প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদানরূপে মুদ্রার গুরুত্ব। অথবা,প্রাচীন ইতিহাসের উপাদান হিসাবে মুদ্রার গুরুত্ব আলোচনা কর ?

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় মুদ্রার গুরুত্ব আলোচনা করো।
ইতিহাস হল তথ্যাশ্রয়ী: তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিকগণ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চেষ্টা করেন। ভারতবর্ষের প্রাচীন যুগের ইতিহাস রচনা করা সম্ভব হয় কারণ এদেশে ইতিহাসের সাহিত্যিক উপাদান বিশেষ না থাকলেও প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান। যথেষ্ট রয়েছে। তবে প্রাচীন ভারতের মানুষ ভারতের বুকে তাদের স্মৃতিচিহ্ন রেখে গেছে। সেই স্মৃতিচিহ্নের পথ ধরে ঐতিহাসিকরা একমত হয়েছেন যে, সুদুর অতীতে ভারতীয়দের জীবন কীরকম ছিল, ঐতিহাসিকরা সাধারণত কয়েকটি উৎস থেকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এইগুলির মধ্যে মুদ্রা ইতিহাস রচনার গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদানগুলিকে প্রধানত দুটি ভাগে যথা- (১) সাহিত্যিক ও (২) প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানে ভাগ করা হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলিকে আবার তিনভাগে ভাগ করা হয়। যথা-(ক) লিপি বা লেখ, (খ) মুদ্রা ও (গ) স্থাপত্য ভাস্কর্যে এই প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলির মধ্যে মুদ্রা প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্নির্মাণে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদানগুলির মধ্যে গুরুত্ব বিচারে লেখর পরে মুদ্রার স্থান। এ পর্যন্ত সহস্র মুদ্রা আবিষ্কার হয়েছে। অসংখ্য মুদ্রা অসৎ ও লোভী ব্যক্তিদের হাতে পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। তাসত্ত্বেও প্রাপ্ত মুদ্রা থেকে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের অনেক মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে প্রাচীন মুদ্রা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ঐতিহাসিক তথ্য নিরূপণ করাকে মুদ্রাসংক্রান্ত বিদ্যা বলা হয়। প্রাচীন ভারতে একদা এমন অনেক শাসক ছিলেন যাঁদের অস্তিত্বের কথা কেবলমাত্র মুদ্রা থেকে জানা যায়। মুদ্রা থেকে প্রায় ৩০ জন ব্যাক্ট্রিয় গ্রিক শাসকদের কথা জানা যায়। অথচ অন্যান্য উপাদান থেকে ৫-৬ জনের বেশি জানা যায় না।
সাহিত্য থেকে যে তথ্য পাওয়া যায় তা মুদ্রার সাহায্যে যাচাই করা সম্ভব। তারিখ, সন সম্মিলিত মুদ্রা কাল পরম্পরা নির্ণয়ে সাহায্য করে। মুদ্রা রাজ্যের গুণগত উৎকর্ষ বা অপকর্ষ বলে দেয়। মুদ্রাসংক্রান্ত দেব-দেবীর ছবি রাজকীয় ধর্মের সাক্ষ্য বহন করে। মুদ্রায় প্রাপ্ত স্থানগুলি দুদিক থেকে সাহায্য করে, যথা
প্রথমত, এই মুদ্রা থেকে এক অঞ্চল তথা এক দেশ থেকে অপর দেশের বাণিজ্যের কথা জানতে পারি।দ্বিতীয়ত, মুদ্রা থেকে কোনো রাজ্যের আয়তন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। প্রাচীন যুগের মানুষ মুদ্রা জমা রাখত মাটি বা ধাতুর তৈরি পাত্রে। ভূগর্ভ খননের ফলে এরূপ অনেক মৃৎপাত্র এবং ধাতুর পাত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। বহির্ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ভারতীয় মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গেঙ্গ ভারতের মুদ্রা বিনিময়ের সঙ্গে ভারতের ব্যবসায়িক আদান-প্রদান চলত।
ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে বহির্ভারতের প্রভাব নিরূপণে মুদ্রাসংক্রান্তবিদ্যা বিশেষ সহায়ক। মুদ্রা প্রচলনের প্রথম যুগে মুদ্রাতে কিছু লেখা থাকতো না। গ্রিক আক্রমণের পর থেকে ভারতীয় মুদ্রার উৎকর্ষতা পরিলক্ষিত হয় এবং সেখানে রাজ্যের নাম খোদাই দেখা যায়। ব্যাষ্ট্রিয় গ্রিকরা সর্বপ্রথম এই ধরনের উল্লেখযোগ্য মুদ্রার প্রচলন করেন। শক ও পহ্লবরা গ্রিক মুদ্রার অনুকরণ করেন। এগুলি থেকে রাজতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রশাসিত রাজ্য সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যায়। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর মুদ্রার গুরুত্ব ক্রমশ হ্রাস পায়। হর্ষবর্ধনের কিংবা পাল, প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট বংশের মুদ্রা নিতান্ত কিঞ্চিৎকর, তা সত্ত্বেও কোনো কোনো অঞ্চলে নতুন মুদ্রা প্রচলিত হয়েছিল। অর্থনৈতিক দিক থেকে গুপ্তযুগ তার প্রমাণ। এই আমলে সর্বাপেক্ষা বেশি স্বর্ণমুদ্রা প্রচলিত ছিল। কুষাণ স্বর্ণমুদ্রা সে যুগের আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রমাণ দেয়।
সাম্প্রতিক কালের প্রাচীন নিদর্শনগুলিকে ইতিহাস রচনায় আরও ব্যাপকভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে। ডি. ডি. কৌশাম্বিসহ কয়েকজন পণ্ডিত ইতিহাস রচনার বিভিন্ন যুগে এমনকি প্রাক্ ও ঐতিহাসিক যুগের মানুষের ব্যবহৃত উপাদানে হাতিয়ারগুলির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সাম্প্রতিক পদার্থবিজ্ঞানের সাহায্যে প্রত্নতত্ত্ববিদরা ভূগর্ভ থেকে তোলা কোনো নিদর্শনের প্রাচীনত্ব নির্ণয় করে থাকেন। প্রাচীন নিদর্শন থেকে ঐতিহাসিক তত্ত্ব নিরূপণে প্রত্নতত্ত্ববিদদের সঙ্গে সঙ্গে নৃতত্ত্ববিদরাও নানাভাবে সাহায্য করে থাকে।
প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের বিভিন্ন দিকগুলির আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, অন্যান্য লিখিত উপাদান অপেক্ষা এগুলি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অনুলিপি ভাষ্যরচনাকালে লিখিত উপাদান অনিচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানে পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই। তবে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় মুদ্রাগুলি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে যথেষ্ট সাহায্য করেছে।
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
ইতিহাসের উপাদান হিসেবে মুদ্রার গুরুত্ব কী ছিল?
প্রাচীন যুগের ইতিহাস জানতে গেলে আমাদের প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের ওপর নির্ভর করতে হয় । তাই প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান হিসেবে মুদ্রার গুরুত্ব অপরিসীম। যথা-
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
মুদ্রা থেকে জানা যায় প্রাচীন রাজাদের নাম ও তাঁদের রাজত্বকাল সম্বন্ধে । যেমন- কনিষ্কের মুদ্রা প্রমাণ করে যে,তিনি ৭৮ অব্দে সিংহাসনে বসেন । মুদ্রা প্রাচীন রাজন্যবর্গের শৌর্য-বীর্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কারণ মুদ্রা থেকেই বিভিন্ন রাজার বিভিন্ন উপাধি ধারণের কথা জানা যায় । যেমন- সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রায় পাওয়া যায় 'বিক্রমাঙ্ক' শব্দটি ।
মুদ্রা থেকে জানা যায় প্রাচীন রাজাদের রাজধর্ম সম্পর্কে । যেমন-গুপ্তরাজ্যনের মূদ্রায় প্রাপ্ত লক্ষ্মীদেবীর প্রতিকৃতি, কুষাণ রাজাদের মুদ্রায় মহেশ্বরের মূর্তি প্রমাণ করে যে, সেযুগে বৈষ্নবধর্ম ও শৈবধর্ম প্রচলিত ছিল ।
দক্ষিণ ভারতে যে রোমান মুদ্রাগুলি পাওয়া গিয়েছে তা প্রাচীন রোম-ভারত বাণিজ্যের সাক্ষ্য বহন করে । মুদ্রা থেকে বিভিন্ন সময়ের অর্থনীতির পরিচয় পাওয়া যায় । যেমন-স্কন্দগুপ্তের খাদমিশ্রিত স্বর্ণমুদ্রাগুলি তাঁর আমলের ভাঙ্গুর গুপ্ত অর্থনীতির কথা জানিয়ে দেয়।
মুদ্রা সমকালীন ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক জীবনের ওপর বিশেষভাবে আলোকপাত করে । সমুদ্রগুপ্তের বীণাবাদনরত মুদ্রা থেকে তাঁর সংগীতানুরাগের পরিচয় পাওয়া যায় । তাই এই কথ্য সহজেই বলা যায় বিশেষত কোন্যে যুগের রাজাদের শাসনকাল ও অর্থনীতির আলোচনা করতে গেলে মুদ্রাকে কখনো অস্বীকার করা যায় না ৷