মুঘল আমলে বর্ণ ও ধর্ম সম্পর্কে আলোচনা কর অথবা, মুঘল আমলে কৃষক বিদ্রেহে বর্ণ ও ধর্মের ভূমিকা কতদূর কার্যকর ছিল
মুঘল যুগে একাধিক কৃষক বিদ্রোহ গুলির সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা দ্বারা পরিচালিত হয়নি ৷ অতিরিক্ত করভার, শোষণ,বাঁচার জন্য ন্যূনতম সংস্থানের প্রয়োজন স্থানীয় জমিদারদের প্রেরণা ইত্যাদি নানান বিষয়ে মুঘল যুগের কৃষক শ্রেণীকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল ৷ কিন্তু এই বিদ্রোহগুলিকে প্রসারিত করতে বর্ণ বা জাতপাত ও ধর্ম বিশেষভাবে সাহায্য করেছে ৷ অধ্যাপক ইরফান হাবিব দেখিয়েছেন যে,"জমিদারি সত্ত্বা যেভাবে এসেছিল তারই ফলে নানান জাত ও গোষ্ঠীর মধ্যে জমিদারি অধিকারের আঞ্চলিক বিভাগ দেখা দেয় ৷"
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
একই জাতের লোকের দ্বারা বিশেষ বিশেষ অঞ্চল অধিষ্ঠিত হওয়ার একটি প্রবণতা তখনও ছিল ৷ অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকলেও জাতিগত বিশ্বাসে তাদের মধ্যে একটা অদৃষ্ট বন্ধন কাজ করত ৷ জাট বিদ্রোহ, শোভা সিংহের বিদ্রোহ বা কোল বিদ্রোহের বর্ণ ও জাতির মধ্যে ভূমিকা লক্ষ্য করা কষ্টকর নয় | কেরালার প্রখ্যাত মার্কসবাদী গণতান্ত্রিক নেতা ই.এম.এস.নাম্মু তার সাম্প্রতিক প্রবন্ধে বিংশ শতকের কৃষক আন্দোলনে বর্ণ ও জাতি ভূমিকা লক্ষ্য করা যায় ৷ ঐতিহাসিক গৌতম ভদ্রের মতে," সারা মধ্যযুগ ধরেই সামাজিক সম্পর্কের উপর কর্তৃত্ব রেখে জাতের উপর প্রবণতা জমিদারি শ্রেণীর মধ্যেই ছিল এবং এ কাজ তারা বর্ণ ও জাতির মিলন তত্ত্ব প্রচার করে একই বর্ণভুক্ত রাজত্বের সমর্থন আদায় করতেন ৷"
দেশের কোন একটি অংশে কোনো বিশেষজাত বা বর্ণের লোক বিদ্রোহ করলে অন্যান্য অংশের সম বর্ণের লোকেরাও বিদ্রোহীদের সমর্থন করত ৷ বর্ণ বা জাতের বন্ধনে কৃষক বিদ্রোহ গুলিকে সমগোত্রীয় লোকেদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করেছিল ৷ কিন্তু ব্যবসায়িক ভিত্তি আন্দোলন মধ্যযুগের কৃষক আন্দোলনকে অনেকটা সমঝতামূলক ও সীমিত করেছিল । কারণ এই জাতীয় আন্দোলনে অনেক বর্ণের লোকেদেরও যোগ দিতে বাধা দিয়েছে ৷ মুঘল আমলে এক গোষ্ঠী জাতে উঠার চিন্তা করে কায়েমে স্বার্থ খোঁজার চেষ্টা করেছেন ৷
মুঘল যুগে কৃষক বিদ্রোহে বর্ণের মতো ধর্মের অনুরূপ প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায় ৷ মুঘল যুগের সাধারণ কৃষকদের চিন্তায় ধর্মের পরিবর্তে নতুন ধর্ম এবং প্রতিবাদে ধর্মের প্রতি সমাজের অবহেলিত শ্রেণীর আস্থা ছিল বেশ গভীর ৷ ত্রয়োদশ-পঞ্চদশ শতকে গড়ে ওঠে সুফিবাদ,ভক্তিবাদ আন্দোলনে একেশ্বরবাদ অনাড়ম্বরপূজা চেতন চলা এবং সমস্ত রকম জাতের অবসানের তথ্য প্রচার করা ৷ ঐতিহাসিক হাবিবের মতে,"যখন কিছু বৈপ্লবিক চিন্তাধারা যেমন জাতির প্রতি ঘৃণা ও নতুন ও গ্রহণযোগ্য করতে ধর্মবিশ্বাসের অধীনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা জনগণের হৃদয় মনে শিকড় বেঁধে ফেলে তখন সেই গোষ্ঠীগুলি আর তাদের পুরানো মরমিয়া খোলোসের মধ্যে নিজেকে আটকে রাখতে পারেননি ।
অধ্যাপক ইরফান হাবিব মনে করেন যে মুঘল যুগে ভারতীয় কৃষক বিদ্রোহ কোনরূপ শ্রেণি চেতনার দ্বারা উদ্বুদ্ধ ছিল না ৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রে জমিদারদের স্বার্থ ও জমিদারদের নেতৃত্বে এই সকল বিদ্রোহ গড়ে উঠেছিল ৷ শ্রেণী ও চেতনার অভাবে কৃষকদের এই আন্তরিকতা ও মরিয়া প্রয়াস মুঘল সাম্রাজ্যের পর প্রশস্ত করলেন ৷ কৃষকদের আর্থ সামাজিক অবস্থার কোন মৌলিক পরিবর্তন ঘটতে পারেনি ৷
অন্যদিকে ঐতিহাসিক গৌতম ভদ্র মনে করেন যে," সামাজিক বিন্যাস ও শোষণ সম্পর্কে কৃষকরা ও আদৌ সচেতন ছিল না ।" তা নয় তবে মুঘল সরকারের দাবি ও শোষণের এত ব্যাপক ছিল যে তার নির্লজ্জ ও নিষ্ঠুর বহিঃপ্রকাশের সামনে অন্যান্য বিষয়গুলি চাপা পড়ে গেছে । তাই বর্ণ ও জাতিগুলি মুঘল আমলে সংগঠিত কৃষক বিদ্রোহ গুলি অনেকটাই সঞ্চালকের ভূমিকা হিসেবে কাজ করেছে ৷ মার্কসবাদী তত্ত্বের দ্বারা এই সত্য প্রতিষ্ঠিত যে বর্ণ ও জাতি ধর্ম এবং শ্রেণীগত প্রচেষ্টা পরস্পরের পরিপূরক হতে পারে না বরং একটি শক্তি অপর শক্তিকে দুর্বল করে দেয় ।
পরিশেষে বলা যায় সারা মুঘল যুগ ধরেই জমিদার ও কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল ৷ কিন্তু এই বিদ্রোহের কোন মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি ৷ সাধারণত কৃষকদের ওপর শোষণ ছিল অব্যাহত ৷ তবে একটি ক্ষেত্রে কৃষক বিদ্রোহের স্থায়ী রেখে গেছে এবং তা হলো মুঘল সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের পতন ৷ অনেক কারণে কৃষি সংকটকেও মুঘল সাম্রাজ্যের অবক্ষয় ও পতনের জন্য অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে ৷