দ্বিতীয় পর্যায়ের নগরায়ন সম্পর্কে আলোচনা কর
দ্বিতীয় নগরায়ণ বলতে কী বোঝায়?
তের মহাজনপদের অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায় বৌদ্ধগ্রন্থ 'অভাত্তর নিকায়' ও জৈনগ্রন্থ উত্তর। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে প্রধানত উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ১৬টি 'ভগবতীসূত্র' থেকে। মহাজনপদগুলির মধ্যে সংঘর্ষের এই পর্বে জটিল রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিকাশের পাশাপাশি উত্তর ভারতেই প্রধানত মধ্য গঙ্গা উপত্যকায় বেশ কিছু নগরের উদ্ভব ঘটে। অর্থাৎ, উত্তর ভারতীয় রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পাশাপাশি সমকালীন যুগেই নগরায়ণের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। বলা বাহুল্য এই দুটি প্রক্রিয়া একটি বৃদ্ধ অপরটির পরিপুরক। এই পর্বের নগরায়ণের সময়কাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ পর্যন্ত। উল্লেখ প্রাচীন ভারতের প্রথম নগরায়ণ দেখা গিয়েছিল হরপ্পা সভ্যতায় আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০-১৭৫০ কালসীমায়। তাই এর সহস্রাধিক বছর পরে ভারতীয় উপমহাদেশের নগরায়ণের এই ধারাকে 'দ্বিতীয় নগরায়ণ' বলে ঐতিহাসিকরা অনেকে বিবেচনা করে থাকেন।
নগরায়ণ বলতে বোঝায় শহরভিত্তিক এলাকা, তাই নগরগুলি যে-কোনো গ্রামীণ অঞ্চলের তুলনায় আয়তনে বড়ো। গ্রামের তুলনায় নগরের জনসংখ্যা ও জনবসতির ঘনত্ব বেশি হওয়ায় যুক্তিযুক্ত, যদিও এর প্রত্যক্ষ পরিসংখ্যান প্রাচীন ভারতের ক্ষেত্রে নেই। নগরে প্রধানত রাজা, প্রশাসক, বণিক, কারিগর এবং পেশাদারি গোষ্ঠীগুলির বাস ছিল। এরা তুলনা কেউ সরাসরি খাদ্য উৎপাদন করতো না। নগরের অর্থনীতি, কৃষি অর্থনীতি, বহির্ভূত ক্ষেত্রকে আশ্রয় করেই গড়ে ওঠে। কিন্তু নগরে যদি নিয়মিত খাদ্য যোগানের ব্যবস্থা না থাকে তাহলে নগরের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। অতএব কেবলমাত্র বাণিজ্যের অগ্রগতি ও করিগরি শিল্পের উন্নয়ন ঘটলেই নগর গড়ে উঠবে একথা সঠিক নয়। নগরায়ণের অন্যতম প্রাথমিক শর্ত হল যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করা । এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া এবং সহজসাধ্য নয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই সমস্ত বাধা কাটিয়ে মধ্যগঙ্গা উপত্যকায় কিছু নগরের যেমন-শ্রাবস্তী, চম্পা, রাজগৃহ, অযোধ্যা, কৌশাম্বি ও কাশী প্রভৃতির উদ্ভব ঘটে যা বৌদ্ধ ও জৈনসাহিত্য থেকে জানা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে প্রথম সারির নগরগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বর্তমান উত্তরপ্রদেশ অঞ্চলে অবস্থিত কৌশাম্বী। এখানে খননকার্যের ফলে ৬১ কিমি পরিসীমাবিশিষ্ট একটি বিশালায়তন প্রাচীর আবিষ্কৃত হয়েছে। এর পরবর্তী পর্যায়ে সেখানে উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্রের সন্ধান মিলেছে। আলোচ্য পর্বের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ নগর হল বারাণসী। এখানে খননকার্যের ফলে বৃহদাকার প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে যা সেখানে নগরের স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। উত্তরপ্রদেশের অতিভিখেড়ায় খননকার্যের ফলে আলোচ্য পর্বের নগরের নিদর্শন মিলেছে। মধ্যগঙ্গা উপত্যকায় আর একটি গুরুত্বপূর্ণ নগর হল রাজগৃহ। এটি ছিল বিশাল প্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত। এই প্রাচীর তৈরিতে কাদামাটির পরিবর্তে পাথরের ব্যবহার হয়। এইভাবে দেখা যাচ্ছে হরপ্পার সভ্যতার ধ্বংসের প্রায় ১০০০ বছর পর ভারতবর্ষে আবার নগরায়ণের আবির্ভাব ঘটল। তবে ভৌগোলিক দিক থেকে উভয় নগরায়ণের কেন্দ্র ছিল আলাদা।ওপরের আলোচনা থেকে বোঝা সম্ভব হয়েছে যে, পূর্ব উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে সমভূমি সমন্বিত মধ্যগাঙ্গেয় অঞ্চলেই প্রধানত দ্বিতীয় পর্বের নগরায়ণের উদ্ভব ঘটে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।