খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মগধ সাম্রাজ্যবাদের উত্থানের পিছনে কী কী কারণ ছিল।
খ্রিঃ পুঃ ষষ্ঠ শতকে মগধ রাজ্য ছিল বিহারের পাটনা ও গয়া জেলা নিয়ে গঠিত। খ্রিঃ পূঃ ষষ্ঠ শতকে ১৬টি মহাজনপদের মধ্যে শেষ পর্যন্ত প্রধান হয়ে উঠে ৪টি, যথা-কোশল, অবন্তি, বৎস ও মগধ। এই ৪টির মধ্যে শেষ পর্যন্ত মগধ অপর সকল প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাস্ত করে এক সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য স্থাপন করে। ড. হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীর মতে, প্রাশিয়ার নেতৃত্বে জার্মানি বা ইংলন্ডের ওয়েসেক্সের (Wesex) নেতৃত্বে যেমন ইংলন্ডের সাত রাজ্য ঐক্যবদ্ধ হয় সেরূপভাবে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যগুলি মগধের অধীনে যুক্ত হয়। মগধের এই সাফল্যের কারণ ঐতিহাসিকেরা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন।
মগধের সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য মগধের রাজবংশগুলির ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যদিও মগধে খ্রিঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে একাধিক রাজবংশ রাজত্ব করে, কিন্তু প্রতি রাজবংশ একাগ্রভাবে একই সম্প্রসারণ নীতি অনুসরণ করার ফলে মগধের রাজ্যবিস্তার অবিচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকে। হর্যঙ্ক বংশের বিম্বিসার ও অজাতশত্রু, শৈশুনাগ বংশের শিশুনাগ ও কালাশোক; নন্দবংশের মহাপদ্ম প্রভৃতি সকল রাজাই মগধের বিস্তার নীতিকে অব্যাহত রাখেন। রাজবংশ পরিবর্তনের ফলে মগধের বৈদেশিক নীতির কোন পরিবর্তন ঘটেনি। জার্মানির ব্রান্ডেনবার্গ রাজ্যের হোহেনজোলার্ণ রাজবংশের রাজারা যেমন একাগ্রভাবে ব্রান্ডেনবার্গের উন্নতির জন্য আত্মনিয়োগ করেন; সেরূপ মগধের রাজারা মগধের রাজ্যবিস্তারের জন্য আত্মনিয়োগ করেন।
তাছাড়া মগধে পর পর অসাধারণ যোগ্যতাসম্পন্ন নৃপতি সিংহাসনে বসার দরুন উন্নতি অব্যাহত থাকে। বংশানুক্রমিক রাজবংশের প্রধান ত্রুটি হল এই যে, একটি বংশের সকল রাজার যোগ্যতা সমান হয় না। অযোগ্য শাসকের হাতে পড়ে পিতৃ-পুরুষের কষ্টার্জিত রাজ্য ও সম্পদ ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু মগধের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, যখনই কোন রাজবংশের শাসন দুর্বল হয়ে পড়েছে, তখন তাকে উচ্ছেদ করে নতুন রাজবংশ যোগ্যতার সঙ্গে শাসন চালাতে পেরেছে। অথচ তারা আগের সাম্রাজ্য বিস্তার নীতিকে অব্যাহত রেখেছে। এই বিষয়টি মগধের উন্নতির মূলে বিশেষ কাজ করে। বিম্বিসার, অজাতশত্রু, শিশুনাগ, মহাপর প্রভৃতি অসাধারণ যোগ্যতাসম্পন্ন রাজারা মগধের নিরবচ্ছিন্ন অগ্রগতির মূলে ছিলেন এতে সন্দেহ নেই। তাছাড়া মন্ত্রী ও কূটনীতিজ্ঞের দিক থেকেও মগধ শ্রেষ্ঠ লোকদের সাহায্য পেয়েছিল। অজাতশত্রুর বিখ্যাত মন্ত্রী বাস্সাকর, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মন্ত্রী কৌটিল্য, অশোকের মন্ত্রী রাধাগুপ্ত ছিলেন সে যুগের ভারত বিখ্যাত কূটনীতিজ্ঞ।
মগধের ভৌগোলিক অবস্থান মগধের শক্তি বাড়াতে সাহায্য করেছিল। মগধের মাঝখান দিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম ভারতের মধ্যে যাতায়াতের রাস্তা ছিল। মগধ রাজ্যটি ছিল সুরক্ষিত। গঙ্গা, শোন ও গণ্ডক নদী মগধকে তিন দিক থেকে ঘিরেছিল। এর ফলে কোন শত্রুদেশের পক্ষে সহসা মগধকে আক্রমণ করা সম্ভব ছিল না। মগধের রাজধানী রাজগৃহ ছিল সুরক্ষিত স্থান। এর চারদিকে ছিল পাঁচটি পাহাড় এবং পাথরের উঁচু প্রাচীর। মগধের পরবর্তী রাজধানী পাটলিপুত্রও ছিল সুরক্ষিত। গঙ্গা ও শোন নদের সঙ্গমস্থলে পাটল গ্রামে এই নগর স্থাপিত ছিল। শত্রুর পক্ষে এ নগর ছিল দুর্ভেদ্য। তাছাড়া পাটলিপুত্র থেকে গঙ্গার ওপর মগধের নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করা আরও সহজ হয়। মগধ রাজ্যের এই ভৌগোলিক সুযোগ-সুবিধার জন্য মগধ সহজে প্রতিবেশিদের আক্রমণ করত, কিন্তু মগধকে প্রতিবেশি রাজ্য আক্রমণ করতে পারেনি। মগধের জনশক্তি ছিল বিশাল। এই জনশক্তির দ্বারা মগধের রাজারা বিরাট পদাতিক বাহিনী গঠন করেন। মগধের অধীন ছিল বিরাট হস্তী বাহিনী। গ্রিক লেখকদের রচনা থেকে তা জানা যায়। তাছাড়া মগধ নতুন নতুন অস্ত্র নির্মাণ করে তার আক্রমণকে শাণিত করে। এই অস্ত্রগুলির মধ্যে মহাশিলা, কান্তার ও রথমুষলের নাম করা যায়।
মগধের সাম্রাজ্যবাদের সাফল্যের পশ্চাতে অর্থনৈতিক কারণ বিশেষভাবে সক্রিয় ছিল। মগধ ছিল এক জনবহুল রাজ্য। তার কৃষি, খনিগুলিকে চালাবার জন্য লোকবলের কোন অভাব ছিল না। শূদ্র ও অনার্য অধিবাসীদের দ্বারা মগধের বাড়াত লোকেরা এই জমি চাষবাস করে বেশ স্বচ্ছল জীবন-যাপন করত। তাছাড়া গঙ্গা ও শোনের জলধারায় প্লাবিত হওয়ার দরুন মগধের জমি ছিল উর্বরা। শস্যের ফলন ছিল অর্থনৈতিক কারণ বেশি। মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, মগধের জমিতে নানারকম ফসল ফলত। সাধারণত বছরে দুবার ফসল ফলত। এজন্য মগধের লোকেদের সমৃদ্ধি বাড়ে। মগধের শাসকরাও উঁচু হারে কর আদায় করে ধনশালী ও শক্তিশালী হয়ে উঠে। রোমিলা থাপার বলেছেন যে, "মগধেই কষি অর্থনীতির ওপর নির্ভর করে একটি সাম্রাজ্যের কাঠামো গঠনের সম্ভাবনা প্রথম জন্মলাভ করে।"' দ্বিজেন্দ্র রায়কে নারায়ণ ঝা দেখিয়েছেন, মগধের জমি উর্বর হওয়ায় এক সম্পন্ন কৃষক শ্রেণির সৃষ্টি হয়ছিল যারা বলি, ভাগ ও কর রূপে রাষ্ট্রকে প্রচুর পরিমাণে রাজস্ব প্রদান করতে থাকে। মাথার মগধের সমৃদ্ধির অপর কারণ ছিল মগধের খনিজ সম্পদ। গয়া জেলার বারাবার পাহাড়ে, নয় জেলা ছিল ভারতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। কৌটিল্য যথার্থই লিখেছেন, রাজকোষ খনির ওপর ধারওয়ারে লৌহখনি আবিষ্কৃত হয়েছিল। লৌহ ও তাম্রখনি সম্পদে ধলভূম ও সিংভূম শ্রে নির্ভর করে এবং সেনাবাহিনী রাজকোষের ওপর। খনিই হচ্ছে যুদ্ধদ্রব্যের গর্ভাশয়। খ্রিঃ পঃ ষষ্ঠ শতকে দৈনন্দিন জীবনে এবং যুদ্ধের জন্য অস্ত্র নির্মাণে লোহার ব্যাপক ব্যবহার আরম্ভ হয়। বৈদিক যুগের শেষ থেকে ভারী ফলার লোহার লাঙ্গলে লোকে চাষ-আবাদ করত। ঘর-গৃহস্থালীর কাজের যন্ত্রপাতি তৈরির জন্যও লোহা লাগত। সবচেয়ে বেশি লোহার দরকার হত যুদ্ধের অস্ত্র তৈরির জন্য। মগধের লোহার খনিগুলি ছিল তার সামরিক শক্তির গর্ভগৃহ। মগধ এই লোহার খনিগুলির ওপর একচেটিয়া অধিকার স্থাপন করে। মগধের উন্নত কৃষি, লোকবল, তার অরণ্য সম্পদ এবং খনিজ সম্পদ মগধকে অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় অসাধারণ শক্তিশালী করেছিল। শক্তিশালী হওয়ার ফলে মগধ ক্রমে আগ্রাসী হয়ে উঠে।
বাসাম, রোমিলা থাপার প্রভৃতির মতে, গঙ্গানদীর ওপর মগধের নিয়ন্ত্রণ এবং মগধের বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি ছিল তার সাম্রাজ্যের মূলে। মগধের অবস্থান নৌবাণিজ্যের পক্ষে অনুকূল ছিল। গঙ্গানদীর একটি বড় অংশ মগধের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ছিল। আর মগধের সীমায় ছিল শোন ও চম্পা। সে যুগে নদীপথে বাণিজ্য চলত। সুতরাং পূর্ব ভারত থেকে বারাণসী পর্যন্ত মালপত্র প্রধানত গঙ্গার খাত দিয়ে নৌকাপথে চলাচল করত। গঙ্গার ওপর মগধের আধিপত্য তার সমৃদ্ধিকে বাড়ায়। বাসাম বলেন যে, গঙ্গার ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য পাওয়ার জন্যই মগধ প্রতিবেশি রাজ্যগুলিকে দখল করে। প্রতিবেশি অঙ্গরাজ্যের চম্পা বন্দর ছিল একটি বিখ্যাত নদী বন্দর। চম্পা থেকে গঙ্গার খাত বেয়ে সমুদ্রে জাহাজ পড়ত। দক্ষিণ ভারত এবং ব্রহ্ম ও দূরপ্রাচ্য পর্যন্ত বাণিজ্য চলত, একথা জাতকে বলা হয়েছে। অঙ্গ দখল করার পর চম্পার এই বাণিজ্য মগধের হাতে চলে আসে। গঙ্গা ও বঙ্গোপসাগর, দক্ষিণ ভারত ও দূরপ্রাচ্যের সামুদ্রিক বাণিজ্যের মালিক হয় মগধ। এর পর গঙ্গার ভেতরের দিকে মগধ মুখ ফেরায়। কাশী বা বারাণসী ছিল গঙ্গাতীরে এক প্রসিদ্ধ বাণিজ্যকেন্দ্র ও উর্বরা অঞ্চল। কোশলকে পরাস্ত করে মগধ, কাশী দখল করলে গঙ্গার বেশির ভাগ তার অধিকারে আসে। বাকি থাকে বৈশালী। গঙ্গার উত্তর তীরে লিচ্ছবিদের পরাস্ত করে গঙ্গার দুই উপকূল বৈশালী সহ মগধ দখল করে তার বাণিজ্য ও সমৃদ্ধিকে কায়েম করে নেয়। বাণিজ্য এবং গঙ্গার ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল মগধের সাম্রাজ্যবাদের লক্ষ্য এবং তার সাফল্যের মূলে।
এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক কারণ হিসাবে বলা চলে যে, মগধে ছিল মিশ্র সংস্কৃতির ও মিশ্র আদর্শের প্রবণতা। উত্তর ভারতের আর্য সংস্কৃতির প্রবাহ উত্তরপ্রদেশ পার হয়ে যখন মগধে পৌঁছায় তখন তার জোর অনেকটা কমে গিয়েছিল, তার প্রাথমিক উগ্রতা হ্রাস পেয়েছিল। অপর দিকে পূর্ব ভারতের অনার্য সংস্কৃতির রেশ মগধে কিছুটা তখনও ছিল।
মহাভারতের পৌণ্ড্র বাসুদেবের উপাখ্যান ও জরাসন্ধের উপাখ্যান একথা স্মরণ করিয়ে দেয়। জরাসন্ধ তো কৃষ্ণ উপাসনাকে নিন্দা করে প্রাণ হারান। সুতরাং মগধ এই উভয় সংস্কৃতির মিলনে এক নতুন শক্তি পেয়েছিল। মধ্যযুগে জার্মান জাতি যেমন তাদের ক্ষাত্রশক্তির সঙ্গে রোমান সংস্কৃতির মিলনে প্রবল হয়ে উঠে, মগধ অনেকটা তাই হয়েছিল। আর্য মানসিকতা ও অনার্য বাহুবলের মিলনে মগধ হয়ে উঠে দুর্বার। মগধের নেতৃত্বে দ্বিগ্বিজয়ের আগে, পূর্ব ভারত থেকে ধর্ম বিজয়ে বাহির হন মহাবীর ও গৌতম বুদ্ধ। এই মহাপুরুষেরা ভাব জগতে যে বিজয় ঘটান রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার স্থূল প্রতিরূপ দেখা দেয় মগধের সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভবে।
বৈদিক যুগের সমতাবাদী উপজাতীয় আইনবিধির বদলে নতুন বর্ণভিত্তিক আইন ও বিচার ব্যবস্থা গড়ে উঠায় কিভাবে শক্তিশালী অঞ্চলগত রাজতন্ত্রের উদ্ভব ঘটেছিল তা দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা বিশ্লেষণ করেছেন। বৈদিক যুগের শেষদিকে সভা ও সমিতির মত উপজাতীয় গণপরিষদগুলি তাদের গুরুত্ব হারায়। বৃহদায়তন অঞ্চলগত রাষ্ট্রের কাঠামোয় এই উপজাতীয় গণপরিষদগুলির বদলে উচ্চবর্ণ-ভিত্তিক সংগঠন গড়ে উঠে, যারা অবাধ ঐক্যবন্ধ ভারতরাষ্ট্র ও স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্রকে সমর্থন করে। ড. রায়চৌধুরী প্রভৃতি স্থাপনের আদর্শ ঐতিহাসিকদের মতে, প্রাচীন যুগে ঐক্যবদ্ধ ভারত রাষ্ট্র স্থাপনের আদর্শ বিশেষভাবে দেখা যায়। ধর্মশাস্ত্রগুলি রাজচক্রবর্তী, একরাট, বিরাট, সম্রাট, বিশ্বজনীন প্রভৃতি উপাধির মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্য স্থাপনের প্রেরণা দেয়। মগধের রাজবংশগুলি এই আদর্শের আহ্বানকে উপেক্ষা করেনি। তাছাড়া খ্রিঃ পুঃ ষষ্ঠ শতকে ভারতের রাজনৈতিক অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে মগধের রাজবংশগুলি তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের চেষ্টা করে।