সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ ত্রুটি এবং কেন এটি ব্যর্থ হয়েছিল

পরাধীন ভারতবর্ষের ইতিহাস একাধিক কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহের আলোকে দীপ্ত হয়ে আছে যার মধ্যে অন্যতম হলো সন্দীপ বিদ্রোহ,ফকির বিদ্রোহ , চুয়াড় বিদ্রোহ, মরুম বিদ্রোহ, চাকস বিদ্রোহ, পাহাড়িয়া বিদ্রোহ, নোয়া বিদ্রোহ, পাগলপন্থী বিদ্রোহ , নীল বিদ্রোহ প্রভৃতি ৷ তবে এই যে বিদ্রোহীটি ব্রিটিশ পরিচালিত ভারতবর্ষের শক্তিশালী ব্রিটিশ বাহিনীকেও কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছিল সেটি হল ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে সংগঠিত সাঁওতাল বিদ্রোহ ৷ এর তীব্রতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল ভীষণভাবে আলোচিত ৷ সাঁওতাল বিদ্রোহ সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য যে সকল গ্রন্থ গুলির আমরা সাহায্য নিয়ে থাকি তাদের মধ্যে অন্যতম হলো ডাবলু ডাবলু হান্টার এর রচিত "Annals of ruler Bengals" দিগম্বর চক্রবর্তী প্রণীত "History of santal hool 1855" প্রভৃতি ৷
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ ছিল সুগভীর ১৪৭২ সালে জনগণনার বিকট অনুযায়ী ভাগলপুর ডিভিশনে সাঁওতাল পরগনা অঞ্চল জুড়ে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের ছিল মোট জনসংখ্যার অর্থাৎ ৯ লক্ষ ২৩ হাজার ৫৩২ এর মধ্যে ৪ লক্ষ ৫৫ হাজার ৫২৩ জন ৷ শতকরা ৫০ ভাগের মধ্যেও এই বিপুল সংখ্যক সাঁওতালদের মধ্যে যে সকল কারণে ক্ষোভ ঘনীভূত হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম হলো মহাজনদের লুণ্ঠন, ঋণের জন্য ব্যক্তিগত ও বংশগত দাসত্বের বর্বর প্রথা,এছাড়াও ক্রমবর্ধমান দুর্দশা-দুর্গতি, পুলিশের অত্যাচার,মহাজন শ্রেণীর শোষণ, আদালতে সুবিচার না পাওয়া নগত অর্থের ভূমি রাজস্ব প্রদানের নির্দেশে স্বল্প পরিশ্রমিকের বিনিময়ে রেলপথ নির্মাণের মতো কঠিন কাজের নিয়োগ , সাঁওতালদের নিজস্ব আইনের পরিবর্তে বলপূর্বক তাদের ওপর ব্রিটিশ আইন চাপিয়ে দেওয়া ,সাঁওতাল রমণীদের ওপর অপমানজনক ব্যবহার ৷ সহজ সরল সাঁওতালদের কেউ ভীষণ ক্ষুদ্র করে তোলে যার মধ্যে দিয়ে সাঁওতাল বিদ্রোহ সংঘটিত হয় ৷
গবেষক ওল্ড হোম লিখেছেন পুলিশ ও মহাজনদের অত্যাচার সাঁওতালদের দেশপ্রেমকে জাগিয়ে তুলেছিল ৷ ফলে বীরভূম বাঁকুড়া পুরুলিয়া মুর্শিদাবাদ ভগলপুর পূর্ণিয়া প্রকৃতি অঞ্চলে নিয়ে গড়ে ওঠা দাম-ই-কোহি অরণ্যের রায়ভাল্লুক ন্যায় হিংস্র প্রাণী এবং প্রকৃতির বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম করে সাঁওতালদের নিজ সংস্কৃতি ও বৈশিষ্ট্য গড়ে তোলেন ৷ কিন্তু এই অতি সহজ-সরল মানুষ গুলি হয়ে ওঠেন শাসক শ্রেণী বা লোভী মানুষদের নির্মম শোষণের শিকার ৷ শতকরা ৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত সুদ আদাই, বেআইনি আদায় এবং বলপূর্বক জমি দখল, শারীরিক অত্যাচার সমস্ত কিছুই চলত ৷ ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন ১০ হাজার সাঁওতাল ভগনাডিহিতে মিলিত হয়ে জমিদার মহাজন ও বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন । ৭ জুলাই ডিহি পরগনার দারোগা বিদ্রোহের নেতা সিধু ও কানুকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিলে ক্ষুদ্ধ জনতা সেই দারোগা সহ সাতজনকে তাৎক্ষণিকভাবে খুন করেন বিষাক্ত তীর ,ধনুক ,কুঠার, তরোয়াল সহকারে সাঁওতালদের রক্তাক্ত বিদ্রোহ শুরু করেন ৷ ১২০০০ ইংরেজ সৈন্য থাকা সত্ত্বেও বিদ্রোহীদের ৪০ মাইলের মধ্যে তারা পৌঁছাতে ভয় পেত ৷
সুপ্রকাশ রায় তার "মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় কৃষক" গ্রন্থে বলেছেন শোষণ অত্যাচার অবিচার থেকে বিদ্রোহের সৃষ্টি হয় এবং সেই বিদ্রোহের বিচার থেকে জন্ম নেয় এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব সিধু কানু ভৈরব প্রমুখো নেতাদের নেতৃত্বে পরিচালিত বিদ্রোহের কুখ্যাত মহাজন ও অসৎ ব্যবসায়ী মানিক চৌধুরী,গোরাচাঁদ সেন ,নিমাই দত্ত, হাবু দত্ত আহত বিদ্রোহী নেতা সিধু আহ্বান জানায় ভিবু এবং বাঙালি মহাজনদের গঙ্গা পার করিয়ে দাও ,আমাদের নিজেদের হাতে শাসন চাই ৷ বিদ্রোহীরা একাধিক উৎপীড়া কারীদের একে একে হত্যা করেন ৷ কুখ্যাত দারোগা মহেশ লাল দত্তের হত্যার মধ্যে দিয়ে যে সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচিত হয় তা ক্রমশ ব্যাপক আকার ধারণ করে ইংরেজদের অতঙ্কিত করে তোলেন ৷ এই বিদ্রোহ দমনার্ধে ব্রিটিশরা নির্মম নৃশংস ব্যবস্থা গ্রহণ করেন ৷ ১৫ হাজার সুশিক্ষিত কামান ও বন্দুকধারী ব্রিটিশ সৈন্যের সঙ্গে তীর ধনুক সহকারে সাঁওতালদের দাঁড়ায়ে সাঁওতাল পরগনা রক্তাক্ত হয়ে পড়েন ৷ সাঁওতালদের ক্ষুদ্র গৃহগুলিতেও অগ্নি সংযোগ করা হয় । "বলফোর্স এনসাইকোপিডিয়া অফ ইন্ডিয়া ভলিউম iii" গ্রন্থে ৫২৭ নম্বর পাতা থেকে জানা যায় সাঁওতাল বিদ্রোহীদের প্রায় শতকরা ৫০ জনে নিহিত হয়েছিল যার মোট সংখ্যা ছিল ১৫ থেকে ২০,০০০ এর মধ্যে ৷
বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে শুরু হওয়া এই আন্দোলন স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততা সত্ত্বেও সমস্ত কিছু পুরো মাত্রা থাকলেও আন্দোলন তার প্রান্তিক লগ্নে পৌঁছাতে পারেনি ৷ তার পিছনে একাধিক কারণ ছিল ৷ ব্যর্থতা সবথেকে বড় কারণ হলো অতি আধুনিক মারণঅস্ত্রে সজ্জিত ব্রিটিশ বাহিনীর নিকট ঘরোয়া পদ্ধতিতে তৈরি তীর ধনুকের সাহায্যে দীর্ঘদিন লড়াই চালিয়ে যাওয়া বাস্তবসম্মত ছিল না ৷ তাই একটি পর্যায়ে সাঁওতালরা পিছুটতে বাধ্য হয় ৷ দেশীয় ব্যবসায়ী, মহাজন এবং মধ্যসত্ত্ব ব্যক্তিদের সমর্থন ইংরেজদের পক্ষে থাকায় সাঁওতালরা আরও কোলঠাসা হয়ে পড়ে ৷ সাঁওতাল পরগনাকে ব্রিটিশরা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দিতে সক্ষম হয় । সাঁওতালদের এই জীবন বরণ লড়াইয়ে ভারতীয় কোন শক্তিধর সম্প্রদায় সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি ফলে এই এটি কেবলমাত্র একটি শ্রেণি আন্দোলন হয়ে থেকে যায় ৷ যা সাওতাল আন্দোলনকে দুর্বল করে তোলে ৷
তবে এই আন্দোলন চরম লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারলেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সম্মুখে দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল ৷ অধ্যাপক নরহরি কবিরাজ এর মতে,"এই বিদ্রোহ হয়ে উঠেছিল সকল সম্প্রদায়ের দরিদ্র মানুষের মুক্তিযুদ্ধ ৷" ডক্টর কালী কিংকর দত্ত বলেন,"বাংলা ও বিহারের ইতিহাসে এই বিদ্রোহ এক নবযুগের সূচনা করেন।" কাল মার্ক তার 'নোটস অন ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি' গ্রন্থে, সাঁওতাল বিদ্রোহকে "গরিলা যুদ্ধ" বলে অভিহিত করেছেন ৷ তবে এই সাঁওতালরা অবশ্যই গরিলা যুদ্ধ করেনি তারা রীতিমতো মুখোমুখি লড়াই করেছিল ৷ শান্ত সাঁওতালদের রক্তাক্ত বিদ্রোহ ভারতের ইতিহাসে চিরকালীন সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে, কারণ এই আন্দোলন ছিল জাতীয়তাবাদীর লড়াইয়ের উদ্দীপক শক্তি ৷