মুসোলিনির নেতৃত্বে ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থান
ইতালির রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে অস্থিরতা একনায়কতন্ত্রী শক্তির অভ্যুত্থানের পথ প্রশস্ত করেছিল। যুদ্ধ ফেরৎ বেকার সেনা এবং বেকার যুবকদের নিয়ে মুসোলিনী এক আধা সামরিক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেন । তিনি এর নাম দেন 'ফ্যাসিষ্ট'। মিলানের 'ফ্যাসিও' (Fascio) নামক সংগঠনের আদলে তিনি তাঁর দলটিকে গঠন করেন । মুসোলিনী তাঁর দলের ফ্যাসিষ্ট নাম দিয়ে একথা বুঝাতে চান যে, এই দল শক্তির দ্বারা রাষ্ট্র চালাবে। অতীতে বেনিটো মুসোলিনী ছিলেন সমাজতন্ত্রী দলের সদস্য এবং 'আভান্তি' পত্রিকার সম্পাদক । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কর্মচ্যুত সৈনিক, সমাজতন্ত্র-বিরোধী উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীদের একত্রিত করে ১৯১৯ খ্রিঃ ফ্যাসিষ্ট দল গঠিত হলে তিনি এই দলে যোগ দেন । প্রথমদিকে এই দলের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি না থাকলেও, মুসোলিনী বেকার যুবক ও যুদ্ধফেরৎ সেনাদের এই দলে আকৃষ্ট করেন । তিনি দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল ও বামপন্থী ধ্বংসাত্মক শক্তির হাত থেকে ইতালিকে রক্ষার কথা বলেন। তিনি তাঁর ফ্যাসিষ্ট আন্দোলনকে দলবিহীন জাতীয় আন্দোলন বলে দাবী করেন । মুসোলিনী ঘোষণা করেন যে, তিনি অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলতা থেকে দেশকে মুক্ত করবেন । তিনি কমিউনিষ্টদের তীব্র বিরোধিতা করেন ।আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
১৯১৯ খ্রিঃ তিনি "ফ্যাসিষ্ট সংগ্রামী বাহিনী” গড়েন । ফ্যাসিষ্ট দলের স্বেচ্ছাসেবকরা কমিউনিষ্টদের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ দ্বারা কমিউনিষ্টদের সভা – সমিতি, ধর্মঘট ভেঙে ফেলে। শৃঙ্খলা রক্ষা ছিল ফ্যাসিষ্টদের অন্যতম মূল নীতি । ইতালির বুর্জোয়া শ্রেণি ফ্যাসিষ্ট দলকেই ত্রাণকর্তা মনে করে এই দলকে প্রচুর অর্থ সাহায্য করে । মুসোলিনী ফ্যাসিষ্ট স্বেচ্ছাসেবক বা স্কোয়ান্ড্রিষ্টিদের (Squadristi) কালো পোষাকে সজ্জিত করেন। তিনি তাদের ফ্যাসিষ্ট প্রথায় অভিবাদন এবং কুচকাওয়াজ করতে শেখান।
১৯২১ খ্রিঃ নির্বাচনে ফ্যাসিষ্ট দল ভোটারদের ভীতি প্রদর্শন করে ও অন্যান্য উপায়ে নির্বাচনের দ্বারা আইনসভায় মাত্র ৩১ টি আসন পায়। (মতান্তরে ৩৫ টি আসন) । ব্যালটের মাধ্যমে ক্ষমতা লাভ অসম্ভব দেখে মুসোলিনী বল প্রয়োগে ক্ষমতা দখলের সিদ্ধান্ত নেন । মুসোলিনী দাবী করেন যে, তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পদে নিয়োগ করতে হবে । মুসোলিনী বলেন যে, “ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে বলপ্রয়োগ দ্বারা ইতিহাসের গতি নির্ধারিত হতে দেখা যায় । ইতালিতে সেই সময় এসে গেছে ।” মুসোলিনীর ডাকে হাজার হাজার সশস্ত্র ফ্যাসিষ্ট স্বেচ্ছাসেবক রাজধানী রোমে ঢুকে পড়ে । রাজা তৃতীয় ভিষ্টর ইম্যানুয়েল সেনাদলকে এই বিদ্রোহীদের দমনের জন্য নির্দেশ দিতে রাজী না হওযায়, নির্বাচিত বৈধ মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করে । ভিক্টর ইম্যানুয়েল, মুসোলিনীকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন, যদিও তাঁর পক্ষে মাত্র ৩১ জন সদস্য আইনসভায় ছিল ।
ফ্যাসিষ্ট শক্তির উত্থানে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির সমর্থন ছিল । A. J. Gregor মনে করেন, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আগত সৈনিকদের মধ্য থেকে ফ্যাসিষ্টদের মূল সমর্থন এসেছিল। এদের মধ্যে অনেকেই আগ্রাসী প্রকৃতির ছিলেন এবং এরা গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র কোনটাকেই মেনে নিতে পারেন নি। এদের মধ্যে বেশিরভাগই উগ্রজাতীয়তাবাদী । এরা মনে করতেন বিজয়ী পক্ষে থাকলেও ইতালিকে ভার্সাই সন্ধি দ্বারা প্রত্যারিত করা হয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিশেষ করে ছোটখাট ব্যবসায়ী, দোকানদার, কারিগর, সরকারি কর্মচারী ফ্যাসিবাদকে সমর্থন করেছিল । ভূস্বামী, বড় বড় এস্টেটের মালিক ফ্যাসিষ্টদের সমর্থন করেছিল। এমন কি কৃষকদের একাংশ ফ্যাসিষ্টদের সমর্থন করেছিল । কারণ ফ্যাসিষ্টরা যে ক্ষুদ্র ভূখণ্ড প্রদানের নীতি গ্রহণ করেছিল সেটা সমাজতন্ত্রীদের যৌথ থামারীকরণ প্রক্রিয়ার চেয়ে কৃষকদের কাছে অনেক ভাল বলে মনে হয়েছিল । শিল্পপতি গোষ্ঠীও ফ্যাসিষ্টদের সমর্থক ছিল । তারা ফ্যাসিষ্টদের অর্থ দিয়ে সাহায্য করত । ১৯২১ খ্রিঃ নাগাদ শ্রমিকদের একাংশ ফ্যাসিষ্ট আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হয় । এর কারণ হচ্ছে সমাজতন্ত্রবাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সংকট।
ফ্যাসিবাদের সাফল্যের পেছনে মুসোলিনীর ব্যক্তিগত অবদান ছিল অসীম । তিনিই ফ্যাসিষ্ট দলকে এক সুসংবদ্ধ দলে পরিণত করেন । কিন্তু ফ্যাসিষ্ট দল প্রথম দিকে দুর্বল ছিল । মুসোলিনীর উদ্যোগেই ফ্যাসিষ্ট দল পার্লামেন্টে গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিতে সক্ষম হয়েছিল । মুসোলিনী ছিলেন প্রচণ্ড সুযোগ – সন্ধানী । বাস্তব পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে তিনি সময়মত নীতি ও আদর্শ পরিবর্তন করতে পারতেন । Mack Smith বলেছেন যে, মুসোলিনী তাঁর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করার জন্য অতিরঞ্জন ও মিথ্যা ভাষনে দ্বিধাবোধ করতেন না । সাংবাদিক হিসাবে তাঁর দক্ষতাকে তিনি ভালভাবেই কাজে লাগাতেন । তাঁর ব্যক্তিত্ব, বাচনভঙ্গি জনসাধারণকে প্রভাবিত করত ।
প্রধানমন্ত্রীর পদে বসার পর মুসোলিনী জরুরী ক্ষমতার সাহায্যে সরকারি প্রশাসন ও অন্য সকল দপ্তরে ফ্যাসিকরণ নীতি চালু করেন । সমাজতন্ত্রী দলকে চূর্ণ করা হয় এবং সমাজতান্ত্রিক পত্রিকা, 'অভান্তির' কার্যালয় ধ্বংস করা হয়। ফ্যাসিষ্ট ঝটিকা বাহিনী ফ্যাসি-বিরোধী সমালোচকদের মারপিট ও ক্যাস্টর অয়েল সেবন করিয়ে নির্যাতন করে । আইনসভায় বিরোধীদের নিশ্চিহু করা হয় এবং একদলীয় শাসন প্রবর্তিত হয়। ফ্যাসিষ্ট সন্ত্রাসের ভয়ে বিরোধীরা রাজনীতি ছেড়ে দেন । মাতেওত্তি ( Matteotti) নামে এক বিখ্যাত সমাজতান্ত্রিককে হত্যা করা হয়। ১৯২৪ খ্রিঃ মুসোলিনী দুর্নীতিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটদাতাদের ভীতি প্রদর্শন করে ৬৫% ভোট যোগাড় করেন। তিনি সংবাদপত্রের কন্ঠরোধ করেন। বিরোধী দলগুলিকে নিশ্চিহ্ণ করা হয় । ১৯২৫ খ্রিঃ তিনি 'ইল-দুচে' বা 'নেতা' উপাধি নিয়ে ডিক্টেক্টরে পরিণত হন। এখন থেকে তাঁর আদেশনামাই বৈধ আইনে পরিণত হয় । তিনিই সর্বময় ক্ষমতার অধীশ্বর হন । পৌরসভা, বিদ্যালয়, অফিস, শ্রমিক সংগঠন সর্বত্রই ফ্যাসিষ্ট প্রাধান্য স্থাপিত হয়। মুসেলিনী ঘোষণা করেন যে, “দেশের সব কিছুই হবে রাষ্ট্রের অন্তর্গত ; রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোন কিছুই থাকবে না; রাষ্ট্রের বাইরে কোন কিছুই সহ্য করা হবে না । ১৯২৬ খ্রিঃ একটি আইন দ্বারা মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নগুলিকে নিয়ে 'কর্পোরেশন' গঠনের ব্যবস্থা করা হয় । এই কর্পোরেশন শ্রমিকের মজুরীর হার, কাজ করার সময় প্রভৃতি বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার পায়। তাতে বিরোধের নিস্পত্তি না হলে ট্রাইবুন্যালের আদেশে চুড়ান্ত বিচার করার ব্যবস্থা হয়। ধর্মঘট ও লকআউটকে 'বেআইনী' ঘোষিত হয় ।
📛সম্ভাব্য প্রশ্ন গুলি হলঃ -
- ইতালিতে মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ ও মুসোলিনির উত্থান
- ইতালিতে মুসোলিনির নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদের উত্থান
- ইতালিতে মুসোলিনির নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদের উত্থানের করাণ
- ইতালিতে মুসোলিনির নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদের উত্থানের কারণ
- ফ্যাসিবাদের উদ্ভব
- ফ্যাসিস্ট শব্দের অর্থ কী
- ফ্যাসিবাদের উদ্ভবের কারণ
- ফ্যাসিবাদের আদর্শ কী ছিল
- ফ্যাসিবাদ কি class 9
- মুসোলিনির নেতৃত্বে ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থানpdf