ব্রাহ্ম আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা কর অথবা, ব্রম্ভ সমাজ আন্দোলনের মাধ্যমে ধর্ম ও সমাজ সংস্কার কিভাবে অগ্রসর হয়েছিল

ব্রাহ্ম আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা কর অথবা, ব্রম্ভ সমাজ আন্দোলনের মাধ্যমে ধর্ম ও সমাজ সংস্কার কিভাবে অগ্রসর হয়েছিল

 ব্রাহ্ম আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা কর অথবা, ব্রম্ভ সমাজ আন্দোলনের মাধ্যমে ধর্ম ও সমাজ সংস্কার কিভাবে অগ্রসর হয়েছিল

ব্রাহ্ম আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা কর

পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার ভারতীয় ধর্ম ও সমাজকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে একদল প্রগতিশীল ব্যক্তি হিন্দু ধর্ম ও সমাজের অন্ধকার দিকটি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন ৷ নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রবর্তন পশ্চিমী চিন্তার অনুপ্রবেশ ইউরোপীয় মিশনারি ও কোম্পানির আমলাদের একাংশে ভারতীয় সংস্কৃতিকে ও প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টা এই প্রগতিশীল ভারতীয় দেশের সম্পৃক্তক আধুনিকরণের সাথে ধর্মীয় , সামাজিক,সংস্কার আন্দোলনের উদ্বুদ্ধ করে আধুনিক ভারতের রূপকার রাজা রামমোহন রায় ‌৷ উনবিংশ শতাব্দীর ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের অঙ্গ হিসাবে বেদান্তের একেশ্বরবাদ এর উপর ভিত্তি করে হিন্দু ধর্মকে সংস্কার মুক্ত করার জন্য ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথমে আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠা করেন এবং একেশ্বরবাদ এর পক্ষে জোর প্রচার চালান ৷ 1828 খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন ৷ ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে এই ব্রাহ্ম সভার নাম হয় ব্রাহ্মসমাজ ‌ ব্রাহ্ম আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল ঈশ্বর এক ও অভিন্ন,এমনকি সকল ধর্মের মূল কথা এক ৷ রামমোহন রায় মনে করেছিলেন ব্রাহ্ম আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতীয় জনগণের মধ্যে ধর্মগত ভেদাভেদ দূর করা হবে ৷ এই কারণে ধর্ম সংস্কারের পাশাপাশি ব্রাহ্ম সমাজ বিভিন্ন সামাজিক ও শিক্ষা সংক্রান্ত আন্দোলনেও অবতীর্ণ হয় ৷



রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর ব্রহ্ম সমাজ কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে ৷ কিন্তু তার সহযোগী তারকনাথের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মসমাজে যোগ দিলে ব্রাহ্ম আন্দোলনের নতুন প্রাণের সঞ্চার হয় ৷ রামমোহন রায় তার ধর্মমতকে কোন বিশেষ সম্প্রদায় রূপে গড়ে তুলতে চান নি ৷ একেশ্বর বাদে বিশ্বাসী যে কোন মানুষ ব্রাহ্মসমাজে আসতে পারে পারতেন ৷ দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম আন্দোলনকে একটি বিশেষ ধর্মমত এবং একটি সম্প্রদায়ের রূপে গড়ে তোলেন ৷ নানা নিয়মকানুন বিভিন্ন আচার-আচরণ ও দীক্ষা দান রীতি প্রবর্তন করে ৷ তিনি ব্রাহ্ম আন্দোলনকে একটি সংঘটিত ধর্মীয় রূপ দেন এবং প্রথম ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচারে উদ্যোগী হন ৷ তিনি ব্রাহ্ম ধর্মের অনুষ্ঠান পদ্ধতি নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন ৷ খ্রিস্টান পাদ্রী ও উগ্র পাশ্চাত্য পন্থীদের হিন্দু ধর্মের উপর অযৌক্তিক আক্রমণের তিনি তীব্র সমালোচনা করেন ৷ তার উদ্যোগে স্থাপিত তত্বাবোধিনী সভা এবং তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা বাংলার শিক্ষা সমাজ ও সংস্কৃতিক জীবনের নানাভাবে সমৃদ্ধ করে ৷



তত্বাবোধিনী সভা ছিল বাঙালির বুদ্ধিজীবীদের মিলন কেন্দ্র ৷ বিদ্যাসাগর,অক্ষয় কুমার দত্তের মতো বুদ্ধিজীবীরা এখানে সমবেত হতেন ৷ এই সভার মুখপাত্র তত্বাবোধিনী পত্রিকা সমকালীন কুসংস্কার বিরোধী মতামত প্রকাশিত হয় ৷ ব্রাহ্মসমাজের আচার অনুষ্ঠান সম্পর্কে যুবকদের শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে তত্বাবোধিনী পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করেন ৷ অক্ষয় কুমার দত্ত এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিযুক্ত হন ৷ তার আমলে ব্রাহ্মসমাজ শিক্ষা বিস্তার ও বিধবা বিবাহ প্রচলন এবং বাল্যবিবাহ-বহুবিবাহ নিবারণ ও অন্যান্য সামাজিক কুসংস্কার দূর করার কর্মসূচি গ্রহণ করে ৷



১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে তরুণ কেশব চন্দ্র সেন ব্রাহ্ম সমাজে যোগদান করলে ব্রাহ্ম আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে ওঠে ৷ তার নিষ্ঠা ধর্ম উন্মেদনা ও ব্যক্তিত্বের মুগ্ধ হয়ে বহু শিক্ষিত যুবক দলে দলে ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করেন ৷ তিনি তরুণ ব্রাহ্মদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা হন ৷ তার সহকর্মীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী,উমেশ চন্দ্র দত্ত প্রমুখ ৷ আর তার সাফল্যে মুগ্ধ হয়ে 1862 খ্রিস্টাব্দে দেবেন্দ্রনাথ তাকে ব্রহ্মানন্দ উপাধি দেন এবং ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক পদে বরণ করেন ৷ তিনি বাল্যবিবাহ জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে এবং নারী শিক্ষার প্রসার নারীর স্বাধীনতা অসবর্ণ বিবাহ,বিধবা বিবাহ ও শ্রমিক কল্যাণের পক্ষে দেশে এক আন্দোলন গড়ে তোলে ৷ তার উদ্যোগে ব্রাহ্ম বন্ধুসভা 'ক্যালকাটা কলেজ(১৮২৭ খ্রিঃ) ইন্ডিয়ার মিরর পত্রিকার প্রকাশ তার অন্যতম কৃতিত্ব ৷ নারী কল্যাণের জন্য তিনি বামাবোধিনী সভা প্রতিষ্ঠা করেন ৷ কেবল বাংলার অভ্যন্তরেই নয় বোম্বাই,মাদ্রাজ উত্তর-পশ্চিম প্রদেশেও প্রভৃতি অঞ্চলেও তিনি ব্রাহ্ম ধর্ম ও সমাজ সংস্কারে আদর্শ বিস্তীর্ণ করেন ।


 ঐতিহাসিক ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার এর মতে কেশবচন্দ্র পরিচালিত এই ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনই হল প্রথম সর্বভারতীয় আন্দোলন ৷ ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে সারাদেশে ব্রাহ্মসমাজের সদস্য ছিল ৫০০ জন, ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে তা হয়ে দাঁড়ায় ২০০০ জন ৷


 কেশব চন্দ্র সেন এর নেতৃত্বাধীন তরুণ ব্রাহ্মদের সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের বিরোধ বাধে ৷ অসবর্ণ বিবাহ,বিধবা বিবাহ সাংস্কৃতিক এর পরিবর্তে বাংলায় তন্ত্র উচ্চারণ প্রভৃতি প্রশ্নে দেবেন্দ্রনাথের রক্ষণশীল প্রতিবাদ করায় ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে ও তার অনুগামীরা ব্রাহ্মসমাজ থেকে বহিষ্কৃত হন ৷ তারা ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং দেবেন্দ্রনাথের ব্রাহ্ম সমাজ আদি ব্রাহ্মসমাজ নামে পরিচিতি লাভ করেন ৷ একেশ্বরবাদী হলেও দেবেন্দ্রনাথ মনে করতেন যে ব্রাহ্মধর্ম হিন্দু ধর্ম, হিন্দুদের জন্যই এই ধর্ম এবং তা হলো হিন্দু ধর্মের বিশুদ্ধ রূপ ৷ তার মতে ব্রাহ্ম ধর্ম হলো ধর্মীয় আন্দোলন ৷ তিনি সমাজ সংস্কার কে এই আন্দোলনের অঙ্গীভূত করতে রাজি ছিলেন না অপরপক্ষে কেশব চন্দ্র ও তার অনুগামীদের কাছে ব্রাহ্ম ধর্ম হল সন্মনয়ী ও সর্বজনীন ৷ তারা জাতিভেদ সামাজিক বহু প্রথার বিরোধী ছিলেন এবং তাদের কাজে ব্রহ্ম ধর্ম নিছক একটি ধর্মীয় আন্দোলন নয় সমাজসংস্কার তার অঙ্গীভূত ৷



কেশব চন্দ্র সেনের নেতৃত্বে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ বিধবা বিবাহ,স্ত্রী শিক্ষা,অসবর্ণবিবাহ শিক্ষা বিস্তার ও নানা জনহিত কর কার্যাবলীর পক্ষে এবং বাল্যবিবাহ মদ্যপান ও পর্দা প্রথার বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন ৷ সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্রাহ্মসমাজের আদর্শ প্রচারের জন্য 'এক পয়সা দামে পত্রিকা সুলভ সমাচার' শ্রমিকদের সংগঠিত করার জন্য 'ভারত শ্রমজীবী' শ্রমিকদের মধ্যে মদ্যপান বন্ধ করার জন্য 'এক পয়সা দামে পত্রিকা মদনা তরল' প্রভৃতি পত্রিকা প্রকাশিত হয় ৷ মূলত ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলনের ফলে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে সরকার বিখ্যাত তিন আইন পাস করে এবং তার দ্বারা বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ হয় এবং বিধবা বিবাহ অসবর্ণবিবাহ পাস হয় । সেদিন কেশবচন্দ্রসেনকে যেসব তরুণ সাহায্যে করতে এগিয়ে আসে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শিবনাথ শাস্ত্রি,দারকোনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, মহেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ ৷




কেশব চন্দ্রের খ্রিষ্টপ্রীতি ইংরেজদের প্রতি চৈতন্যপ্রতি ভক্তিবাদের প্রতি বিশ্বাস এবং শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সান্নিধ্যে এসে হিন্দু দেবদেবী ও অনুষ্ঠানের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ব্রাহ্মসমাজের ধর্মঙ্কর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে ৷ ব্রাহ্মসমাজের আদর্শ অনুযায়ী শিক্ষা ও নারী স্বাধীনতার পক্ষে এবং বাল্যবিবাহের বিপক্ষে প্রচার চালানোর সত্ত্বেও তিনি নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা এবং নারীদের উচ্চতর শিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা দেওয়ার বিরোধী ছিলেন ৷ নীতিগতভাবে বাল্যবিবাহ ও হিন্দু বিবাহ পদ্ধতির বিরোধী হয়েও তিনি হিন্দু মতে নিজ 14 বছরের নাবালিকা কন্যা সুনীতি দেবীর সঙ্গে কোচবিহারের নাবাল্যক হিন্দু রাজপুত্র নিপেন্দ্র নারায়নের বিবাহ দেন ৷ 'ম্যারেজ অ্যাক্ট' অনুসারে পাত্রের বয়স ১৮ এবং পাত্রীর বয়স ১৬ হওয়া উচিত ৷ এক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রী উভয়ই অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন এইসব কারণে শিবনাথ শাস্ত্রী,আনন্দ মোহন বসু,দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় ফেঁপে পড়েন এবং তারা ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন ৷ 1880 খ্রিস্টাব্দের সর্বধর্ম সমন্বয়ে প্রকাশ্যে কেশবচন্দ্র তার নববিধান ঘোষণা করেন এবং তার ব্রাহ্মসমাজ নববিধান ব্রাহ্মসমাজ নামে পরিচিত লাভ করে । কালক্রমে কেশব চন্দ্র সেন পরিচালিত নববিধান তার প্রভাব প্রতি হারিয়ে ফেলে এবং সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বে ধর্ম ও সময় সংস্কারের কাজে চলতে থাকে ৷

About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟