তিব্বত আক্রমণ করে তাহা দখল করে নেয়। এক ঘটনায় ভারত ও চিনের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। কারণ, তিগ্রতের সাথে প্রাচীনকাল থেকেই ভারতের অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত ছিল। এই পরিস্থিতিতে ১৯৫৪ খ্রিঃ তিব্বত নিয়ে বিরোধের মীমাংসার উদ্দেশ্যে চিনের প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন লাই ভারতে আসেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সাথে। সাক্ষাৎ করেন। এ সময়েই উভয় দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় 'পঞ্চশীল নীতি'।
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
১৯৫৪ খ্রিঃ ২৯ এপ্রিল ভারত ও চিনের মধ্যে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তাহা পঞ্চশীল নীতি নামে পরিচিত। এই নীতিগুলি হল- ক) পরস্পরের রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। ঘ) পরস্পরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে। হস্তক্ষেপ না করা। গ) একে অপরকে আক্রমণ না করা। ঘ) সমমর্যাদার ভিত্তিতে পারস্পরিক সাহায্য প্রদান করা। ৫) শান্তিপূর্ণভাবে পাশাপাশি সহাবস্থান করা।
ইহার কয়েক বছর পর থেকে চীন ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক বিরোধের রূপ ধারণ করতে থাকে। ১৯৫৮-৫৯ সাল থেকে ভারত সরকারের কর্মপদ্ধতি কমিউনিষ্ট চীন সমালোচনা করতে থাকে। ১৯৫৯ সালে তিব্বতে দলাই লামার বিদ্রোহ এবং তাঁকে ভারতে আশ্রয় দানের ঘটনা স্বাভাবিকভাবে চীন-ভারত সম্পর্ক জটিল করে তোলে। এই সময় চীনা সরকার ভারতের উত্তর-পূর্ব এবং উত্তর- পশ্চিম সীমান্তে প্রায় ৫০,০০০ বর্গ মাইল চিনের রাজ্যাংশ বলে দাবী করে।
১৯৫৯ থেকে ১৯৬২ সালের মধ্যে সীমান্ত অঞ্চল সম্পর্কিত বহু পত্র চীন ও ভারত সরকারের মধ্যে বিনিময় হয় এবং পরিস্থিতির জটিলতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৬২ সালে ২০ অক্টোবর এই বিরোধ এক ব্যাপক সংঘর্ষের আকার ধারণ করে। ২১ নভেম্বর চীনা সরকার একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে উভয় পক্ষকে বিরোধের অঞ্চল ত্যাগ করে যাবার জন্য দাবি জানায়। ভারত সরকার এই ব্যাপারে যাই করুন না কেন চীনা সরকার ১লা ডিসেম্বর তারিখ থেকে পূর্বোক্ত স্থান থেকে সেনাবাহিনী সরিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে।
এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন ভারত সরকার চীনাদের কার্যকলাপের প্রতি লক্ষ্য রাখাই স্থির করেন। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণের সীমারেখা নিয়ে ভারত ও চীন সরকারের মধ্যে তীব্র বাদানুবাদ শুরু হয়। উভয় পক্ষের সেনাবাহিনী পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় এবং এক তরফা যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করায় চীন-ভারত সংঘর বিচ্ছিন্ন ভাবে বড় হয়ে যায়। কিন্তু সীমানা নিয়ে মূল সমস্যা ভারত ও চীনের মধ্যে আজও সমাধান হয় নি।
ভারত-চীন সীমানা-সংক্রান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে নব পর্যায়ে সোভিয়েত চীন বিরোধ দেখা দেয়। চীন-ভারত বিরোধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাও এক অদ্ভুত চাপ ধারণ কে। এই বিরোধে এশিয়া এবং আফ্রিকার নিরপেক্ষ দেশগুলির ভূমিকা নিঃসন্দেহে বিশেষ প্রশংসনীয়।
ভারতের ন্যায় নিরপেক্ষ এবং অ-জোটবদ্ধ রাষ্ট্রের উপর চীনের আক্রমণ বিশ্বরাজনীতিতে যথেষ্ট প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রেও এই সংঘর্ষের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। কবে এবং কীভাবে এই বিরোধের নিষ্পত্তি হবে তা আজও অনিশ্চিত। বর্তমানে এই দুই বৃহৎ রাষ্ট্রের বিরোধ আদর্শগত বিরোধে রূপান্তরিত হয়েছে এবং ঠান্ডা লড়াইয়ের এক ক্ষুদ্র সংস্করণ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে।