দাঁতাতের রাজনীতি বলতে কী বোঝ? ইহা কেন ব্যর্থ হয়?
দাঁতাত একটি ফরাসি শব্দ যার অর্থ 'উত্তেজনা প্রশমন'। ১৯৬০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক পারস্পরিক সহাবস্থান নীতি গৃহীত হয়েছিল। এর ফলে ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রভাব বহুলাংশে হ্রাস পায়। এই নীতিই দাঁতাত নামে পরিচিত। দাঁতাতের কূটনীতির প্রথম প্রয়োগ করেন সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী নিকিতা ক্রুশ্চেভ। আসলে বিংশ শতকের শেষের দিকে কিছু অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ঘটনা সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকা যুক্তবাষ্ট্র দুই দেশকেই কাছাকাছি নিয়ে আসে। ফলে তাঁরা দাঁতাতের প্রতি আগ্রহ দেখায়।
দাঁতাত রাজনীতির উদ্ভবের কারণঃ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অবস্থা দাঁতাতের পথ প্রশস্ত করেছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতি মার্কিনবাসীর বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষা করে ও ভিয়েতনাম থেকে সেনা প্রত্যাহারের দাবি মেনে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত রাশিয়া ও চিনের সাথে দাঁতাতের পথ বেছে নেয়। ইউরোপের বহু দেশ যুদ্ধের ধাক্কা কাটিয়ে নিজ নিজ অর্থনীতিকে মজবুত করার প্রচেষ্টা নিলে অর্থলগ্নী ও পুজির রপ্তানির পরিমাণ কমে যায়। ফলস্বরূপ মার্কিন অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিলে তা চাঙ্গা করার জন্য নতুন নতুন বাজারের প্রয়োজন দেখা দেয়। বেছে বেছে পুঁজিবাদী দেশগুলিতে বাণিজ্যিক লেনদেন নীতি গুরুত্ব হারায়। ফলে দাঁতাতের পরিবেশ তৈরী হয়।
ভারতের নেতৃত্বে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি একে একে জোট-নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করায় ঠান্ডা লড়াইয়ের তীব্রতা হ্রাস পায় ও দাঁতাতের পথ খুলে যায়। ইউরোপের বহু দেশ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে পুঁজি বিনিয়োগ করতে চাইলে আমেরিকা বাধ্য হয় দাঁতাতের রাস্তায় যেতে। পূর্ব ইউরোপের বেশকিছু দেশ আর সোভিয়েত রাশিয়ার কর্তৃত্ব মানতে রাজি ছিল না। অর্থনৈতিক উন্নতির লক্ষ্যে এইসব দেশ পশ্চিমি রাষ্ট্রগুলির সাথে বাণিজ্যিক লেনদেনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এ ছাড়াও পোল্যান্ড, হাঙ্গেরী, চেকোশ্লোভাকিয়া, রুমানিয়ায় সাম্যবাদ সংকটের মুখে পড়ে। ফলে সোভিয়েত রাশিয়া দাঁতাত প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে বাধ্য হয়।
১৯৬০ খ্রিঃ পর থেকে সোভিয়েত অর্থনীতি সংকটের মুখোমুখি হয়। ১৯৫০ খ্রিঃ সোভিয়েতের মোট জাতীয় উৎপাদন যেখানে শতকরা ৬ ভাগ বৃদ্ধি পায় সেখানে ১৯৬০ খ্রিঃ তা কমে শতকরা ৪ ভাগে দাঁড়ায়। এই অর্থনৈতিক সংকট রাশিয়াকে পশ্চিমি দেশগুলির সাথে বাণিজ্যিক লেনদেন ও অর্থনৈতিক আদানপ্রদানে উৎসাহিত করেছিল। ফলে নাঁতাত প্রক্রিয়ার পটভূমি রচিত হয়েছিল।
দাঁতাত প্রক্রিয়া দ্রুত প্রসার লাভ করলেও এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণভাবে সফল হয়নি। পারস্পরিক অবিশ্বাস দাঁতাত পক্রিয়াকে ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দিয়েছিল। এই নীতি বার্ধ হওয়ার কারণগুলি হল-
প্রথমতঃ দাঁতাতের উদ্দেশ্য ছিল উত্তেজনা প্রশমন করে বিশ্বশান্তি ফিরিয়ে আনা। এই উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন বিভিন্ন চুক্তিতেও স্বাক্ষর করলেও উভয় দেশই গোপনে নিজেদের সামরিক বিশেষত পারমাণবিক শক্তিকে আরজ শক্তিশালী করে তুলতে সচেষ্ট ছিল।
দ্বিতীয়তঃ আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয় দেশের মধ্যে বিদ্যমান আর্থিক কাঠামোয় যে বিশাল ব্যবধান ছিল তার ফলে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সেরূপ কোনো শক্তি- শালী যোগাযোগ স্থাপিত হয় নি। এছাড়া পরিকাঠামোগত ত্রুটিও এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছিল।
তৃতীয়তঃ ১৯৮০-এর দশকের শুরু থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি এই দুই দেশকে দাঁতাতের রাজনীতির কথা ভুলে গিয়ে আবার ঠান্ডা লড়াইয়ের আবর্তে জড়িয়ে ফেলে। এরূপ ঘটনাবলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ক) দোলায় গৃহযুদ্ধে সোভিয়েত হস্তক্ষেপ, খ) আফগানিস্তানের ওপর সোভিয়েতের সামরিক হস্তক্ষেপ, গ) ইথিওপিয়া ও সোমালিয়াকে কেন্দ্র করে উভয়পক্ষে বিরোধ, ঘ) মার্কিন রাষ্ট্রপতি রোনান্ড রেগনের নতুন বিদেশনীতি।
চতুর্থতঃ দুই দেশের মধ্যে বিলামান মতাদর্শগত সংযাত সাময়িকভাবে স্থগিত থাকলেও পরবর্তীকালে উভয় দেশের নতুন নতুন রাষ্ট্র প্রধানদের আগমনে সহাবস্থানের সেই পরিবেশ ক্রমে হ্রাস পেতে থাকে।
পঞ্চমতঃ সম্পূর্ণ দাঁতআত প্রক্রিয়াটি ছিল প্রকৃতপক্ষে একটি লোকদেখানো বিষয়। বস্তুত দুই দেশই আন্তরিকভাবে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের পক্ষে ছিল না, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা অপেক্ষা নিজ স্বার্থসিদ্ধি করাই ছিল তাদের প্রধান লক্ষ্য।