উনিশ শতকে বাংলায় সংগঠিত নীল বিদ্রোহ সম্পর্কে যা জানো লেখো এই বিদ্রোহ কি শুধুমাত্র কৃষক বিদ্রোহ ছিল
ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশিক প্রক্রিয়া সব থেকে বেশি জর্জরিত হয়েছিল কৃষক শ্রেণি । প্রাক ব্রিটিশ পর্বে ভারতের কৃষি ব্যবস্থা এবং কৃষক শ্রেণীর যে অবস্থায় ছিল কোম্পানির 100 বছরের শাসন ও শোষণে তা ভেঙে চুরমার হয়ে যায় ৷ কোম্পানির আমলে খাজনা নগদে আদায় করার ফলে কৃষক শ্রেণী কেবল খাজনা প্রদানকারী প্রজা হিসাবে পরিণত হয় ৷ রাজস্ব দিতে না পারলে কৃষকদের হাত থেকে জমি চলে যেতো অন্য হাতে ৷ সেই সঙ্গে ছিল দারিদ্র ও ঋণের ভার ৷ ঊনবিংশ শতকের প্রথম ভাগেই দেখা যায় কৃষক শ্রেণী এক বিপুল অংশ ভূমিহীন কৃষকের পরিণত হয়েছে, যার পরিণত ছিল উপনিবেশিক শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে সংগঠিত একাধিক কৃষক বিদ্রোহ ৷ যার মধ্যে অন্যতম হলো বাংলার নীল বিদ্রোহ ৷
কৃষক শ্রেণীর কেন বিদ্রোহী হয়েছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিক মহলে বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন ৷ কোম্পানির আমলে মূলত তিন ধরনের ভূমি বন্দোবস্ত প্রবর্তিত ছিল ৷ যার মধ্যে বাংলায় ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত । এই ব্যবস্থা সহ প্রচলিত অন্যান্য ব্যবস্থায় একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল কোন না কোন ভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকার ও উৎপাদনে নিযুক্ত কৃষকদের মাঝে সুদখোর মহাজন ও মধ্যস্বত্ব ভোগী শ্রেণীর উপস্থিত ৷ উৎপাদনের ওপর যারা রাজস্বের হার মধ্যসত্ত্ব ভোগীদের অতিরিক্ত লালসা ও শোষণ দুর্ভিক্ষ ভরা প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয় মহাজনদের সুদের অত্যাধিক হার ইত্যাদি নানা কারণে কৃষকের অবস্থা ধীরে ধীরে শোচনীয় হয়ে পড়ে ৷
প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ ক্যাথলিক গাফ মন্তব্য করেছেন যে," প্রায় সমগ্র ব্রিটিশ আমল জুড়েই ভারতীয় কৃষকগণ সশস্ত্র বিদ্রোহে সামিল হয়েছে ৷ স্থান ও পাত্র ভেদে বিদ্রোহের কারণ ও চরিত্র ছিল হয়তো স্বতন্ত্র কিন্তু বিদ্রোহীদের সকলেই ছিলেন কৃষিজীবী এবং তাদের বিদ্রোহ ছিল শোষণের বিরুদ্ধে ৷" এই বিদ্রোহ গুলিকে দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যেতে পারে যেমন - আদিবাসী বা উপজাতি কৃষক বিদ্রোহ এবং সাধারণ কৃষক বিদ্রোহ ৷ প্রাচীন খাদ্য সংগ্রাহক মানব গোষ্ঠীর স্তর থেকে উন্নীত হয়ে এরা কৃষিকেই জীবিকা হিসাবে গ্রহণ করেছে ৷ জমিদার মহাজনদের ও মধ্যসত্বভোগী শ্রেণীদের শোষণের শিকার হয়েছে ৷ তাই একসময় এরাও লিপ্ত হয়েছে একাধিক নীতি ও কর্মসূচির বিরুদ্ধে সংগঠিত আন্দোলনে । যেমন ১৮৩২ এর সিংভূমের কোল সম্প্রদায় ভুক্ত কৃষকরা আন্দোলনের ধ্বগা তুলে ধরেছিল ৷
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ এবং তার ব্যাপক প্রভাব বাংলা তথা ভারতের কৃষক আন্দোলনের প্রকৃতিকে পরিবর্তন এনে দেয় । মহা বিদ্রোহের ব্যর্থতা এবং মহারানীর ঘোষণাপত্রের মধ্যে দিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কৃতিত্ব শেষ হয় ৷ অন্যদিকে ভারত বর্ষ সরাসরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে ৷ এই সময় কৃষকরা সরাসরি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সামিল হয় । উনবিংশ শতকের এই জাতীয় কৃষক আন্দোলনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো নীল বিদ্রোহ ৷ ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে বহুল পরিমাণের উৎপাদিত কাপড়ের রং করার জন্য প্রচুর নীলের প্রয়োজন দেখা দেয় । কৃত্রিমভাবে নীল রং তৈরির উপকরণ তখন আবিষ্কৃত হয়নি । তাই ইংরেজ বণিকরা বাংলায় নীল চাষ প্রবর্তন করতে উদ্যোগী হয় ৷ ভারতের প্রথম নীল চাষে ব্রিটিশ মূলধন নিয়োজিত হয়,যদিও নীল উৎপাদনের উৎসাহী ইংরেজ সাহেবগণ যে কোন ধরনের শর্তে নীল চাষ করিয়ে নেওয়ায় ছিল তাদের উদ্দেশ্য ৷ এখান থেকেই সূত্রপাত হয়েছিল "তিন কাঠিয়া ব্যবস্থার" প্রবর্তন (বিঘা প্রতি তিন কাটা জমি)
ব্রিটিশরা মূলধন বিনিয়োগ করলেও এবং বিভিন্ন নীতি নিলেও অচিরেই কৃষকরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ৷ অবশ্য এই বিদ্রোহের পাশ্চাত্যে একাধিক কারণ সক্রিয় ৷ প্রথমত, নীল চাষ ছিল কৃষকদের ক্ষেত্রে অলাভজনক ৷ ফলত কৃষকরা এতে উৎসাহিত হয়নি এই অবস্থায় নীলকর সাহেবেরা জোর করে কৃষকদের নীল চাষ করতে বাধ্য করে ৷
দ্বিতীয়তঃ আইন আদালত ছিল সাধারণ চাষীদের নাগালের বাইরে ৷ আবার সাধারণ প্রশাসন ও ক্ষমতাশালী জমিদাররা ছিলেন নীলকর সাহেবদের স্বপক্ষে ৷ ফলে চাষীদের প্রাণের ভয় ছিল ৷
তৃতীয়তঃ নীল চাষ করতে অস্বীকার করলে কৃষকদের জোড়পূর্বক আটকে রেখে অত্যাচার করা হতো ৷ এমনকি তাদের ধান জমিতে গবাদি পশু ছেড়ে দিয়ে তা নষ্ট করে দেয়া হতো ৷
চতুর্থতঃ নীল চাষ করার জন্য চাষীদের দাদন দেওয়া হতো ৷ কিন্তু সেই দাদনের হিসাবে এমন কর চুপি থাকতো যে চাষীর সারা জীবন নীল চাষ করেও সুদ বা আসল কোনটাই পরিশোধ করতে পারত না ৷ ফলে বংশপরম্পরায় তাকে নীলকর সাহেবদের কাছে বাধা থাকতে হতো ৷ এই কৃষকের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে অধ্যাপক প্রমোদ সেনগুপ্ত লিখেছেন,"মার্কিন ক্রীতদাসদের সাথে নীল চাষীদের প্রভেদ এই ছিল যে দাস প্রভুরা পয়সা খরচ করে দাস বিলাতেন কিন্তু নীল চাষিরা নিজেদের শ্রম ও অর্থ খরচ করে নীলকরদের দাসে পরিণত হতো।"
মহাবিদ্রোহের পর নীল চাষীদের আন্দোলন সংঘটিত ভাবে প্রকাশ পেলেও মহাবিদ্রোহের পূর্বে বিব্রতকর কিছু দৃষ্টান্ত দেখা যায় ৷ যেমন নদীয়া জেলার চৌগাদা গ্রামে বিশ্বনাথ সর্দার মাঝে মাঝে কুঠি আক্রমণ করে সাহেবদের বিপর্যস্ত করতেন ৷ তিনিও পরবর্তীকালে বিশে ডাকাত নামে পরিচিত হন । ১৮৫৭ এর মহাবিদ্রোহের পর নীলকরদের শোষণ ও অত্যাচারের মাত্রা এতটাই বেড়ে যায় যে কৃষকরা সমানতাল বিদ্রোহী ও ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে ৷ সুপ্রকাশ রায়ের মতে নীল চাষীরা প্রথমেই বিদ্রোহী হয়নি প্রথম পর্বে তারা আবেদন নিবেদন এর মাধ্যমে নীলকন সাহেব ও সরকারের সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টা করে ৷ কিন্তু কোন তরফ থেকে নীল অতঃপর ১৮৫৯ থেকে ৬০ খ্রিস্টাব্দে নীল চাষীদের চাপা ক্ষোভ প্রকাশ্যে বিদ্রোহের রূপ নেয় ৷ যা যশোর,পাবনা,নদীয়া প্রভৃতি যেসব জেলায় নীল চাষ বেশি হতো সেখানে বিদ্রোহ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ৷ নীল গাছ উপরে ফেলা হয় এবং কৃষক নিপীড়নের নীলকুঠি কে আগুনে ওমিভূত করা হয় ৷
নীল বিদ্রোহের নেতৃত্বে সাধারণত কৃষক সম্প্রদায় তবে নদিয়ার দুই ভাই বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস দিগম্বর বিশ্বাস মালাধার রফিক মন্ডল প্রমুখ ব্যক্তি বিদ্রোহের কেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে ৷ এক নতুন আসার স্বপ্ন দেখছিল হিন্দু ও মুসলমান চাষী এমনকি মহিলা রাও পুরুষ দের পাশে দাঁড়িয়ে আন্দোলনে পান সঞ্চার করে ৷ গভর্নর গ্রান্ড স্বীকার করেছেন বিদ্রোহীদের হাবভাব দেখে মনে হয়েছিল সুবিচার নাম পেলে তা নিয়ে নেওয়ার মতো সংগঠন শক্তি তারা সংগ্রহ করেছে ৷ বিদ্রোহী নীল চাষীদের লাঞ্ছনা ও আত্মত্যাগের বিবরণ দিয়ে হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় লিখেছেন,"বাংলাদেশের কৃষকদের সম্বন্ধে গর্বিত হতে পারে বিদ্রোহের জন্য তাদের অসংখ্য দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে অপমান,প্রহার, গৃহচ্যুত সম্পত্তির ধ্বংস সবই তাদের ভাগ্যে জুটেছে তবুও তারা মাথা নত করেননি ৷ দীনবন্ধু মিত্র রচনা করেন নীলদর্পণ নাটক - "যা নীল চাষীদের মর্মান্তিক জীবনের জীবন্ত দলিল হিসেবে স্বীকৃত ৷" মাইকেল মধুসূদন দত্ত ঐ নাটকটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন যা পাঠ করার ফলে বহু উদারপন্থী ইংরেজ নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সোচ্চার হন ৷"
শেষ পর্যন্ত নীল বিদ্রোহ সরকারের আপোশ নীতির মাধ্যমে শান্ত হয় ৷ লক্ষণীয় বিষয় হলো সার্বিকভাবে বাঙালি বুদ্ধিজীবী শ্রেণী এই বিদ্রোহকে সাহায্য করেনি । কারণ তাদের দৃষ্টিতে আধা সামন্ততান্ত্রিক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ক্ষতিকারক ছিল না ৷ কারণ তাদের অনেকেই এই ব্যবস্থা দ্বারা উপকৃত হয়েছিল ৷ তবুও বলা যায় অশিক্ষিত নীল চাষীরা যে প্রতিবাদের ধনী তুলেছিল তা ভারত আত্মাকে নতুন দিক নির্দেশ দিয়েছিল ৷ নীল বিদ্রোহের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে শিশির ঘোষ অমৃতবাজার পত্রিকায় যথার্থ লিখেছেন,"এই নীল বিদ্রোহে সর্বপ্রথম দেশের লোককে রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংঘবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা শিখিয়েছে ৷ বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশে ব্রিটিশ রাজত্বকালে নীল বিদ্রোহী হচ্ছে প্রথম বিপ্লব ।"
📛সম্ভাব্য প্রশ্ন গুলি হলঃ
- উনিশ শতকে বাংলায় সংগঠিত নীল বিদ্রোহ সম্পর্কে যা জানো লেখো
- নীল বিদ্রোহ কি শুধুমাত্র কৃষক বিদ্রোহ ছিল ৷
- নীল বিদ্রোহ সম্পর্কে আলোচনা কর ৷
- নীল বিদ্রোহ
- উনিশ শতকে বাংলায় সংগঠিত নীল বিদ্রোহ সম্পর্কে যা জানো লেখো এই বিদ্রোহ কি শুধুমাত্র কৃষক বিদ্রোহ ছিল