১৮৫৭ মহাবিদ্রোহের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সিপাহীদের নেতৃত্বে যে সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থান ঘটেছিল তাকে সাধারণভাবে ১৮৫৭ মহাবিদ্রোহ বলা হয় ৷ অধ্যাপক শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে,ব্রিটিশ শাসন যেমন হিংস্রতার একাধিপত্য গড়ে তুলেছিল তেমনি এশীয়রা ও সেই হিংসার সমুচিত জবাব পাল্টা হিংসার মাধ্যমে ফিরিয়ে দিয়েছিল ৷" এই বিদ্রোহের মূল শক্তি ছিল অযোধ্যা,বিহার ও উত্তরপ্রদেশের লোকেদের নিয়ে গঠিত বেঙ্গল আর্মির সৈন্যরা ৷ এদের অন্তর্ভুক্ত ছিল ব্রাহ্মণ,রাজপুত,জাট ও মুসলমানরা ৷ অধ্যাপক এন কবিরাজের মতে এই সিপাহীরা ছিল গ্রাম সমাজের অপেক্ষাকৃত উঁচু তলার লোক ৷ গ্রামের সাথে এদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল ৷ ১৮৫৭ গোড়ার দিকে কলকাতার নিকটবর্তী ব্যারাকপুরের দুর্নীতিতে প্রথম তাদের অসন্তোষ দেখা দেয় । সরকার কঠোর হাতে সেই বিদ্রোহ দমন করলে ও তাদের অসন্তোষ কমানো যায়নি । ১৮৫৭ এর ১০ এই মে মিরাট ছাউনিতে একদল সিপাহির ওপর অন্যায় আচরণের প্রতিবাদে সিপাহীরা জৈনক ব্রিটিশ অফিসার কে হত্যা করে বিদ্রোহের সূচনা করেন ৷ তারা লাল কেল্লাই প্রবেশ করে ক্ষমতাচ্যুত মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ কে হিন্দুস্তানের সম্রাট বলে ঘোষণা করেন ৷
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
বিদ্রোহীদের কর্মসূচিতে সামরিক ও রাজনৈতিক চিন্তার সমন্বয় দেখা দেয় ৷ বিদ্রোহীদের চাপে বাহাদুর শাহ ও দেশবাসীর উদ্দেশ্যে এক আবেদন প্রচার করেন ৷ তিনি হয়ে ওঠেন ভারতের পুনো অধিস্তিত স্বাধীনতার প্রতীক ৷ প্রথম পর্যায়ে সিপাহিদের ছয়জন এবং নাগরিকদের চারজন প্রতিনিধি সমন্বয়ে জলসা নামক একটি প্রশাসনিক সংস্থা গঠন করেন ৷ কিন্তু দিল্লির জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা এই সংস্থার ছিল না ৷ তাই অসংগঠিত পথে ১৮৫৭ এই অভ্যুত্থান ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য সহ ভারতের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে ৷
১৮৫৭ বিদ্রোহের আঞ্চলিক তারতম্য ছিল লক্ষণীয় ৷ এই বিদ্রোহের প্রভাব যেমন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনুভূত হয়নি তেমনি বিদ্রোহে লিপ্ত অঞ্চল গুলির প্রেক্ষাপটের ও বৈশিষ্ট্য ছিল স্বতন্ত্র ৷ ভারত ও বিহারের কিছুটা অংশ ছিল বিদ্রোহের মূল কেন্দ্র ৷ দিল্লী থেকে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে যায় উত্তর পশ্চিম প্রদেশের সেনা ছাউনিতে ৷ এ অধ্যায় এই অভ্যুত গণবিদ্রোহের রূপ নেয় অতঃপর একে একে আলীগড়,বৈরুল কানপুর,লক্ষৌ ও এলাহাবাদে বিদ্রোহের প্রকাশ ঘটে ৷ প্রতিটি ক্ষেত্রে বড় বড় শহর দখলের পর একটি কার বিদ্রোহী সরকার গঠিত হয় ৷ বিরালির বিদ্রোহী সরকারের দায়িত্ব পান রোহিলা সরদার বাহাদুর খাঁ, কানপুরের দায়িত্বে থাকেন নানা সাহেবের হাতে, এলাহাবাদের নেতৃত্ব দেন ওয়াহাবী নেতা লিয়াকত আলী ৷ অযোধ্যার প্রাক্তন নবাব বংশকে পুনর শাসিত করা হয়,রানী লক্ষ্মীবাঈ বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন অল্প কালের মধ্যেই ব্রিটিশের প্রতি অসন্তোষ গ্রামবাসীরা বিদ্রোহীদের সাহায্যে এগিয়ে আসে ৷ ১৯ শে জুন গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং লিখেছিলেন,"রোহিলা ও দোয়া অঞ্চল দিল্লি থেকে কানপুর,এলাহাবাদ পর্যন্ত গোটা দেশ কেবল আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়নি চূড়ান্তভাবে আইন শৃঙ্খলাহীন ও হয়ে উঠেছে ৷"
নরহরি কবিরাজ লিখেছেন সিপাহীরা হন "উর্দি পড়া কৃষক" ৷ সিপাহী বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন কারীরা সবাই ছিল গ্রামবাসী ৷ তাই এদের আত্মীয়দের মাধ্যমে বিদ্রোহীর বার্তা বিদ্যুতের বেগে গ্রামে গ্রামে পৌঁছে যায় ৷ মিরাট বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলনের পর গ্রামবাসীরা সরকারি তহবিল লুট ও মহাজনদের খুন করে বিদ্রোহীদের উৎসাহিত করে ৷ আবার মোজঃফর নগরে বিদ্রোহীদের পৌঁছানোর আগে এই গ্রামবাসীরা বিদ্রোহের ঘোষণা করেন ৷ সাহারানপুরের আন্দোলন হিন্দু ও মুসলমানদের ঐক্য ছিল লক্ষণীয় ৷ বিদ্রোহ চলাকালীন ঘোষিত প্রচার করতে হিন্দু মুসলমানরা ঐক্যের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়া হয় ৷ বাহাদুর শাহের প্রচারিত ঘোষণা পত্রে বলা হয় মুসলমানেরা তুলে ধরেন মোহাম্মদের পতাকা এবং হিন্দুরা তুলে ধরেন মহাবীরের পতাকা ৷ রুদ্রাংশ মুখার্জি "Awauth in revold" গ্রন্থে লিখেছেন যে,"এখানে বিদ্রোহীরা মুসলিম রাজকুমার কাদীরকে সাক্ষাৎ ভগবান কৃষ্ণ বলে আখ্যায়িত করেছেন ৷"
সিপাহী বিদ্রোহের সূত্রে যে বেসামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছিল তাদের আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের পাশ্চাত্যে ছিল ভারতীয় সমাজের উপনিবেশিক শাসনের ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব ৷ প্রভাব-বৈচিত্র্য অনুসারে ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া ও ছিল স্বতন্ত্র ৷ যে সকল অঞ্চল উপনিবেশিক শাসনের বিশেষ সুবিধা পেয়েছিল তারা বিদ্রোহে নামেননি । যেমন বাংলা ও পাঞ্জাব ছিল শান্তিপূর্ণ ৷ গোটা দক্ষিণ ভারতের বিদ্রোহের কোন প্রভাব পড়েন নি ৷ আবার যে সমস্ত অঞ্চলের সিপাহী বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিলেন সেখানে সক্রিয় ছিল দুটি উৎপাদন ৷ যথাঃ- (১). সামন্ত প্রভু ও বড় জমিদার ৷ (২). সাধারণ কৃষক বা কৃষক সম্প্রদায় ৷
পরস্পর বিরোধী স্বার্থের অধিকারী এই দুইটি শ্রেণীর অভিযোগে ছিল স্বতন্ত্র ৷ সামন্ত প্রভুদের অভিযোগ ছিল ডালহৌসের স্বত্ববিলোপ নীতির বিরুদ্ধে, কারণ এই দ্বারা দত্তক পুত্র গ্রহণের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয় । যার ফলে সাঁতারা,নাগপুর,ঝাঁসি,সম্বলপুর, উদয়পুর সহ বহু স্বাধীন রাজ্য ব্রিটিশদের অধিকারভুক্ত হয় ৷ এইভাবে ভারতের পরম্পরা গত উত্তরাধিকারী ব্যবস্থার ইংরেজদের হস্তক্ষেপ ঘটলে সামন্ত প্রভুরা অসন্তুষ্ট হন এবং বিদ্রোহীদের সাথে হাত মিলান ৷ 1856 তে ইংরেজ অযোধ্যা দখল করে নিলে রাজ পরিবারের সাথে সম্পর্কযুক্ত অভিজাতরাও ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং তারাও বিদ্রোহে নেমে পড়েন ৷ তেমন পেশোয়ার দত্তপুত্র নানা সাহেব, বেগম হযরত মহল, রানী লক্ষীবাঈ প্রমুখ ও ব্রিটিশ বিরোধী অভ্যুত্থানের যোগ দিয়ে সিপাহী বিদ্রোহের রাজনৈতিক বৈধতা ও ব্যাপকতা দেন ৷ অন্যদিকে মধ্য ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে যেমন ইন্দোর,গোয়া,লিয়ন বা রাজস্থানের কিছু অঞ্চলে ইংরেজ কর্তৃক ভারতীয় রজাদের রাজ্য দখলের দমন ধমনীর ঘটনা ঘটেনি ৷ তাই এই সকল অঞ্চলের সিপাহীদের বিদ্রোহ ও সম্প্রসারিত হলেও স্থানীয় রাজপরিবার গুলি সেই বিদ্রোহের সাথে সংযুক্ত হয়নি । উপরন্ত ব্রিটিশদের অনুগত্য থেকে বিদ্রোহ দমনে সাহায্য করেছিলেন ৷
অযোধ্যা দখলের পর ব্রিটিশ সরকার উচ্চ হারে রাজস্ব আদায় চালু করলে বহু প্রভাবশালী, তালুকদার সম্পত্তিচ্যুত হন ৷ রাজত্ব আদায়ের ক্ষেত্রে সরাসরি রায়তের সাথে বন্দোবস্ত করতে সরকার উদ্যোগী হন এর লক্ষ্য ছিল মধ্যসত্ত্ব ভোগীদের কাছ থেকে কৃষকদের মুক্ত রেখে সরকারের জনপ্রিয়তা অর্জন করা ৷ এই ব্যবস্থা অযোধ্যার বহু তালুকদার সম্পত্তি হারান এমনকি তাদের নিরস্ত করে এবং দুর্গ গুলি ধ্বংস করে অভ্যুল্থানের সম্ভাবনা বিনষ্ট করা হয় ৷ উত্তর পশ্চিম প্রদেশে ও অসংখ্য তালুকদারদের সম্পত্তি সরকার দখল করে নেন ফলে তালুকদার শ্রেণী বিদ্রোহী হয়ে ওঠে এবং সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হলে তারা হারানো ভূখণ্ড গুলিকে পুনর দখলের চেষ্টা করেন ৷ লক্ষ্যণীয় যে রায়ত বা প্রজারা জমিদার বা তালুকদারদের এই কাছে কোন বাধা তো দেয়নি বরং খুশি মনে তাদের বরণ করে নিয়েছিলেন ৷ টমাস মেটকাপ,"Aftermath of revolt India" গ্রন্থে বলেছেন,"আত্মীয়তা ও সামান্তিক আনুগত্যের বন্ধনে আবদ্ধ গ্রামবাসীরা সামন্ত প্রভুতের দাবি খুশি মনে মেনে নিয়েছিল এবং তাদের সাধারণ শত্রু ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে হাত মিলিয়ে নিয়েছিল ৷" রুদ্রাংশ মুখার্জি দেখিয়েছেন,"কিছু কিছু অঞ্চলে নিজ নিজ স্বার্থ পূরণের উদ্দেশ্যে তালুকদার কৃষক জোট দানা বেঁধেছিল ৷" উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের মোহলওয়াড়ি ব্যবস্থার আওতাধীন অঞ্চলেও এই দৃশ্য দেখা যায় । শশীভূষণ চৌধুরী লিখেছেন যে,"উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের সরকারি ভূমি বন্দোবস্ত নীতির ফলে ভূমধ্য কারীর শ্রেণী ও সাধারণ কৃষক উভয়পক্ষ বঞ্চিত হয়েছিল ১৮৫৭ তে সিপাহীদের অভ্যুত্থান ঘটলে এই সকল সম্পত্তি হারানো মানুষ সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার আশায় বিপ্লতে মিলিত হয়েছিল ৷"
Erick stokert তার "The pearantrand the raj" গ্রন্থে লিখেছেন যে,"ব্রিটিশ রাজস্ব ব্যবস্থার ফলে সর্বস্তরে তালুকদারদের দুর্দশা ভোগ করতে হয় অনেক জায়গায় সম্পত্তির অধিকার পরম্পরা গত ভাবে হাত বদলে গিয়েছিল,কোথাও কোথাও তা বৃহত্তর জমিদারের উদ্ভব ঘটেছিল কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় লোকজন সরকারি পদের সুবাদে জমির অধিকার পেয়েছিল ৷" এই সকল মানুষ বিদ্রোহ অবশ্যই করেননি উপরন্ত নিজ নিজ এলাকায় আপন আপন সম্প্রদায়কে বিদ্রোহ থেকে সরিয়ে আনার কাজে তৎপর ছিল ৷ বিশেষত অযোধ্যা ও উত্তর পশ্চিম প্রদেশের এই দুটি ছবি দেখা যায় ৷১৮৫৭ অভ্যুল্থানে আঞ্চলিক বৈচিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে C.B.Bayle ১৮৫৭ মহাবিদ্রোহের মধ্যে একাধিক বিদ্রোহের সমাবেশ লক্ষ্য করেছেন ৷ বেইলির মতে,"বিদ্রোহীদের লক্ষ্য ছিল মুঘল বৈধতার বৃহত্তর পরিমন্ডলে ইন্দ্র-মুঘল দেশীয় রাষ্ট্রগুলির আঞ্চলিক রাজ্যগুলির পুনর প্রতিষ্ঠা যেখানে জমি ও জনগণের মধ্যে থাকবে শান্তি সাম্য ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে বিদ্রোহের তাপের ফলেও হোক কিংবা বিদ্রোহের উত্তাল মধ্য ও পশ্চিম ভারতের অঞ্চল গুলির চরিত্রগত বৈচিত্র থাকলেও এই বিদ্রোহের সূত্রের শাসনের বৈধতা সম্পর্কে ভারতবর্ষের যে মোহ মুক্তি ঘটেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ৷