সোলোনের সংস্কার সম্পর্কে আলোচনা কর
প্রাচীন গ্রিক পলিসগুলির মধ্যে এথেন্স নামকরণ হয়েছিল দেবী অ্যাথেনার নাম থেকে । দক্ষিণপূর্ব গ্রিসের অ্যাটিকা অঞ্চলে ছিল এথেন্স । অ্যাটিকায় এথেন্স ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নগররাষ্ট্র, যদিও বাণিজ্যিক ও সামরিক ক্ষেত্রে এথেন্স অন্ধকার যুগে করিস্থ ও স্পার্টার তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে ছিল । এথেন্সের অর্থনীতি ছিল পুরোপুরি কৃষিভিত্তিক এবং সেখানে একটা প্রভাবশালী ভূস্বামী অভিজাততন্ত্র গড়ে ওঠে । সরকারি ক্ষমতা অপব্যবহার করে অভিজাত ভূস্বামীরা উর্বর কৃষিজমির ওপর একচেটিয়া মালিকানা অর্জন করে এবং কৃষকদের জমি থেকে উৎখাত করে । অপসৃত কৃষকেরা প্রান্তিক এলাকায় বসতি স্থাপন করে অভিজাতদের জমিতে চাষবাস করতে শুরু করে। অর্থনৈতিক বৈষম্য তীব্র আর্থিক সংকটের জন্ম দেয় । দারিদ্র্যক্লিষ্ট সাধারণ চাষিরা মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হত । অনেকেই ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়ে দাসে পরিণত হত । কৃষকদের অবস্থার ক্রমাবনতি ও তাদের অসহনীয় দারিদ্র্য সামাজিক উত্তেজনার জন্ম দিয়েছিল । ৬২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ ড্রাকন নামে এক অভিজাত কৃষক বিদ্রোহ দমন করার উদ্দেশ্যে কতকগুলি কঠোর জনবিরোধী আইন প্রণয়ন করেন। কিন্তু জনবিরোধী কঠোর আইন বলবৎ করেও সামাজিক উত্তেজনা হ্রাস করা সম্ভব হয়নি এথেন্সে গৃহযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। তখন বাধ্য হয়ে এথেনীয় অভিজাততন্ত্র সংস্কার সাধনের পথে অগ্রসর হয়।
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
এই প্রেক্ষাপটে ৫৯৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সোলোনকে এক বছরের জন্য পূর্ণ ক্ষমতা দিয়ে আর্কন পদে নিযুক্ত করা হয়। সামাজিক সংঘাত ও হিংসা প্রশমনের দায়িত্ব তার ওপর অর্পিত হয়। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য তার হাতে আইন প্রণয়নের বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয় । সোলোনের কর্তব্য ছিল পরস্পর বিরোধী শ্রেণি স্বার্থের মধ্যে সমন্বয় সাধন । সোলোন ছিলেন উদার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন, সে যুগের আর পাঁচজন শিক্ষিত মানুষের মতো সোলোনও ছিলেন একজন কবি ।
ক্ষমতায় আসার পর সোলোন লক্ষ করলেন যে এথেন্সে ঘটমান সামাজিক উত্তেজনা ও সংঘাতের মূল কারণ মধ্যে নিহিত । সে সময় প্রধান দাবি ছিল জমির কৃষকদের ক্ষোভের এথেনীয় কৃষকদের পুনর্বণ্টন ও ঋণ বাতিল করা । কৃষকদের জমি পুনর্বণ্টনের দাবিকে তিনি স্বীকৃতি দেননি । কিন্তু একই সঙ্গে তিনি অবহিত ছিলেন যে কতিপয় মানুষের হাতে যাবতীয় জমির মালিকানা কুক্ষিগত থাকা আর্থিক বিকাশের পরিপন্থী । তাই তিনি নতুন আইন প্রণয়ন করে জমির ব্যক্তিগত মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা নির্দিষ্ট করে দেন । এতদিন এথেন্সের নিজস্ব মুদ্রা ছিল না । এথেন্সবাসী ইজিনার মুদ্রা ব্যবহার করত । সোলোন এথেনীয় মুদ্রার প্রবর্তন করেন । তাছাড়া কৃষির সঙ্গে শিল্পের বিকাশ ঘটানোর বিষয়ে সচেতন ছিলেন তিনি । তবে সোলোনের অর্থনৈতিক সংস্কারের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল 'ভারমোচন' বা 'সেইসাকথিয়া' (Seisachtheia)। এর অর্থ ছিল দরিদ্র শ্রেণিকে চরম দুর্গতি থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি তাদের ঋণজনিত দাসত্ব থেকে মুক্তি দেন
সোলোনের রাজনৈতিক সংস্কারও ছিল তাৎপর্যপূর্ণ । রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নাগরিকদের বৃহত্তর অংশগ্রহণের বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন তিনি । সোলোনের আগে শাসনতন্ত্র পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রবীণদের পরিষদ বা 'অ্যারিওপেগাস' (Areopagus) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত । আর ছিল গণপরিষদ বা এক্লেসিয়া (Ekklesia)। এখানে সাধারণ নাগরিক অংশগ্রহণ করতে পারতেন এবং ভোট দিতেন । এই গণপরিষদ আর্কনদের নির্বাচিত করত । গ্রিসে রাজতন্ত্রের যুগে প্রবীণদের পরিষদ বা অ্যারিওপেগাস প্রশাসনিক ক্ষেত্রে উপদেষ্টার কাজ করত। রাজতন্ত্রের পতনের পর এক বিশেষ শাসক গোষ্ঠী ক্ষমতায় আসীন হয় । এরা ছিল অভিজাত শ্রেণির মানুষ । এরা কতকগুলি ক্ষুদ্র কমিটি গঠন করে যাবতীয় রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করে । কিন্তু সোলোন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় মানুষের বৃহত্তর অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি ৪০০ সদস্য বিশিষ্ট 'বউল' (Boule) নামে একটি পরিষদ গঠন করেন। 'বউল' -এর ওপর প্রধান রাজনৈতিক ক্ষমতাগুলি ন্যস্ত করা হয় । পুরোনো পরিষদের ক্ষমতা অনেকটাই খর্ব করা হয়। সোলোনের উদ্দেশ্য ছিল অনভিজাত গোষ্ঠীগুলিকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় শামিল করা।
সম্পত্তির পরিমাণ অনুযায়ী সোলোন এথেনীয় নাগরিকদের চার ভাগে বিভক্ত করেছিলেন। যে সমস্ত নাগরিকের আয় ছিল ৫০০ মেডিমনি বা তার বেশি, তাদের বলা হত 'পেন্টাকোসিও মেডিমনয়' (এখানে উল্লেখ করা জরুরি মেডিমনি হল কোনো শক্ত ও তরল বস্তুর পরিমাপ ১ মেডিমনি ছিল একাধারে ৩৮ কিলোগ্রাম ও ৫২.৫ লিটার)। যাদের আয় ছিল ৩০০ ৫০০ মেডিমনির সমপরিমাণ মূল্যের তাদের বলা হত 'হিপ্লিয়েস' বা অশ্বারোহী। যাদের আয় ছিল ২০০ থেকে ৩০০ মেডিমনির সমমূল্যের তাদের বলা হত 'জিউগিটাই' । এরা ছিলেন ছোটো ও মাঝারি চাষি। আর যারা ২০০ মেডিমনির সমমূল্যের চেয়ে কম আয় করতেন তাদের বলা হত 'থেটিস'। থেটিসরা ছিলেন শ্রমজীবী । সোলোনের শাসনকালে অর্ধেকের বেশি মানুষ ছিলেন থেটিস শ্রেণিভুক্ত । দরিদ্র কৃষক, কারিগর ও ভূমিহীন নাগরিকদের নিয়ে থেটিস শ্রেণি গড়ে উঠেছিল । তারা গণসভার (ekklesia) সদস্য হতে পারত, কিন্তু তাদের ভোটদানের অধিকার ছিল না।
সোলোনের আইনি সংস্কারও ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি হেলাইয়া নামে একটি গণআদালত গঠন করেন। সোলোনের আইনি সংস্কারের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আইনের চোখে সকলের সমানাধিকারকে স্বীকৃতি দান । তাছাড়া বিচারে অসন্তুষ্ট ব্যক্তিকে উচ্চতর আদালতে আপিল করার ব্যবস্থা করেন সোলোন। তিনি বেশ কিছু আদালত গঠন করেছিলেন এবং বিভিন্ন শ্রেণি থেকে বিচারক নিয়োগ করা হয়েছিল। বিচার ব্যবস্থায় অভিজাত শ্রেণির আধিপত্যের অবসান ঘটান সোলোন। কিন্তু আর্থিক ক্ষেত্রে অভিজাতদের আধিপত্যের অবসান তিনি ঘটাতে চাননি ।
সোলোনের সংস্কার সাময়িকভাবে সামাজিক উত্তেজনার প্রশমন ঘটায়, কিন্তু সমস্যার স্থায়ী সমাধান তিনি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন । কৃষকদের প্রধান দাবি ছিল কৃষিজমির পুনর্বণ্টন; কিন্তু সোলোন এই দাবি পূরণ করেননি। ফলে কিছু দিনের মধ্যেই অভিজাত ও দরিদ্র চাষিদের মধ্যে শ্রেণি সংঘাত তীব্র রূপ নেয় এবং সামাজিক উত্তেজনা মাথা চাড়া দেয়।