ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রতিক্রিয়া মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য কতদূর দায়ী ছিল

ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রতিক্রিয়া মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য কতদূর দায়ী ছিল

ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রতিক্রিয়া মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য কতদূর দায়ী ছিল

ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রতিক্রিয়া মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য কতদূর দায়ী ছিল


তুমি কী মনে করো, ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রতিক্রিয়া মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল? 


উত্তর। প্রকৃতির অবশ্যজাবী পরিণতিস্বরূপ মৌর্য সাম্রাজ্যও ভারতের বুকে বিচ্ছিন্নতার অবসানে ঐক্যবন্ধ ভারত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন জাগিয়ে বিস্মৃতির অতলে, তলিয়ে গিয়েছে। আনুমানিক ১৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পুযামিত্র শুঙ্গা শেষ মৌর্যসম্রাট বৃহদ্রথকে হত্যা করে শুঙ্গ শাসনের প্রবর্তন করলে ভারতের মৌর্য শাসনের অবসান ঘটে। হিন্দুকুশ পর্বতের পাদদেশ থেকে দক্ষিণে পেনার নদী পর্যন্ত বিস্তৃত মৌর্য সাম্রাজ্য অশোকের মৃত্যুর ৫০ বছরের মধ্যেই ভুলিসাৎ হয়ে যায়। মৌর্য শাসনের অবসানে শৃঙ্গ শাসনের প্রতিষ্ঠা ঘটে। ঐতিহাসিকরা মৌর্য শাসনেয় এরূপ দ্রুত পতন ও অবক্ষয়ের কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন ও বিভিন্ন ঐতিহাসিক এ বিষয়ে বিভিন্ন মত প্রদান করেছেন।

পণ্ডিতপ্রব্যর মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে একটি প্রবন্ধে তিনি লেখেন যে, মৌর্য সাম্রাজ্যের মূল ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছিল রাজশক্তির প্রতি ব্রাহ্মণদের তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষজনিত কারণে। এই অসন্তোষ থেকে সৃষ্টি হয়েছিল এক ব্রাহ্মণ বিপ্লব। এরই ফলে বিশালায়তন মৌর্য সাম্রাজ্য ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। ব্রাহ্মণ শ্রেণির মধ্যে এই ক্ষোভ ও অসন্তোষ তৈরি হবার কারণ হিসেবে তিনি অশোকের বিভিন্ন নীতিকেই দায়ী করেছেন।

অধ্যাপক শাস্ত্রী মনে করে যে, অশোকের নীতি ছিল বৌদ্ধদের অনুরাগী ও ব্রাহ্মণদের বিরোধী। এক্ষেত্রে তিনি যুক্তি দেখান যে, মৌর্যরা ছিলেন শূদ্র বংশজাত। সর্বশ্রেষ্ঠ মৌর্যসম্রাট অশোক যুদ্ধনীতি ত্যাগ করে ধর্মবিজয় নীতি গ্রহণ করেন এবং এই কাজকে সফলতা দানের জন্য তিনি কিছু সুনির্দিষ্ট নীতি নেন। তাঁর পঞ্চম মুখ্য স্তন্তশাসন (রামপূর্বা) থেকে জানা যায় যে, অশোক পশুবলির বিরোধীতা করেছিলেন। যা ব্রাহ্মণদের স্বার্থে আঘাত হানে, কারণ এরফলে তাঁদের আয়ের একটা বড়ো উৎস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যেহেতু অশোকের মতো একজন শূদ্রশাসক পশুবলির ন্যায় অতিপ্রচলিত রীতিবিরোধী বিধান জারি করেছিলেন সেহেতু ব্রাহ্মণদের অসন্তোষ আরো প্রকট হয়। অধ্যাপক শাস্ত্রীমহাশয় ব্রাহ্মণশ্রেণির ক্ষোভের কারণ হিসেবে অশোকের ক্ষুদ্র গিরিশাসনের একটি অংশের উল্লেখ করেছেন, যেখানে বলা হয়েছে "এতদিন যাঁদের (ব্রাহ্মণদের) ভূদেব বলে গণ্য করা হত। তিনি (অশোক) তাদের মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছেন।"

এছাড়াও হরপ্রসাদ শাস্ত্রীমহাশয় অশোকের চতুর্থ স্তন্তশাসনে উল্লেখিত "দণ্ডসমতা" ও "ব্যাহারসমতা" নীতি প্রয়োগের ওপর জোর দিয়েছেন। এই দুটি শব্দের প্রয়োগের ভিত্তিতে। তিনি মনে করেন যে, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে অশোক বিচার ও শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে সমভাবিধানের নীতি গ্রহণ করেছিলেন। অশোকের আগে ব্রাহ্মণরা এই দুটি বিষয়ে কিছু বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন। কিন্তু অশোকের সমতাবিধানের নতুন নীতি ওই বিশেষ সুযোগ-সুবিধাগুলির ওপর আঘাত হানে। অশোকের আমলে ধর্মমহামাত্র নামক এক নতুন কর্মচারী পদের উদ্ভব ঘটে যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে ব্রাহ্মণদের অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করেছিল। এরফলে ব্রাহ্মণরা সান্ডাজ্যের স্থিতিশীলতার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে।

দীর্ঘদিন ধরে সুযোগ-সুবিধা ভোগকারী ব্রাহ্মণরা অশোকের আমলে সেগুলি থেকে বদিত হওয়ায় তাঁর শাসনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। অশোকের মৃত্যুর পর কেন্দ্রীয় 
শাসনের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়লে ব্রাহ্মণরা তাঁর উত্তরসূরিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। আনুমানিক ১৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পুষ্যমিত্র শুভা নানে এক ব্রাহ্মণ শেষ মৌর্যশাসক বৃহদ্রথার হত্যা করে মৌর্যবংশের পতন ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেন। অধ্যাপক হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মত অনুযায়ী বলা যায় যে, "এই মহান বিপ্লবের পিছনে ব্রাহ্মণদের হাত ছিল।"

অধ্যাপক শাস্ত্রী প্রদত্ত ব্রাহ্মন বিপ্লবের তত্ত্বটিকে উপযুদ্ধ প্রমাণসহ খণ্ডন করেছেন।। ঐতিহাসিক হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী তাঁর "Political History of Ancient India" প্রদে বলেছেন যে, অশোকের পশুবলি নিষিদ্ধ আইন ব্রাহ্মণদের ক্ষতি করেনি। কারণ এই আইনটি পূর্বেও প্রচলিত ছিল। এছাড়া শ্রুতিসাহিত্য থেকে জানা যায়, ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ও ধীরে ধীরে অহিংসা নীতিতে বিশ্বাসী হয়েছিলেন। "ব্যবহার সমতা" ও "দণ্ডসমতা" ব্রাহ্মণদের ক্ষুদ্ধ পলি করেনি। কারণ এই আইনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল রাজুকদের বিচার ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা।

ধর্মমহামাত্র প্রসঙ্গে ড. রায়চৌধুরীর অভিমত হল, এই শ্রেণির কর্মচারীর ধর্মপ্রচারই একমাত্র কাজ ছিল না। এঁরা শাসনসংক্রান্ত কাজও করতেন। এঁরা যে কেবল অব্রাহ্মণদের মজা মধ্যে থেকে নিযুক্ত হতেন এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই এঁদের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণদের তরি ক্ষোভের যুক্তি মানা যায় না। অশোকের মৃত্যুর পর ব্রাহ্মণগণ তাঁর উত্তরাধিকারীদের পশ্চা বিরোধীতা করেছিলেন, অধ্যাপক শাস্ত্রীর এই যুক্তিও ড. রায়চৌধুরী অস্বীকার করেন। তাঁর মতে, "রাজতরঙ্গিণী" থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, মৌর্যরাজ জলৌকার সঙ্গো ব্রাহ্মণদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ্য বিপ্লবকেই একমাত্র কারণ হিসেবে দায়ী করা যায় না। কেননা ব্রাহ্মণ্য বিপ্লবের বহু পূর্ব থেকেই মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্নিহিত শল্পি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। শুধুমাত্র ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ওপর দাঁড়িয়েছিল বিশাল এই সান্ডাজের কাজ স্থায়িত্ব, কিন্তু অশোকের মৃত্যুর পর দুর্বল উত্তরাধিকারীদের আমলে সাম্রাজ্যের শক্ত মুঠি শে শিথিল হয়ে পড়ে। প্রদেশে অত্যাচারী অমাতাদের শাসন ও পতনের ভূমিকা পালন ভা করেছিল। এছাড়াও সাম্রাজ্যের অন্তিম পর্বে চরম অর্থসংকট, উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের অরক্ষিত এলাকা দিয়ে ব্যাকট্রিয় গ্রিকদের ভারতে অনুপ্রবেশ প্রভৃতি কারণে মৌর্য সাম্রাজ দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এই পরিস্থিতিতে ব্রাহ্মণ্য বিপ্লব মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনকে ত্বরান্বিত করে মাত্র।



About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟