সংবিধান সভা কিভাবে ফ্রান্সকে পুনর্গ গঠিত করতে চেয়েছিল সংবিধান সবার অবদান ও সীমাবদ্ধতা আলোচনা কর

সংবিধান সভা কিভাবে ফ্রান্সকে পুনর্গ গঠিত করতে চেয়েছিল সংবিধান সবার অবদান ও সীমাবদ্ধতা আলোচনা কর

 সংবিধান সভা কিভাবে ফ্রান্সকে পুনর্গ গঠিত করতে চেয়েছিল সংবিধান সবার অবদান ও সীমাবদ্ধতা আলোচনা কর

সংবিধান সভা কিভাবে ফ্রান্সকে পুনর্গ গঠিত করতে চেয়েছিল সংবিধান সবার অবদান ও সীমাবদ্ধতা আলোচনা কর

ফ্রান্সের রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণের বিপ্লব সফল হবার পর জাতীয় সভা ফ্রান্সের জন্য একটি নতুন সংবিধান রচনার কাজে হাত দেন । এই উদ্দেশ্যে জাতীয় সভা সংবিধান সভার রূপান্তরিত হয় । জাতীয় সভা সংঘটিত হবার পর একদিকে রাজা ও অভিজাত এবং অন্যদিকে বুর্জোয়া প্রভাবিত জাতীয় সভার মধ্যে ক্রমাগত টানা প্রেরণের রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে গেলে দেশ ব্যাপী পৌর বিপ্লব ও কৃষক অভ্যুত্থানের সূচনা ঘটে ৷ এর ফলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাকে আইন সংগত করার জন্য জাতীয় সভা ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে চৌঠা আগস্টের রাত্রিতে কয়েকটি প্রস্তাব গ্রহণ করেন ৷ যার মধ্যে ছিল দ্বন্দ্ব সমতা,জাতির বিধিগতা,ঐক্যের প্রতিষ্ঠা,সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার ধ্বংস সাধন,অভিজাত আধিপত্যের অবসান রাজস্ব ও চার্চের সংস্কারের সূচনা ইত্যাদি ৷ 


আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন

ফরাসি সংবিধান সভার পরবর্তী উল্লেখযোগ্য ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ২৬ শে আগস্ট "ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকার পত্র" ঘোষণা ৷ এই ঘোষনা পত্রটি রুশোর চিন্তাধারা ইংল্যান্ডের বিল অফ রাইটস আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা পত্র অনুকরণে রচিত হয়েছিল ৷ এই ঘোষণা পত্রে বলা হয় (১).স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার (২). প্রত্যেক মানুষের সমান অধিকার বর্তমান (৩). আইন হলো জনসাধারণের ইচ্ছার প্রতিফলন । এবং আইনের চোখে সকলি সমান। (৪). ঘোষণাপত্রে সমগ্র জাতির অধিকার রক্ষিত হয়। এই ভাবেই ঘোষণাপত্রের স্বীকৃত হলো স্বাধীনতা ও সাম্যের আদর্শ ৷ ঐতিহাসিক লেফেফর বলেছেন এই ঘোষণা পত্র দ্বারা ফ্রান্স তথা ইউরোপের সর্বোচ্চ একটি নবযুগের আগমন বার্তা সূচিত হয় ৷ ঐতিহাসিক ওলার বলেছেন," The declaration was a death certificate of the old regime."

ঘোষণা পত্রটি সংবিধান সবাই গৃহীত হবার পূর্ববর্তী দু বছর আলোচনা ও বিতর্ক শেষে ১৭৯১ সেপ্টেম্বরের রচিত হল ফরাসি জাতির প্রথম লিপিবদ্ধ সংবিধান ৷ নতুন সংবিধানকে নিয়ম তান্ত্রিক রাজতন্ত্র বলা যেতে পারে, সংবিধান সভার দ্বারা জাতির সার্বভৌমত্ব প্রচার করা হলে রাজার ঐশ্বরিক শক্তির বিলোভ ঘটে ৷ নতুনভাবে বলা যায়,"লুই, ঈশ্বরের অনুগ্রহে এবং রাষ্ট্রের সংবিধানিক আইন অনুযায়ী ফরাসি জাতের রাজা ৷"


ফ্রান্স এরপর থেকে শাসনের ক্ষেত্রে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হল ৷ নাগরিকদের সম্পত্তির ভিত্তিতে 'সক্রিয়' ও 'নিষ্ক্রিয়' এই দুই ভাগে ভাগ করে কেবলমাত্র সক্রিয় নাগরিকদের ভোটদানের অধিকার দেওয়া হল ৷ যে সমস্ত লক্ষ লক্ষ নাগরিক পূর্বে স্টেটস জেনারেল সদস্য নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন তারা এর ফলে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হলো ৷


প্রাক স্বাধীনতা সংবাদপত্রে স্বাধীনতা ধর্ম বিশ্বাসের স্বাধীনতা সম্পত্তির ক্রয় বিক্রয় ও ভোগের অধিকার প্রকৃতি হল মানুষের সার্বজনীন অধিকার ৷ জনগণই হলো রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ক্ষমতার অধিকার । সংবিধান সভায় বলা হয় রাজা নিজে মন্ত্রী মন্ডলী নির্বাচন করবেন কিন্তু তার কেউ আইন সভার সদস্য হতে পারবে না ৷ রাজা কার্য নির্বাহ হোক বিভাগ পরিচালনা করবেন না । কিন্তু তিনি আইনের প্রস্তাব করতে পারবেন না । তবে আইন প্রকৃত রাখার জন্য সুপ্রিমিস ভোট বা মূল মুলতবি নামা প্রয়োগের ক্ষমতা রাজাকে দেওয়া হবে। সংবিধান সভা মন্তেস্কুর ক্ষমতা বিভাজন তথ্য অনুযায়ী আইনসভা কে সার্বভৌম ক্ষমতার অর্পণ করে আইন রচনা সরকারি কাজকর্ম সম্পর্কে পর্যালোচনার গুরু দায়িত্ব আইনসভার হাতে ন্যাস্ত থাকে ৷


সংবিধান সভা ফ্রান্সের স্থানীয় শাসনব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের উদ্দেশ্যে সমগ্র দেশকে ৮৩ টি ডিপার্টমেন্ট বা প্রদেশে ভাগ করে ৷ ডিপার্টমেন্ট গুলিকে কতগুলি জেলা এবং জেলাগুলিকে আবার কতগুলি কমিশনে বিভক্ত করা হয় ৷ পুরাতন প্রদেশ গুলিকে সীমারেখা তুলে দিয়ে নতুন শাসনতন্ত্রের বিভাগ অনুযায়ী নতুন সীমারেখা নির্ধারণ করা হয় ৷


সংবিধান সবার বিচার বিভাগেরও আমূল সংস্কার করেছিলেন ৷ ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতি অনুযায়ী বিচার বিভাগের ওপর প্রশাসনের এখন থেকে আর কোন আধিপত্য রইল না ৷ নতুন নীতি অনুযায়ী ফৌজিদারী বিধি তৈরি হয় | এই নবগঠিত বিচার ব্যবস্থায় ব্যক্তির স্বাধীনতা বিশেষভাবে রক্ষিত হয় । এবং দন্ডবিধির সংস্কারে দৈহিক নির্যাতন ও অঙ্গচ্ছেদ ব্যবস্থা রদ করা হয় । সেই সঙ্গে অবাধ গ্রেপ্তার ব্যবস্থা নিষিদ্ধ হয় ৷


মানবিক ও নাগরিক সম্পর্কিত ঘোষণা পত্রে অর্থনীতির কোন উল্লেখ ছিল না । কারণ তখনও পর্যন্ত জনসাধারণ নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির প্রবল সমর্থক ছিল ৷ তবুও সংবিধান সভা কতগুলি অর্থনৈতিক সংস্কার প্রবর্তন করেছিল ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারিতে 'গ্রিল্ড' ও উৎপন্ন দ্রব্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ বিলুপ্ত হয় ৷ অভ্যন্তরীণ শুল্ক প্রাচীর তুলে দেওয়া হয় অবাধ শস্য ব্যবস্থা স্বীকৃত হয় এবং বহু একচেটিয়া ব্যবসা বিলুপ্ত করা হয় ৷ বিভিন্ন প্রকার প্রত্যক্ষ কর যেমন লবণ কর রদ করা হয় ৷


সংবিধান সভা ফরাসি গির্জার ওপর পোপের নিয়ন্ত্রণ লোপ করে জাতীয় গির্জা বা গ্যালিকান গির্জা স্থাপন করেন ৷ "Constitution of the clergy" বা ধর্মযাজকদের সংবিধান দ্বারা ফরাসি গির্জা কে রাষ্ট্রের অধীনস্থ করা হলো ৷ স্থির হয় যে যাজকরা জনসাধারণ কর্তৃক ভোটের দ্বারা নির্বাচিত হবে ৷ অন্যান্য সরকারি কর্মচারীদের ন্যয় তাদেরও বেতনের ব্যবস্থা করা হয় । তাছাড়া ফরাসি সরকারের অর্ধেক সংকট মোচনের জন্য গির্জার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে সেই সম্পত্তির ওপর 'অ্যাসয়নোট' নামক একপ্রকার কাগজের নোট চালু করা হয় ।


  • প্রথমতঃ ফ্রান্সের ইতিহাসের রাজনীতি প্রশাসন ধর্ম অর্থনীতি সব ক্ষেত্রেই সংবিধান সভার কার্যাবলীর অবদান চিরস্মরণীয় ৷ তবে এই সংস্কারের বৈশিষ্ট্য ও ব্যাপকতা ছিল অনেক বেশি । তাই ঐতিহাসিক মাঁদেলা বলেছেন, "ভগবানের পক্ষেও কার্যকরী করা সম্ভব ছিল না ৷" তাছাড়া যত দ্রুত গতিতে পূর্বেকার রাজনৈতিক,সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তি পরিবর্তন করা সম্ভব ছিল, তত দ্রুতগতিতে গঠনমূলক কাজ করতে সংবিধান সভা সমর্থ্য হয়নি ৷
  • দ্বিতীয়তঃ ডেপোটিরা রাজাকে ক্ষমতাহীন করে শাসন বিভাগের দুর্বল করেছিলেন ৷ শাসন বিভাগে আইন বিভাগ হতে সম্পূর্ণ পৃথক করলে শাসন বিভাগ অচল হয়ে পড়ে ৷ এই কারণে ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে সংবিধান সভা বহুদিনের মধ্যেই ভেঙে পড়ে । ঐতিহাসিক মাঁদেলা বলেছেন এই বিরাট সংস্কারগুলি ইউরোপের অদ্বিতীয় হলেও আসলে এগুলি ছিল জীর্ণ ও ভঙ্গুর ‌৷
  • তৃতীয়তঃ রাষ্ট্রের সকল রকম বৈষম্য যেমন সার্ফ প্রথা বৈষম্যমূলক কর ইত্যাদির বিলোপ করে সভা জনগণের কৃতজ্ঞতা লাভ করেছিল ৷ তাছাড়া ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দান করে সবার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অত্যাচারের পথ বন্ধ করে দিয়েছিল ৷ ঠিকই কিন্তু নির্বাচনের ব্যাপারে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্যের দ্বারা গণতন্ত্রের মূলনীতির বিরোধিতা করেছিল সভা ৷ এটিই ছিল সবার অন্যতম ত্রুটি বা দুর্বলতা ৷
  • চতুর্থতঃ এক কক্ষ যুক্ত আইন সভার নানারকম ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল তাই পরবর্তীকালে দুই কক্ষ বিশিষ্ট আইন পরিষদের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল ৷
  • পঞ্চমতঃ ফ্রান্সের অর্থনৈতিক চরম সংকট সমাধানের পথ সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না ৷ সাময়িকভাবে তারা ভূমিকর আয় সম্পত্তির কর শিল্প ইত্যাদি আদায় করেছিল ঠিকই কিন্তু ওই সমস্ত কর ব্যবস্থা ছিল "মরুভূমিতে জল বিন্দুর মত" ৷
  • ষষ্ঠতঃ সংবিধান সভার সদস্যদের আইন রচনার কোন অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রবর্তিত আইনগুলির অধিকাংশই বাস্তবসম্মত ছিল না ৷ ঐতিহাসিক লেভেফর বলেছেন যে,"যেহেতু এই সবাই বুর্জোয়াদের প্রাধান্য ছিল সেহেতু বলা যায় সেখানে নামে মাত্র শাসনতান্ত্রিক রাজতন্ত্র ছিল ৷ কিন্তু বাস্তবে তা ছিল বুর্জোয়া সাধারণতন্ত্র ৷" সুতরাং সংবিধানগত ত্রুটি অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকট ফরাসি জনমতের তীব্র রাজতন্ত্র বিরোধী মনোভাব ইত্যাদির ফলে সংবিধানিক সংস্কার গুলি বাতিল হয়ে যায় ।


সংবিধান সভার কাজে দোষ ত্রুটি থাকলেও আমাদের এই কথা মনে রাখতে হবে যে তাদের সম্মুখে গণতান্ত্রিক সংবিধান গড়ার কোন ঐতিহাসিক নজির ছিল না । ম্যাপ ও কম্পাস ছাড়া জাহাজের ক্যাপ্টেনকে সমুদ্রজাহাজ চালাতে হলে সেরূপ ভুল ভ্রান্তের সম্মুখীন হতে হয় । তেমনি নজর না থাকায় বিপ্লবী সংবিধান রচনায় সংবিধান রচয়িতাদের সেই রূপ ভুল ভ্রান্তি দেখা দেয় ৷


এই সব ত্রুটি বিচ্যুতি সত্ত্বেও এ কথা নির্দ্বিধায় ফরাসি সংবিধান সবার কাজ ফ্রান্সে এক যুগান্তকারী বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল ৷ সংবিধান সভার সমাজতান্ত্রিক বিধি-নিষদের বেড়াজালের নিশ্চিত করে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ৷ এক কথায় ফ্রান্স তথা ফরাসি জাতির নবজন্ম এই সভার অন্যতম কীর্তি ৷ তাই বলা যায়,"রাজনৈতিক সাম্যের আদর্শ অসমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহেশিত মনোভাবের আদর্শ প্রবর্তন করে সংবিধান সভা মহান কাজ করেছিলেন ৷"


.

About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟