কোল বিদ্রোহ সম্পর্কে আলোচনা করো ও কোল বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো
ইংরেজ ঐতিহাসিক মিল্ ও থর্নটন (Thornton)-এর
মতে ব্রিটিশ শাসনের আওতা থেকে প্রজাদের এক বিরাট অংশের সরে যাওয়ার এক প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হল কোল আদিবাসীদের প্রয়াস। আধুনিক সভ্যতার পরিবর্তে জঙ্গলের সভ্যতাই ছিল তাদের পছন্দ। এর প্রধান কারণ ছিল কোম্পানির প্রবর্তিত নূতন শাসনব্যবস্থা। দীর্ঘ মুসলিম শাসনের প্রভাব থেকে তারা ছিল মুক্ত। অষ্টাদশ শতকে ছোটনাগপুর ও ময়ূরভঞ্জের রাজারাও কোলদের ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। সিংহভূমের ওপর মোগলদের শাসনও কখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি এবং বহু প্রাচীন কাল থেকেই সর্দাররাই স্বাধীনতা ভোগ করে আসছিল। কিন্তু ইংরেজরা সিংহভূম দখল করলে আদিবাসীদের মধ্যে সন্ত্রাস ও ভয়ের সঞ্চার হয় যার ফলশ্রুতি হল ১৮৩১-৩২ খ্রীষ্টাব্দের কোল-বিদ্রোহ। সিংহভূমের রাজা পোরাহাটের রাজা বলেই সুপরিচিত ছিলেন। তিনি সিংহভূমে ইংরেজদের অনুপ্রবেশের সব চেষ্টা প্রতিহত করেন। তাঁর কোলজাতীয় প্রজাদের 'হোস' বলা হত। এই 'হোস' (কোলজাতির অন্তর্ভুক্ত) প্রজারা সিংহভূমের সীমান্তে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। শেষপর্যন্ত সিংহভূমের রাজা ইংরেজদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন এবং ইংরেজ সরকারকে বাৎসরিক কর দিতে রাজী হন। অনেকে মনে করেন যে সিংহভূমের রাজার আত্মসমর্পণের উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজদের সাহায্যে তাঁর অবাধ্য 'হোস' প্রজাদের দমন করা। এর পূর্বে সিংহভূমের রাজারা যখনি হোস-দের দমন করার চেষ্টা করতেন তখনি তারা তা বানচাল করে দিত। যাইহোক হোসরা ইংরেজদের শাসন মেনে নিতে পারল না। সিংহভূমের রাজার সহযোগিতায় ইংরাজরা দমননীতির আশ্রয় নিলে হোসরা অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ও ইংরেজদের বাধা দেয়। ফলে ১৮২৭ খ্রীষ্টাব্দে ইংরাজদের সঙ্গে হোসদের সংঘর্ষ বেধে যায়। ইংরাজ সেনারা হোসদের গ্রামে গ্রামে ঢুকে ঘর-বাড়ী জ্বালিয়ে দেয় ও বহু হোসকে হত্যা করে। এই অবস্থায় হোসরা ইংরেজ সরকারের সঙ্গে একটা চুক্তি করে। এই চুক্তির শর্ত অনুসারে (১) হোসরা ইংরেজদের প্রভুত্ব মেনে নেয়; (২) সিংহভূমের জমিদার বা সর্দারকে খাজনা দিতে রাজী হয় এবং (৩) জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংঘর্ষের পথে যাওয়ার পরিবর্তে সরকারের কাছে অভিযোগ জানাবার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু বাস্তবে হোসদের ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি এবং তারাও যেখানে-সেখানে লুঠতরাজ চালিয়ে যেতে থাকে। এর ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের সর্বত্র ঘোর অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এক ব্যাপক সংঘর্ষের পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ১৮২৯ খ্রীষ্টাব্দের শেষের দিকে সম্বলপুরে আদিবাসী বিক্ষোভশুরু হয় এবং ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দে ছোটনাগপুরের আদিবাসী 'মুণ্ডারা' বিদ্রোহী হলে হোসরা তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে বিদ্রোহী হয়।
সাধারণভাবে কোল-বিদ্রোহ বলে পরিচিত বিদ্রোহের মূলে ছিল কৃষি-অসন্তোষ। অন্যান্য আদিম জাতিগুলির মতো হোস বা কোলরাও ছিল কৃষিজীবী। কয়েকটি গ্রামকে সংঘবদ্ধ করে এক একটি 'পুস' (Pus) বা গোষ্ঠী তৈরী করা হত এবং প্রতিটি গোষ্ঠীর একজন সর্দার থাকত যাকে বলা হত 'মানকী' (Manki)। সর্দারদের অধীনে হোস বা কোলরা চাষ আবাদ করত ও ফসল নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিত। সর্দার গোষ্ঠীর খাজনা জমিদার বা সরকারকে দিত। সর্দাররাই গোষ্ঠীর প্রশাসন ও শান্তি-শৃঙ্খলার তত্ত্বাবধান করত। বহুকাল ধরে এই রীতি চলে আসছিল। কিন্তু কোম্পানির শাসন শুরু হলে কোলদের গ্রামীণ সংঘগুলি ক্রমেই ভেঙ্গে পড়ে। তাদের জমি-জায়গা অন্য অঞ্চল থেকে বিশেষ করে বাংলা ও বিহার থেকে আসা মানুষদের কাছে বন্দোবস্ত করা হলে জমি-জায়গা কোলদের হাতছাড়া হয়ে যায়।। এছাড়া বাংলার ইংরাজ সরকারের রাজস্বনীতি ও বিচারপদ্ধতি কোল তথা অন্যান্য আদিম জাতিগুলির মধ্যে গভীর অসন্তোষ ও বিক্ষোভের সঞ্চার করে। শেষপর্যন্ত কোলরা বিদ্রোহী হয়ে রাঁচী, হাজারিবাগ, মানভূম প্রভৃতি অঞ্চলে ব্যাপক লুঠতরাজে প্রবৃত্ত হয় এবং বহিরাগত জমিদার, জোতদার ও সরকারী কর্মচারিদের ঘর-বাড়ী জ্বালিয়ে দেয়। এক হিসাব অনুসারে কয়েক হাজার মানুষ কোলদের আক্রমণের শিকার হয়। দুমাস ধরে কোলদের তাণ্ডব চলে এবং শেষে এক বিশাল সেনাবাহিনীর সাহায্যে কোল-বিদ্রোহ দমন করা হয় (১৮৩২ খ্রীঃ)।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ কোল বিদ্রোহ সম্পর্কে আলোচনা করো ও কোল বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো এই নোটটি পড়ার জন্য